প্রবাসে ঈদে আছে শুধু একটা অজানা দুঃখ-কষ্ট

লেখক ও তার সহধর্মিণী
লেখক ও তার সহধর্মিণী

‘ওঠ বাবা, গোসল করে নামাজ পড়তে যা। সবাই রেডি হয়ে গেছে!’

কত দিন যে মায়ের এই সোহাগমাখা ডাক শুনতে পাই না, সেটাও আজ মনে পড়ছে না। সেই কবে দেশ ছেড়েছি। তারপর আর মায়ের সেই মধুর ডাক ঈদের দিনের প্রভাতে শুনতে পাই না। প্রবাসীর জীবনে এ এক নীরব কষ্ট।
স্বদেশে মার কাছে যখন ছিলাম, কখনো অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করেছি বলে মনে হয় না। এ বছর চাঁদ রাতে কাজ থেকে এসে খেয়েদেয়ে ঘুমোনোর আগে গত বিশ বছরের মতোই মুঠোফোনের অ্যালার্ম অপশনে ঠিক ৮টাতেই অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছি। সকাল ৯টায় ঈদের জামাত। প্রবাসে চাঁদ রাতেও কাজ করতে হয়। ঈদের দিনেও প্রবাসীরা কাজ করেন।
আমি অবশ্য ঈদের দিন ছুটি নিয়েছি। বিয়ের পর থেকেই ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসবের দিনগুলোতে ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক প্রবাসীর সেটাও সম্ভব হয় না। এ এক নিদারুণ কষ্ট, সেটা বোঝার জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার দরকার হয় না!
যাক সে সমস্ত দুঃখ-কষ্টের প্রবাসীর চাপা কান্নার কথা, না হয় নাই বললাম। সকাল ৮টায় মুঠোফোনের অ্যালার্ম যথারীতি বেজে উঠল। চোখ ঘষতে ঘষতে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ অ্যান্ড ক্লিন হয়ে বেরোলাম। সকালের দরাজ গলায় ভালোবাসার সুরে সহধর্মিণীকে ডেকে একসঙ্গে ঈদের নামাজে যাওয়ার কথা বললাম। এরপর সহধর্মিণীর অনলাইন শপিংয়ের লাল গরদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, লালচে মুজিব কোর্ট আর সাদা টুপি পরে আতরের সুবাস লাগিয়ে ঈদের ওয়াজিব নামাজ আদায় করতে যাওয়ার জন্য আমি একদম প্রস্তুত।
সহধর্মিণী মিষ্টি ভাষায় জানাল, খাবার টেবিলে সেমাই-পরোটা-কফি প্রস্তুত। সঙ্গে আর একটু নিজে ঘুমোনোর আকুল আবেদন। কী আর করা!
এ সময় হঠাৎ মুঠোফোনের আওয়াজ। কে যেন ঈদের সকালে আমাকে স্মরণ করছে। ফোন ধরতেই ‘হ্যালো, পলাশ ভাই আপনার গাড়ি নেওয়ার দরকার নাই। নিচে নামুন, আমি আসছি।’ অপর পাশ থেকে আমার এক বন্ধুর গলার আওয়াজ।
কিন্তু মুশকিল হলো অন্য জায়গায়। নামাজ পড়তে যাবটা কোথায়? গত কয়েক বছর আগে এই সমস্যা ছিল না। বাঙালি কমিউনিটির একটাই ঈদের জামাত হতো। এখন কমিউনিটিতে আমাদের মধ্যে গ্রুপিং একটা ট্রাডিশনে রূপ নিয়েছে। সে যা হোক, আমার কাছে কোনো গ্রুপিং-ট্রুপিং নেই। সবাই বাঙালি। বাংলাদেশই আমার গ্রুপ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে হেলসিংকিতে দুটি ভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের উদ্যোগে ঈদের জামাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত মাসেই আমি অবশ্য অনেকের মতামত ও ইচ্ছাসাপেক্ষে একটি স্থানে বাঙালি কমিউনিটির ঈদের নামাজ করার পক্ষে প্রথম আলোর এই দূর পরবাস বিভাগের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সামাজিক ওয়েবসাইটে প্রচারণা ও প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু বিধিবাম! হয়তো ভবিষ্যতে আমার প্রত্যাশা পূরণ হবে।
ওদিকে বন্ধু আমার বাসার নিচে গেটের কাছে লেটেস্ট মডেলের টয়োটা করোলা গাড়ি নিয়ে হাজির। এখন যাইটা কোথায়? বাঙালিদের উদ্যোগে হাকানিয়েমি ও কুন্তলাতে একই সময় (সকাল ৯টা) ঈদের দুটি নামাজের আয়োজন করা হয়েছে। সময়ের ভিন্নতা থাকলে না হয় দুই জায়গাতেই নামাজ পড়তাম। এখন সেটাও অসম্ভব। বন্ধুর সঙ্গে সলাপরামর্শ সাপেক্ষে কুন্তলাতে ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম।

