শুনতে কি পাও তুমি বাবা?

নৌ-বিহারে বাবার সঙ্গে লেখক ও তার স্ত্রী
নৌ-বিহারে বাবার সঙ্গে লেখক ও তার স্ত্রী

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত নর্ডিক দেশগুলোতে গ্রীষ্মকালের (summer) স্থায়িত্বকাল দুই-তিন মাসের বেশি হয় না। জুন, জুলাই ও আগস্ট—মূলত এই তিন মাসই গ্রীষ্মকাল। তাও আবার বিধাতার আশীর্বাদের কৃপার ওপর তাপমাত্রার ওঠানামা নির্ভরশীল।

স্বল্পকালের এই গ্রীষ্ম উপভোগের জন্য নর্ডিক দেশগুলোর মানুষেরা বর্ষব্যাপী অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। এই সময় চোখ জুড়িয়ে যায় নানা রঙের ফুলে ফলে। গ্রীষ্মে এই শুভ্র স্বচ্ছ সাদা তুষারের দেশে প্রকৃতি যেন যৌবনের দুরন্ত রূপে আবির্ভূত হয়। প্রকৃতির সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষগুলোও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আমার এই নর্ডিক প্রবাসজীবনেও এমনি একটি গ্রীষ্ম স্মরণীয় হয়ে আছে। হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে আপন ও ভরসা-ভালোবাসার মানুষটি যে এসেছিলেন আজ থেকে ১০ বছর আগে, এমনি এক গ্রীষ্মে। যা আজও আমি ফিরে পাওয়ার জন্য প্রতিটি গ্রীষ্মেই বারবার প্রত্যাশা ও অপেক্ষা করি। আদর্শ-প্রেরণা-শিক্ষক-গুরুজন আবার পরম বন্ধু আমার বাবা আমার ছোট ভাই দিপুকে নিয়ে ১০ বছর আগে ২০০৭ সালে গ্রীষ্মের নর্ডিকের ছোঁয়া নিতে এসেছিলেন ফিনল্যান্ডে। বাবা, আমি, দিপু ও আমার সহধর্মিণী রিমা—আমাদের কতই না আনন্দ এই প্রবাসে সুখের গ্রীষ্ম ছিল সেই দিনগুলো।

নৌ-বিহারে বাবার সঙ্গে লেখক, তার স্ত্রী ও ভাই
নৌ-বিহারে বাবার সঙ্গে লেখক, তার স্ত্রী ও ভাই

বাবা একটা কথা ফিনল্যান্ডে এসেই বলেছিলেন, এত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও বর্ণিল প্রকৃতির দেশের মানুষগুলো যেন প্রকৃতির মতোই স্বচ্ছ! কথাগুলো যে সঠিক তাৎপর্যময় ও প্রমাণিত সেটা আজ কারও অজানা নয়। তখন আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না থাকলেও বেড়ানো ও আনন্দের কমতি ছিল না আমাদের। আর হবেই না কেন। বাবা যে উপস্থিত আমাদের সঙ্গে।
অনেক স্মৃতির মধ্যে একটি পড়ন্ত বিকেলে বাল্টিক সাগরের বুক চিরে প্রমোদতরী হেলসিংকি থেকে স্টকহোমের (সুইডেন) উদ্দেশে ছুটে চলেছে। আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে আমি, রিমা ও দিপু সবাই ছিলাম সেই যাত্রায়। সারা রাত ধরে বাল্টিক সাগরে ভেসে চলা ভাইকিং লাইনে (প্রমোদতরী) বাবা ছিলেন উৎফুল্ল। আমাদের সবার আনন্দের বাঁধ ভেঙেছিল। আজও আমার কাছে সেটা জীবন্ত ও সুখের স্মৃতি হয়ে আছে।
কিন্তু আজ বাবা প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়ম ও বার্ধক্যের কারণে আর হয়তো ফিনল্যান্ডে আসতে পারবেন না। আর আমরাও বাবার সঙ্গে হয়তো কখনো বাল্টিক সাগরের বুকে ভাসতে পারব না। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বাল্টিক অববাহিকায় ঘুরে বেড়ানোর কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। প্রবাসে আপন মানুষগুলোকে মিস করা নিত্য সময়ের সঙ্গী যে আমাদের। প্রত্যাশিত পুরোনো দিনগুলো ফিরে পাওয়ার দুরন্ত ইচ্ছে কার না হয়? সকল বাবার ভালো থাকার প্রত্যাশাই যে প্রবাসীদের একান্ত কাম্য। আর আমি উচ্চস্বরে বলতে চাই, বাবা আমি প্রবাসে প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে খুব খুব মিস করছি, সেটা শুনতে কি পাও তুমি বাবা?