আমার প্রিয় বই

বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম বইয়ের প্রচ্ছদ
বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম বইয়ের প্রচ্ছদ

বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম বইটি আমার অনেক প্রিয় একটি বই। প্রিয় বইয়ের তালিকা দীর্ঘ হতে হতে প্রায় কয়েক পাতা হয়ে গেছে। তাই খুব সম্প্রতি পড়া এই বইটি বেছে নিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন যেকোনো শিক্ষার্থীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। প্রতিটি দিন প্রতিটি অভিজ্ঞতা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রবেশ করতে না করতেই শিক্ষানীতি নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের হল ছাড়তে বলা হলো। সেটা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২। সাড়ে তিন মাস পরে আমরা আবার ক্যাম্পাসে ফিরি।
১৯৮৩ সালে আবার একই ঘটনা ঘটল। স্বৈরাচারী সরকার নিজের জাল বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ, মেধাবী রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের বারবার রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে। স্বৈরাচারী শাসকের পদলেহী বাহিনীর হাতে জয়নাল, জাফর, বসুনিয়া, ডা. মিলন, নূর হোসেনসহ আরও অনেকের প্রাণ ঝরে যায়।
আর এই প্রেক্ষাপটে রচিত কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের বিক্ষোভ-উত্তাল দিনগুলিতে প্রেম-ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে, আবার বিরহ ব্যথারও জন্ম হয়েছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, সাবলীল ভাষায় পুরো সময়কাল তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক।
সমসাময়িক বলেই হয়তো এই বইটির ঘটনাপ্রবাহ যেন ছায়াছবির মতো আমার সামনে উঠে আসে। শওকত, মাকসুদার আর আবির—এরা যেন আমার অতিচেনা। আমরা যারা রোকেয়া হলে বা শামসুন্নাহার হলে থাকতাম, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাই। এই আন্দোলন, বৈরী সময় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছিলাম।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল ১৯৮২ সালে। মজিদ খানের শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে। মজিদ খানের শিক্ষানীতি নিয়ে শিক্ষাভবন ঘেরাও আন্দোলনে জয়নাল, জাফর, দিপালী সাহাসহ আরও অনেকেই প্রাণ হারান। পুলিশ অনেক লাশ গুম করে। ঠিক এক বছর পর আবার মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাউফুন বসুনিয়াকে হত্যা করা হয়। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আবারও রক্ত ঝরে।
রাউফুন বসুনিয়া সেই টগবগে তরুণ। রীপার বিয়েতে অনেক গল্প হলো। মোহন ভাইকে বলল—আপনাদের আর মিছিলের সামনে থাকতে হবে না। এখন আমরাই মিছিলের সামনে থাকব। সেই কথা বলার কয়েক দিন পর মিছিল নিয়ে হল থেকে বেরিয়েই গুলি খেয়ে মারা গেল রাউফুন বসুনিয়া। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় একজন প্রেমিকার চোখে জলের ধারা আমাদেরও কাঁদিয়ে ছিল।
‘বসুর কথা মনে পড়ে’—কবিতা লিখলেন মোহন রায়হান।
বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম বইটিতে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর সময়কার হল ও মফস্বল থেকে উঠে আসা তরুণদের জীবনের চালচিত্র সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। গ্রাম থেকে আসা চাষির ছেলে রাজধানীতে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে প্রেমে পড়ে কোনো ধনীর আদরের দুলালির। আর কেউ কেন যেন বিবাহিত হয়েও প্রেমে জড়িয়ে যায়। পরকীয়া থেকেও প্রেম জয়ী হয় কখনো কখনো। মানুষের জীবনাকাশ মেঘমুক্ত নয়। কখনো কখনো মেঘে ঢেকে যায়। আবার মেঘ সরে গিয়ে নীলাকাশ জেগে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কখনো কারও সাথে কথা হলে, দেখা হলে বুকের ভেতর যে দোলা লাগে তা থেকে সৃষ্টি হয় কত কবিতা। মাকসুদার রহমান কবি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। মৌটুসীর জন্য লেখে কবিতা। বড় প্রেম সব সময় কাছে টানে না দূরেও ঠেলে দেয়। মৌটুসী কাছে এলে মাকসুদারের অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে যায়। মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিয়ে লিখে যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেদিন নিহত হন সেদিন আমিও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম ঢাকার একটি কলেজে। তাই উপন্যাসের চরিত্রগুলো যদিও মফস্বলের পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছিল তবু আমি দিব্য চোখে দেখতে পাই, বুঝতে পারি তাদের অনুভূতি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই আর উপন্যাসের চরিত্ররা ভর্তি হয় বুয়েটে।
‘মজিদ খানের শিক্ষানীতি মানি না মানি না’—মিছিলে অংশগ্রহণ করে আমাদেরই বন্ধুরা। মোহন রায়হান, শ্যামল, শিমুল, ইস্তেকবাল, তানভীর, কামরুল আর মোজাম্মেল বাবুরা। জয়নালের মৃত্যু, কারফিউ জারি। হল খালি করার নির্দেশ এল। কী উৎকণ্ঠায় রাত্রিযাপন করে ভোরবেলায় ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল মনে হলে রোমাঞ্চিত হই।
নির্লজ্জ হু মো এরশাদের কবিতাপ্রেম কবি সমাজে বিভক্তির সৃষ্টি করে। মোহন রায়হানের ‘সামরিক আদালতে অভিবাসন’ আর ‘রওশন এরশাদের কাছে খোলা চিঠি’ কপি করে হাতে হাতে বিলি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মোহন রায়হানকে ধরে নিয়ে যায় সামরিক জান্তার লোকজন।
আনিসুল হক তাই গণতন্ত্র মুক্তির লক্ষ্যে মনে করেন--‘মিছিলই আমাদের কবিতা। স্লোগানই আমাদের গান। মিছিলের পদক্ষেপই আমাদের ছন্দ।’
জাতীয় কবিতা উৎসবে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, সাজ্জাদ কাদির, অসীম সাহা, মোহন রায়হান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ সকল কবিদের মিলনমেলা।
বুয়েটের ছাত্র, নবাগত কবি যে মফস্বলের খোলস ছেড়ে সদ্য ঢাকা এসে লেখাপড়া শুরু করেছে, সে কবি হওয়ার বাসনায় নিজের নামটি বাংলাদেশের বিখ্যাত কবির নামের অনুকরণে রাহমান করে নিয়েছে।
সেই সময় প্রায় সকল তরুণের স্বপ্ন ভেঙেছে। হু মো এরশাদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও উচ্চশিক্ষা নিতে আসা বাংলাদেশের লাখ তরুণের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। মাকসুদার, শওকত আর আবির হলো শুধুমাত্র উদাহরণ।
শওকতের আদর্শ স্কুলশিক্ষক বাবা তাকে যে আদর্শ দিয়ে বড় করেছেন তা মেনে শিক্ষক হওয়ার প্রচেষ্টায় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্দয় অত্যাচারে তার পা ভেঙে যায়। বুট দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে যায় ওর পা। এমন নির্মমতা অবিশ্বাস্য; কিন্তু এ রকমই ঘটেছিল। একটি স্বাধীন দেশে স্বৈরাচারী শাসক ছাত্রদের অত্যাচার করেছিল। আর আমরা ছিলাম সেই সময়ের সাক্ষী।
আমার ‘ভালোবাসার রং নীল’ আর ‘মেঘের দেশে মেঘবালিকা’-য়ও উল্লেখ আছে মধ্য ফেব্রুয়ারির সেই জঘন্য ইতিহাসের। রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে শওকতের দাঁত ভেঙে দেয়।
জীবন হচ্ছে ছক না মানা এক নদী। বয়ে চলে আপণ ছন্দে। শওকত, আবির, মাকসুদারের মনোবল তবুও ভাঙেনি। তারা প্রত্যেকে পিঠ সোজা রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বৈরাচারী শোষকের হাত থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে তরুণেরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। জয়নাল, জাফর, দীপালি, বসুনিয়া, ডা. মিলন আর নূর হোসেনরা প্রাণ দিয়ে গণতন্ত্রকে ১৯৯০ সালে মুক্ত করে।
বইটিতে এক জায়গায় লেখক বলেছেন: এক ফাল্গুন বা এক ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্রকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করতে যথেষ্ট নয়। ১৯৮২-তে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন অনেক রক্ত, অনেক হাহাকারের বিনিময়ে ৯০-এ এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
ওই সময় একটা বড় সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল খালি করতে হয়। আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে যাতে না পারে তার জন্য কারফিউ জারি, হল খালি করা, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ছিল স্বৈরাচারী শাসকের নীলনকশা।