হেলসিংকির কুন্তলায় ঈদের নামাজে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
হেলসিংকির কুন্তলায় ঈদের নামাজে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

প্রায় পাঁচ শ বাঙালির উপস্থিতিতে আমরা ঈদের ওয়াজিব নামাজ আদায়ে প্রস্তুত। হয়তো হাকানিয়েমিতেও ঈদের জামায়াতে সমসংখ্যক বাঙালির উপস্থিতি ছিল। মানুষ বৃদ্ধির কারণে একাধিক ঈদের নামাজ হতেই পারে। কিন্তু এক হাজার বাঙালির একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করা হেলসিংকিতে কঠিন কোনো বিষয় নয়। শুধুই আমাদের ক্ষুদ্র মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হয়তো এক সময় এই প্রবাসে আমরা গতানুগতিক ক্ষুদ্র মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসব। এই প্রত্যাশা নিয়েই এগোতে চাই। যথারীতি ঈদের নামাজ পড়ে, কোলাকুলি কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে বার্ষিক ঈদের ইতি এখানেই।
এই প্রবাসে ঠিক দিকহারা অথই উত্তাল সমুদ্রে বিলাসী বিকল প্রমোদতরীর বিলাসিতার মাধ্যমে ঈদ উদ্‌যাপন আমরা করে থাকি। এখানে বাংলার ঈদগা ময়দানের ভেজা কাঁচা মাটির গন্ধ নেই। প্রচণ্ড গরমে ঘামের তীব্র উটকো গন্ধ, সুবাসিত আতরের ঝাঁজালো ঘ্রাণ আর বাংলার সেই চিরচেনা মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে ছড়ায় না। আবার হঠাৎ করে অঝোরে বৃষ্টি এসে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে শীতল করে দেওয়ার সম্ভাবনাও নেই এই ঈদগাহে। আছে শুধু একটা অজানা দুঃখ ও কষ্ট।
হয়তো কখনো টাইটানিকের মতো আমাদের এই প্রবাসী নামক দেশের মানুষের কল্পনার বিলাসী জীবনটাও সাগরের অতল গহ্বরে একদিন তলিয়ে যাবে। হয়তো কখনো কোনো দিন কেউ তার খোঁজ করবে না। প্রবাসীকালের গহ্বরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। নতুন প্রজন্মের প্রবাসীর ভাগ্যের পরিণতিও এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে হয়তো চলতেই থাকবে। হয়তো সেই কষ্টগুলো অথই সাগরের তলদেশে প্রতিনিয়তই ছটফট করতে থাকবে।
মা-বাবাও তত দিনে স্বর্গবাসী হবেন। যারা একমাত্র নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের কষ্ট-দুঃখগুলো নিজের করে ভাবতেন। এখন কেউ কি আর কখনো এই 'প্রবাসীর' খবর রাখবেন? তবে আমার আক্ষেপ অন্য জায়গায়। প্রবাসীতে কেন আমাদের মধ্যে এই গ্রুপিং, আঞ্চলিকতা, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা? প্রবাসজীবনে উৎসবগুলো যদি আমরা একতাবদ্ধ ও সর্বজনীনভাবে করতে পারি, প্রবাসজীবনে এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কি হতে পারে?