দূরত্বে থেকেও ভালোবাসি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকেই আমার লেখালেখির অভ্যাস। এটা প্রবাসজীবনে আরও বৃদ্ধি পায়। কারণ জীবন তখন নিঃসঙ্গতায়। কলম চলে দুর্বার গতিতে ডায়েরি আর চিঠির পাতায়। কত লিখেছি মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির বুকে চিরে দিগন্তহীন রাস্তার মাঝে বালির টিলায়। বাবা চিঠি লিখতেন তখন সপ্তায় দুই-তিনটা। পাশের বাড়ির কার কী হলো থেকে শুরু করে হরতাল, সরকার, এমনকি বৃদ্ধ বয়সে কেউ বিয়ে সাদি করল কিনা সে খবরও পেতাম চিঠির পাতায়। বাবার চিঠি ছিল আমার কাছে সংবাদপত্রের মতো।

বিয়ে যে করেছি তার আগের এক বছর ছিল চিঠির প্রেম। বাবা তার ছবি পাঠিয়েছিলেন চিঠির খামে। সঙ্গে ঠিকানা। সেই এক দেখাতেই হয়ে যাই তার দিওয়ানা। সে লিখত এক পাতা। আমি দিস্তার পর দিস্তা। মানুষ পাঠাত চিঠি দুই রিয়ালের খামে। আমি পাঠাতাম ওজনে মেপে। শুধু কী তাই! অ্যানালগ টেলিফোন নিয়ে সেকি লুকোচুরি।
ওই সময় আমি সৌদি আরবের রিয়াদে থাকতাম। প্রথমবার তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ভোর সাড়ে চারটায় হাইয়ুল নফলের রাতের ডিউটির শেষ বাসে এলাম প্রজেক্টের কাছে। মালিক ফাহাদ রোডে ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো ট্যাক্সি নেই সুনসান। হঠাৎ একটি খালি বাস হাত তুললাম। দাঁড়াল। ছুটল বাথা, বাংলাদেশিদের আস্তানার দিকে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তখন সেখানে দুই নম্বরি লাইনে কথা বলা যেত। ভারতীয়, পাকিস্তানি, কাশ্মীরি, আফগানি আর বাংলাদেশিদের লম্বা লাইন। মিনিটে এক রিয়াল। ন্যূনতম দশ মিনিট। এ ব্যাপারটা ছিল 

সৌদি সরকারের আড়ালে। তাই গোপনীয়তা রক্ষা করতে হতো।
সেদিন ফজরের আজান শেষ। খামসা বিল্ডিং থেকে শুরু করে বাথা মূল মার্কেটের প্রায় গোটা দশেক জায়গায় ঢুঁ মারলাম। কোথাও সিরিয়াল না পেয়ে ফেরার পথে একজন পেছন থেকে ভাই বলে ডাকল। ফিরে দেখি আমাদের কোম্পানি থেকে পালিয়ে যাওয়া হাসান।
কথা প্রসঙ্গে জানলাম হাসান টেলিফোন লাইনে কথা বলার ব্যবসা করে। সে সবাইকে বলল, লাইন খারাপ শ্রীলঙ্কায়, আজ হবে না। সবাই চলে গেল। হাসান আমাকে বলল লাইন ঠিক আছে। আজ ভাবির সঙ্গে প্রথম কথা বলবেন। আপনি নিশ্চিন্তে কথা বলুন।
ও দিকে দেশে আমার প্রেমিক মানে হবু স্ত্রী অপেক্ষা করছে তার এক শিক্ষকের বাসায়। সেই প্রথম কথা। টেলিফোনে আপনি থেকে তুমি। দুই ঘণ্টা কথা হলো সেদিন। হাসান একটি অডিও ক্যাসেটে দুই পাশের কথা রেকর্ড করেছিল। রেকর্ড করা সেই কথা পরে ওয়াকম্যানে শুনতাম। সেই আমাদের প্রথম কথোপকথন, প্রেম আলাপন। কেউ দেশে গেলে ক্যাসেটে রেকর্ডিং করে পাঠাতাম। বাড়িতে একটি ক্যাসেট গেলে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন উঠানে বসে চা পানের আড্ডায় শুনতেন আমার সেই কথা। মা বুক ঘষতেন আমার আবেগী কথায়। আবার মা-বাবাও কথা বলে পাঠাতেন। আমি ভাসতাম চোখের জ্বলে বিদেশের মাটিতে।
পরে আমার বিয়ে হলো। এর কিছুদিনের মধ্যে আমাদের গ্রামের নোয়াখালী সেনবাগ বাজারে একটি দোকানে প্রথম গ্রামীণফোনের মোবাইল সার্ভিস চালু হয়। আমি কল করে বললে, তারা বাড়ি থেকে রিকশায় করে নিয়ে আসত আমার মা ও স্ত্রীকে। এর মাঝেই বাড়িতে টিনের ঘরেই এল ডিজিটাল টিঅ্যান্ডটির লাইন। আশপাশের যারা বিদেশে থাকতেন তারাও ওই ফোনের মাধ্যমে কথা বলতেন বিদেশে।
এক সময় বাবা-মা, এমনকি স্ত্রীর হাতে মোবাইল। কাজের মাঝে রাতের পর রাত কথা হতো। আমার বড় মেয়ে যখন আসবে পৃথিবীতে, তার মায়ের গর্ভে সে, তার সঙ্গেও কথা বলেছি মোবাইলে। সে শুনতো কিনা জানি না। আমি স্ত্রীকে বলতাম তুমি মোবাইলটা ধরো আমি কথা বলব। ও আমাকে কতবার বলেছে তুমি একটা পাগল। আসলে প্রবাসীরা পাগল হয়, বদ্ধ পাগল, ভালোবাসার পাগল। মেয়ে যখন এল পৃথিবীতে আমি তখন দেশে, ২৬ দিনের মেয়েটাকে রেখে অর্থের অভাবে পালিয়ে আসি বিদেশে। ওর বাবা ডাক আমি প্রথমে মোবাইলেই শুনি।

