জিপিএ কম পাওয়া মানেই স্বপ্নের সমাপ্তি নয়

লেখক
লেখক

উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে কিছুদিন আগে। যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা প্রশংসার দাবি রাখেন। আর কোনো কারণে যাঁদের জিপিএ কম এসেছে তাদের জন্য আজ একটি গল্প বলা যাক।

গল্পটি আমার নিজের। দশ বছর আগে ২০০৭ সালে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। অনেক কম জিপিএ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। পরিচিত বন্ধুদের বাড়িতে যখন উৎসবের রেশ আমার বাড়ি তখন শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন। হীনমন্যতায় এতটুকু হয়ে থাকলাম। ফলাফলের পর অনেক দিন চলে গেল। কোথায় ভর্তি হব, কোন বিষয়ে পড়ব, কিছুই ঠিক করতে পারিনি।
সাধারণত বিজ্ঞানের ছাত্ররা মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি চেষ্টায় যুদ্ধে লেগে যায় উচ্চমাধ্যমিকের ফল বের হওয়ার আগে থেকেই। এ দিকে ওসব বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে ন্যূনতম যে জিপিএ থাকা বাধ্যতামূলক সেটাও আমার নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আমি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি প্রদান করতে পারা চাকরির অবসরের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া বাবার পক্ষে বেশ অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
অবশেষে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হলাম। বিষয় ব্যাচেলর অব ফার্মেসি। সবকিছু ঠিকমতো যাচ্ছিল কিন্তু পড়ালেখার প্রতি উদাসীনতার পরিবর্তন খুব একটা তখনো হয়নি। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি অনেক আগ্রহ থাকায় ল্যাব ক্লাসগুলোই আমাকে বেশি আকর্ষণ করত। পত্রিকায় দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের গবেষণার খবর পড়ে খুব অনুপ্রাণিত হতাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কয়েক সেমিস্টার পার হওয়ার পর থেকে ঝুঁকে পড়লাম গবেষণার দিকে।
সিনিয়রেরা যখন প্রজেক্টের কাজ করতেন ল্যাবে, তখন তাঁদের টেস্টটিউব ধুয়ে দেওয়া এক্সপেরিমেন্টের রিএজেন্ট জোগাড় ইত্যাদি ফুটফরমায়েশ খাটার ছুতোয় শিখতে কিংবা দেখতে যেতাম কী করে তাঁরা ব্যাবহারিক কাজগুলো করেন। পঞ্চম সেমিস্টারের পর থেকে অল্প অল্প করে বুঝতে শিখি কীভাবে ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট করে সেটা জার্নালে রিসার্চ পেপার হিসেবে প্রকাশ করতে হয়। তখন থেকেই মূলত গবেষণার হাতেখড়ি। কয়েকজন বন্ধু মিলে তৈরি করলাম গবেষণার ছোট একটি দল (দলের সবাই এখন বিভিন্ন দেশে পিএইচডি করছেন)।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম এবং শেষ করেই বুঝতে পারলাম বাস্তব জগতে পদার্পণ সবে শুরু। ওই সময়টা ছিল জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময়। ঠিক কী করব কিংবা কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একাডেমিক রেজাল্টতো কখনোই আহামরি ভালো ছিল না। তারপরও একটা স্বপ্ন খুব দেখতাম—দেশের বাইরে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাব। বড় কোনো ল্যাবে গবেষণার করব।
তখনকার বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এটা ছিল আমার জন্য অনেকটাই আকাশ-কুসুম কল্পনা। তখন বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খোঁজার পাশাপাশি IELTS ও GRE নিয়ে খাটাখাটি শুরু করলাম। সেই সময়টায় আমার অর্থনৈতিক সহায়তা বলতে ছিল কেবল বাসা থেকে পাওয়া প্রতিদিনকার নির্দিষ্ট কিছু হাত খরচের টাকা। অনার্স শেষে ওই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়া ছিল যেকোনো তরুণের জন্য ভয়াবহ রকমের অস্বস্তিদায়ক।
