বাবাকে ছাড়া আমার পৃথিবী

লেখকের বাবা
লেখকের বাবা

বাবা কেমন আছ? কত দিন পেরিয়ে গেল তোমার কোনো খবর আমি পাই না। আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে ওপার থেকে তোমার জীবন্ত একটি হ্যালো শুনব বলে। সেই যে শেষ একটা ঝাড়ি দিলে, সেই শেষ ঝাড়িটায় আর তো কথা বললে না। বাবা তুমি সব সময় এমন কেন ছিলে? তোমার চলে যাওয়ার দিন মন খুলে একটু কান্নাও তো করতে দিলে না। তুমি আমাকে সারা জীবনের কান্না দিয়ে যাবে, সে জন্য মনে হয় সেদিনের কান্নায় তুমি বাঁধ সেধেছিলে। বাবা বিশ্বাস কর আমি কখনো একটি মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলে থাকিনি। বাবা তুমি ছিলে আমার ভালোবাসার সবকিছু। আমার সংগ্রাম, পথচলা, জীবনে অনেক বড় হতে চাওয়া—সবকিছুর মূলেই তুমি ছিলে বাবা, শুধু তুমি।

আমি মনে মনে একটা একটা বিশ্বাস সব সময়ই রাখতাম। বিশ্বাস ছিল আমার বাবা-মা সব সময় গর্ব করে বলবেন আমি তাদের সেরা সন্তান! যে সব সময়ই অন্যদের ছেয়ে আলাদা। ভালোবাসবে শুধু বাবা-মাকে ও তাদের স্বপ্নগুলোকে। হ্যাঁ বাবা, আমি সেরকমই করেছি। তোমার স্বপ্নগুলো পূরণে নাবালক বয়সেই তোমাকে ও পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ছুটেছি দেশ ছেড়ে বিদেশে। আমার চোখে তোমার স্বপ্ন নিয়ে। আমার চোখে অধরা কত স্বপ্ন। অথচ আমার জীবন নৌকার মাঝিই যে পাড়ি দিয়েছেন অসীম পথে। একি অভিমান না নির্দয়তা বাবা। তোমার সন্তানদের এতিম বানিয়ে চলে গেলে বাবা। আমাদের কথা একটু ভাবলে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি আমার বাবা নেই, বুকটা ছিঁড়ে যায় বাবা। আমি যে এখনো বিশ্বাস করি না, তুমি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গিয়েছ।

মাকে বলেছি তোমার কাপড়গুলো যেন আলনায় ঠিক আগের মতোই ভাঁজ করে রাখে। কখনো ফিরে যদি তোমার একটু গন্ধ আমি পাই। আমার যে আর তোমাকে জড়িয়ে ধরার সৌভাগ্য হবে না। আমি এমনই হতভাগ্য যে, তোমার কবরে মাটিও দিতে পারিনি।

কী সহজ না বাবা, আমার বুকে পাহাড়সম যন্ত্রণাকে সারা জীবনের সঙ্গী করে চুপচাপ এভাবে তুমি বিদায় নিলে। বাবা আমারও তো স্বপ্ন ছিল টাকা উপার্জন করে তোমাকে আর মাকে নিয়ে হজ করতে যাব। স্বপ্ন ছিল তোমাকে নিয়ে ইউরোপের দেশে ঘুরব। তুমি না আমাকে বলতে তোমার খুব শখ আরেকবার লন্ডন যাওয়ার। সেই কত আগে একবার তুমি লন্ডনে গিয়েছিলে। সে গল্প প্রায়ই আমাকে শোনাতে।

