বাস্তব জীবন বড়ই নিষ্ঠুর

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমি যখন ২০১৪ সালে দেশ ছাড়ি তখনো আব্বার মধ্যে বেশ চঞ্চলতা দেখেছিলাম৷ তিনি ছিলেন খুবই ছটফটে স্বভাবের একজন মানুষ৷ আব্বা আমাদের দুই ভাইকে বাজান বলে ডাকতেন৷ বড় পরিবারে সব থেকে কনিষ্ঠ সদস্যপদ ছিল আমার, তাই আব্বা আমাকে ডাকতেন কুটি বাজান বলে৷

আমার ও আব্বার মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি৷ সাধারণত এমন বয়সের পার্থক্য দৌহিত্র ও পিতামহের মধ্যে হয়ে থাকে৷ স্পষ্ট মনে পড়ে, ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে কোথাও যেতে খুব লজ্জা পেতাম৷ অনেকেই আমাদের পিতা-পুত্রের সম্পর্ককে ভুল বুঝে অন্য কিছু মন্তব্য করে বসতেন। তখন আব্বা লজ্জা পেয়ে বলতেন, না এটা আমার ছোট ছেলে ৷ তা ছাড়া অন্যদের বাবাদের দেখতাম কালো কেশধারী মধ্যবয়সী আর আমি ছোটবেলাতেই দেখেছি আব্বার চুল ও দাঁড়ি ছিল পবিত্রতায় শ্বেতশুভ্র৷ এতে অবশ্য আমার কোনো বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না৷ বড় পৃথিবীতে আব্বা ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে সেরা একজন ব্যক্তিত্ব৷ আব্বা তার সব সন্তানদের মধ্যে আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন৷ এটা ছিল আমার বিশ্বাস৷ হয়তো প্রতিটা সন্তানই এমন বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে৷
সাত শ কোটি মানুষের পৃথিবীতে আমার আব্বার কাছে মাত্র দুজন সেলিব্রেটি ছিল। সেই বিখ্যাত দুজন হলো আমি নিজে ও আমার বড় ভাই৷ তিনি আমাদের দুজনকে পৃথিবীর সেরা বুদ্ধিমান ও সর্বগুণে পারদর্শী ভাবতেন৷ কারও সঙ্গে তিনি গল্পে বসলে তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রই থাকতাম আমি ও আমার বড় ভাই৷ হোক সে গল্পের দৈর্ঘ্য দুই মিনিট কী তিন ঘণ্টার৷ যদিও কোনো গুণের বিন্দুমাত্র লক্ষণ আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো কালেই ছিল না৷ হয়তো এটাই বাস্তব, সব বাবাই তাদের সন্তানদের গুণের দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে থাকেন৷ হোক না সে সন্ত্রাসীর বাবা কিংবা রাষ্ট্রপতির বাবা৷
গত ৫ জুন প্রথম আলো অনলাইনে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ‘মায়ের কাছে খোলা চিঠি’ শিরোনামে৷ লেখাটি ছিল চোখ বন্ধ করে একটা কল্পনাপ্রসূত লেখা। যা শৈশবে মা ও আমাদের সঙ্গে ঘটেছিল৷ লেখাটিতে অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে ইমেইল করেছিলেন৷ বাস্তব জীবন বড়ই নিষ্ঠুর হয়৷ বাস্তবতা ছিল, পরদিন ৬ তারিখেই আমার আব্বা না ফেরার দেশে চলে যান৷
আসলে মানুষের দীর্ঘ জীবনে সুখ ও দুঃখ ঠিক নদীর জোয়ার-ভাটার মতোই আসে যায়৷ আজ আমি কাঁদছি অন্য কেউ হয়তো হাসছে। আগামীকাল আমি হাসব তখন সে হয়তো কাঁদবে৷ এটাই হয়তো জীবন৷