এই দীর্ঘ অস্বস্তির ভেতর থেকেই আমি আমার স্বপ্ন দেখে গেছি ক্রমাগত। এর ভেতর ছোটখাটো একটা চাকরি মিলে যায়। মূলত দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের চেষ্টার পাশাপাশি চাকরিটা করছিলাম। ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে প্রফেসরদের অনেক ইমেইল করতাম। কিন্তু বেশির ভাগ ইমেইলে কোনো রিপ্লাই পেতাম না। তখন অফিসে গিয়ে প্রতিদিন আমার প্রথম কাজ ছিল অনেক আশা-ভরসা নিয়ে ইমেইল চেক করা। যদি কোনো প্রফেসর রেসপন্স করেন। এভাবে কাটতে থাকে সময়। প্রতিদিনকার মেইল চেকের পর কিছুটা হতাশ হই। পরক্ষণেই আবার নতুন উদ্যমে আরও বেশি বেশি চেষ্টা করি।
বিশেষ সেই সময়টি ছিল ২০১৩ সালের অক্টোবরে। দক্ষিণ কোরিয়ার চোসান ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর তাঁর ল্যাবে আমাকে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ইমেইল করেন। ল্যাবের কাজ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেখে আনন্দে আত্মহারা আমি। প্রফেসরের চাহিদা মোতাবেক সিভিসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদি পাঠাই। এর কিছুদিন পরে ভর্তি, স্কলারশিপ ও ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র হাতে পেয়ে যাই। অবশেষে ব্রেন কোরিয়া রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে ফার্মেসিতে মাস্টার্স করার সুযোগ মিলল। স্বপ্নের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া!
দক্ষিণ কোরিয়া এসে শিখেছি কীভাবে একাগ্র চিত্তে কাজে ডুবে থাকতে হয়। শিখেছি নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও কাজের প্রতি ভালোবাসা। খামখেয়ালি আর উদাসীন জীবনের পরিবর্তন এখান থেকেই। আগের সকল আলস্যতা ঝেড়ে কঠোর পরিশ্রমে মনোনিবেশ করেছি গবেষণায়। দুই বছর শেষে ভালো ফলাফল নিয়ে মাস্টার্স শেষ করি। ভালো জার্নালে নিজের রিসার্চ পেপার প্রকাশ করি। কোরিয়া ও কোরিয়ার বাইরে অনেক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করি। মাস্টার্স শেষ হওয়ার ছয় মাসের মাথায় ফুল স্কলারশিপ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়াতে পিএইচডি শুরু করি। বর্তমানে আমি গবেষণা করছি Austarlian Center for Research on Separation Science (ACROSS)-এ। আইসিইউতে চিকিৎসারত রোগীদের রক্তে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা মাইক্রোফ্লুডিক্স টেকনোলজি ব্যবহার করে অল্প সময়ে বের করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছি।
ব্যক্তি জীবনের কাঠখড় পোড়ানো এই গল্প কেবল একটি উদ্দেশ্যেই বলা। তোমরা যাতে স্বপ্ন দেখতে কখনোই ভুলে না বসো। কেবল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল কখনোই একজন শিক্ষার্থীর সমগ্র শিক্ষাজীবনের চিত্র নির্ধারণ করতে পারে না। কঠোর পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস, কাজের প্রতি ভালোবাসা ও একাগ্রতা স্বপ্নের পথে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান ও মূল পথ প্রদর্শক। যে যা নিয়ে একটুখানি স্বপ্ন দেখেছিলে, সে বিষয়ে শক্ত হাতে হাল ধরার সময় এখনই। কিংবা যদি লক্ষ্য অনির্ধারিত থেকে যায় তবে এখনই ভেবে নাও নিজের কাছ থেকে কী চাও তুমি। ভালোবাসা সকলের প্রতি।

*মো. ফখরুল ইসলাম (মঞ্জু): পিএইচডি গবেষক, অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর রিসার্চ অন সেপারেশন সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।
ফেসবুক: <www.facebook.com/monju.pharma>