লেখক
লেখক

তখনো চিঠি চলতো। আমার মেয়ের প্রথম অক্ষর শেখা, ফুল পাখি আঁকা, বাবা-মার ছবি আঁকা লাল নীল রঙের ছবিগুলো আজও আমার লাগেজে করে নিয়ে যাই আবার নিয়ে আসি। তেমনি আমার আর স্ত্রীর সব চিঠি বয়ে বেড়াই। সময় পেলেই পড়ি। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করি প্রবাসে থেকেও প্রতি মুহূর্ত স্ত্রী সন্তান বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে চাই।
এখন যোগাযোগ আরও সহজ হয়েছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার, ইমো, ওয়াটস আপে চ্যাটিং হচ্ছে। সরাসরি কথা বলছি বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে। দুই মেয়ে এখন বড় হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে। আমি লাইভ দেখছি। কষ্টের মুহূর্তগুলোতে কাছে পাচ্ছি তাদের।
মোবাইল-ইন্টারনেটের সুবিধায় এটা সম্ভব হয়েছে। দেশ ডিজিটাল হয়েছে। বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে এখন মোবাইল সুবিধা। প্রবাসীরাই এই ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারক বাহক। তারা রেমিট্যান্স যেমন পাঠাচ্ছেন তেমনি আধুনিক সুবিধার প্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিচ্ছে প্রিয়জনের কাছে।
দূরে থেকেও ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল তারা। যত বলি, তবু মনে হয় হয়নি সব বলা। সেই একই কথা ভালোবাসি, ভালোবাসি। দূরত্বে থেকেও ভালোবাসি। রাত যখন গভীর হয়, থেকে যায় সময়ের ব্যবধান। তবু চলে অপেক্ষা। কথা হয় সরাসরি। বউ মাঝে মাঝেই বলে, ইস, যদি ছোঁয়া যেত। উত্তর দিই তাহলে কি হতো, জানি না। এভাবেই কাটে অনেক সময় নির্ঘুম রাত, হা হুতাশ, হতাশায়।
এত কিছুর পরও অনেক কথা হয় না বলা। অনেক কষ্ট বুকে থাকে চাপা। ক্ষণ, মিনিট, ঘণ্টা, দিন-রাত্রি। প্রবাসীর বুকে থেকে যায় হাহাকার। প্রবাসীর বুকে থেকে যায় চাপা কষ্ট।