লেখকের বাবা
লেখকের বাবা

সকল সন্তানেরাই ছোটবেলাতে তাদের বাবা-মায়ের ব্যাপারে খুব ক্রেজি থাকে৷ আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না৷ ছোটবেলাতে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন নামাজ পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার প্রার্থনা করতাম, আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর আগেই যেন আমি মারা যাই৷ সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা রাখেননি৷ আমার আগেই আমার আব্বা চলে গেলেন৷
জার্মানিতে বসে আব্বার মৃত্যুর সংবাদটা ছিল এখনো পর্যন্ত আমার জীবনের সব থেকে শক্ত হওয়ার দিন৷ মাত্র দেড় মাস হলো আমি দেশ থেকে ঘুরে এসেছি৷ চাইলেই দেশে ফেরাটা ছিল অসম্ভব ছিল৷ যেদিন আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান সেদিন আমার জার্মান ভিসা অফিসে একটা সাক্ষাৎ ছিল৷ আমি যখন বুকে অশ্রু লুকিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য বের হয়ে ট্রামে উঠেছি, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার বড় ভাই একটা ভিডিও কলে আব্বার নিথর দেহটা দেখাচ্ছিলেন৷ যে আব্বার মাঝে আমি সারাজীবন চঞ্চলতা দেখেছিলাম, হুমকি-ধমকি দেখেছিলাম৷ সাদা কাপড়ে মোড়ানো আব্বার স্থির মুখটা দেখে মানুষের ভিড়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। বুকের কান্না উগড়ে দিয়ে সবার সামনেই চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ পুরোটা পথ কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছি৷ এখনো আব্বার স্থির মুখটা চোখে ভাসলেই চোখ আমার ভিজে যায়৷
আব্বার বুকের এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছিলেন, আব্বার হার্ট (হৃদয়) স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে অনেক বড় হয়ে গেছে৷ যদিও এটা ছিল তার অসুখ তবুও বাস্তবে আব্বার হৃদয়টা সাগরের মতোই বিশাল ছিল৷ মানুষের প্রতি সৌজন্যতা ও ভালোবাসাটা আব্বাই আমাদের শিখিয়েছিলেন৷ আজও মানুষের ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে আছি৷
আব্বা খুব পান খেতেন৷ তার ঠোঁটের কোণায় সব সময় লাল পানের পিক-এ ভেজা থাকত৷ সাদা দাঁড়িতেও পানের পিক মেখে থাকত৷ এ জন্য মাকে দেখতাম আব্বার সঙ্গে খুব রাগারাগি করতেন৷ আব্বার ঢোলা পাঞ্জাবির বুকের কাছেও জায়গায় জায়গায় সব সময় পানের পিকের লাল দাগ মেখে থাকত৷ মা সব সময় সেই লাল দাগে চুন দিয়ে সাদা বানানোর বৃথা চেষ্টা করতেন৷ মা বলতেন চুন দিলে দাগ মিলিয়ে যায়৷ যদিও আমি কখনো লাল দাগ মিলে যেতে দেখিনি৷ আব্বার চেহারা যখন চোখে ভাসে, তখন লাল পানের পিকে ভেজা ঠোঁট, বুকের কাছে পানের পিকের লাল দাগটাও বাদ যায় না৷ আব্বার শিয়রের জানালার চৌকাঠও ভেজা পানের পিকে লাল হয়ে থাকত৷ চৌকাঠ এখনো লাল হয়েই আছে, শুধু আব্বা চলে গেছেন৷
আব্বার মূলত শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল৷ আব্বার ঘরটাকেই আমি ও আমার বড় ভাই ছোটখাটো হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছিলাম৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধপত্র থেকে শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিনসহ স্টেথিস্কোপ ও প্রেশার মাপার মেশিন সব প্রস্তুত থাকত৷ শীতকালের তিনটা মাস মূলত আব্বার জন্য কঠিনতম মাস ছিল৷ আমরা যারা বাসায় থাকতাম, আব্বা সবাইকে সারা রাত জাগিয়ে রাখতেন৷ প্রচণ্ড কষ্ট পেতেন শ্বাসকষ্টে৷ মাঝে মাঝে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালেও নেওয়া হতো৷ গরমের দিনগুলোতে তিনি ভালোই ছিলেন। আসছে শীতে শ্বাসকষ্টের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করবেন তার একটা মানসিক প্রস্তুতিও হয়তো নিচ্ছিলেন৷ সব দুশ্চিন্তা কাটিয়ে সৃষ্টিকর্তা তাকে রোজার মাসেই নিজের কাছে ডেকে নিলেন৷
আব্বা যখন সুস্থ ছিলেন তখন সবার সঙ্গেই তিনি ধমক দিয়ে কথা বলতেন৷ সব সময় হুমকি-ধমকি টাইপের কথা বলার একটা ঝোঁক ছিল৷ হয়তো পৃথিবীর সকল বাবারই এটা একটা স্বপ্রবণতা৷ সময়ের সঙ্গে বয়সের ভারে তার হুমকি-ধমকিও হারিয়ে যেতে থাকে৷ বিদেশ থেকে মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম, আব্বা কি আজকে কাউকে ধমক দিয়েছেন? যদি মা বলতেন, না বাবা সে চুপ করে বসে থাকে, কিচ্ছু খাইতে চায় না, তখন খুব দুশ্চিন্তা হতো৷ ভয় পেয়ে যেতাম৷ আবার অনেক সময় মা নিজেই ফোন করে আব্বার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন, তোর আব্বা আজকে ঘরে তাণ্ডব বাঁধিয়ে বসেছে। আমাকে ধমক দিয়েছে, একে ধমক দিয়েছে, তাকে বকা দিয়েছে৷ মায়ের কাছে আব্বার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে মন খারাপ করার অভিনয় করে মাকে সান্ত্বনা দিতাম ঠিকই, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে চিৎকার করে বলতাম যাক আমার আব্বা যথেষ্ট সুস্থ আছেন৷
আব্বা চলে যাওয়ার পর দেশে-বিদেশে অনেকেই সান্ত্বনা দিয়েছেন বা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ যদিও তারা ভালো করেই জানেন এ সান্ত্বনা দেওয়ার মতো নয়৷ কথায় আছে, যার চলে যায় সেই বোঝে হায় বিচ্ছেদের কি যন্ত্রণা৷ বিচ্ছেদর যন্ত্রণা আসলে যার যায় সেই বোঝে৷
আশাহত হইনি, মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই একদিন হয়তো আব্বার সঙ্গে দেখা হবে৷ সেদিন হয়তো বেশি দুরে নয়৷ তখন থাকবে না আমার-আব্বার বয়সের ব্যবধান। থাকবে না কোনো দূরত্বের ব্যবধান। থাকবে না আব্বার শ্বাসকষ্ট। থাকবে না আব্বার অক্সিজেন সিলিন্ডার। থাকবে না আব্বার ওষুধের বাক্স। থাকবে না পাঞ্জাবিতে পানের পিকের লাল দাগ৷ হাস্যমান ঠোঁটের কোণেও থাকবে না কোনো পানের পিকের লাল দাগ৷ একই ঘরে নয়তো প্রতিবেশী হব আমি আর আব্বা৷ আব্বা, তোমায় যে অনেক বেশি ভালোবাসি৷

মাহবুব মানিক: সায়েন্টিফিক রিসার্চার, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি৷