লেখিকা
লেখিকা

কত মায়ের বুক খালি হলো। কত স্ত্রী স্বামীহারা হলো। ডা. মিলনের মায়ের মধ্য দিয়ে তিনি সকল সন্তানহারা মায়ের কান্নাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবির আর শানুর প্রেমে পড়ার বিষয়টি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে পরিচয় থেকে প্রেম, বিয়ে, বিদেশ যাত্রা, জীবন এ রকমই।
শওকতের মায়ের সোনিয়াকে বউ করে ঘরে আনার আগ্রহ শওকতকেও প্রভাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার বাসনায় স্থির থাকলেও সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকে জীবন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। রংপুরের পাড়া-গাঁ থেকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে আসে মেধাবী ছাত্র শওকত। আবির আসে বরিশাল থেকে। আর মাকসুদার রাহমান (আসলে রহমান) আসে সিরাজগঞ্জ থেকে। স্বপ্নবিলাসী মন কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রহমান থেকে রাহমান হয়ে যায়। জাতীয় কবিতা উৎসবে অংশ নিয়ে বড় বড় কবিদের সান্নিধ্য মাকসুদারের চারপাশে শুধু জোছনা ঢেলে দেয়। মাকসুদারের বুক পকেটে জমে ওঠে জোনাকি আর জোছনা। এমন চমৎকার বর্ণনা শুধু কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকই পারেন।
স্বৈরাচারের পতন আর গণতন্ত্রের অভিষেক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। দূর হ দুঃশাসন শিরোনামের কার্টুন আঁকেন শিশির ভট্টাচার্য্য আর আর্টিকেল লিখে ফেলে মাকসুদার। বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেমের চিত্রের পাশাপাশি স্বৈরাচারের ক্ষমতায়ন আর গণতন্ত্রের মুক্তির ইতিহাসও ফুটে উঠেছে। সে হিসেবে বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
চমৎকার ইতিহাস সংবলিত এই প্রেমের উপন্যাসটির জন্য কথাসাহিত্যিক আনিসুল হককে অভিনন্দন। বইটি প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায়। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন মাসুক হেলাল।