আমার কাছে আবদার করেছিলে আর একবার যেন তোমাকে লন্ডনে ঘুরাতে নিয়ে যাই। বাবা আমি খুব শিগগিরই হয়তো তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তুমিতো আমাকে সেই সুযোগই দিলে না। আজ আমার দিনরাত শুধু কান্নায় এক বিশাল সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখার বয়স না পেরোতেই আমার জীবন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। বাবা সত্যি একটা কথা কি জানো, তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা শুধুই সান্ত্বনার। আমার স্বপ্নগুলো আর স্বপ্ন নেই, ফিকে হয়েছে বহু আগেই। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে একটি দিনের জন্যও স্বাভাবিক থাকতে দেয়নি। আমি কখনো স্বাভাবিক হতে পারব না বাবা।
একটি একটি করে রমজান প্রায় শেষ হতে চলল। গেল বছর ইফতারের আগে প্রতিদিন তোমার জন্য দোয়া করেছি মহান আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ যেন তোমার অনেক হায়াত দান করেন। কিন্তু এই রমজানে তুমি পরপারে। কতবার মনে পড়েছে রমজানে, তোমার সঙ্গে কবে ইফতার করেছি। তুমি থাকলে ফোন করে কী কী জিজ্ঞাসা করতাম? গেল রমজানে কত দিন তোমাকে ফোন দিয়ে সাহরিতে জাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কী হতভাগ্য তোমার ছেলে, সারা জীবনেও কি আর সে তোমার সঙ্গে একবার ইফতার করার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে?
২০ রমজানের পর থেকে তুমি সবার ঈদের কেনাকাটার জন্য টাকা ভাগ করে দিতে। আমি সব সময় সবার চেয়ে বেশি পেতাম। বড় ছেলে বলেই হয়তো তোমার বেশি ভক্তি। মনে আছে বাবা, তুমি প্রত্যেকটা ঈদের কেনাকাটার টাকা দেওয়ার পরও কিছু টাকা আমাকে লুকিয়ে দিতে, যেন মা না দেখতে পায়? কেন এমন করতে বাবা, কেন আমাকে এত ভালোবাসতে? আমাকে ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার একটু সুযোগও দিলে না। আমি যে আমার পুরো জীবনটাকেই তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিতাম। আমার সবকিছুর মূলে তুমিই ছিলে বাবা, শুধু তুমি।

লেখক
লেখক

গত বছর ঈদে তোমাকে প্রথমে ফোন করেছিলাম। এপারে আমার বিবর্ণ কান্না। তোমাদের কত দিন না দেখতে পারার, তোমাদের ছাড়া একা একা প্রথম ঈদ পালন করার। বিশ্বাস করো বাবা, ঈদের দিন সারা দিন কেঁদেছি। তারপরও আশায় বুক বাঁধছিলাম পরবর্তী ঈদটা তোমাদের সঙ্গে করব বলে। কিন্তু সে সুযোগ আমার আর সারা জীবনেও আসবে না। হায় নিয়তি আমার।
মনে পড়ে বাবা দোকানে গিয়ে ছোটবেলায় আমার সব আবদারগুলো তুমি পূরণ করতে। আমার যা ইচ্ছে হতো কিনে দিতে। রাতে বাড়ি ফিরে আমি যখন ঘুমিয়ে পড়তাম আমার বিছানার পাশে আমার পছন্দের জিনিসগুলো কিনে এনে রাখতে। আমি ছোটবেলায় তোমাকে ছাড়া ঘুমাতাম না। এমন অনেক রাত তুমি দেরি করে ফিরেছ বলে, আম্মুর সঙ্গে আমিও অপেক্ষা করেছি—বাবা এলে ঘুমাব। আমি এখনো তোমার পথ চেয়ে থাকি বাবা। রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। তুমি নেই, এ কথা একটি দুঃস্বপ্নের মতো হারিয়ে বিলীন হয়ে যাক। আমি আবারও তোমার আঙুল ধরে হাঁটতে চাই বাবা। তোমার মোটর বাইকের সামনে বসে স্কুলে যেতে চাই।
একটিবার ফিরে আসো বাবা, মানুষদের বলে দাও, আমি পিতৃশূন্য যুবক নই, আমারও মাথার ওপরে বিশাল আকাশ আছে। আমারও বাবা আছে।