কোরিয়ার প্রথম বিপ্লবী নারী ননগে

নাম নদীর পাড়ে ননগের পোর্ট্রেট
নাম নদীর পাড়ে ননগের পোর্ট্রেট

কোরিয়ার নাম নদীর তীর ঘেঁষে চোকসিয়েঙ্গু প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ জলসাঘর। সন্ধ্যা নামলেই সেখানে বসত নাচ-গান আর মদের আসর। আসরের মধ্যমণি জেনারেল কিমুরা রক্সু। হঠাৎ করেই তাঁর চোখ আটকে গেল নর্তকী দলে থাকা অষ্টাদশী সুন্দরী ননগের ওপর। ননগেকে নিয়ে আসা হলো জেনারেল রক্সুর সামনে। ননগেকে কাছে থেকে দেখে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়ার বাসনা জেনারেল রক্সুর আরও তীব্র হলো। রক্সু ননগেকে একান্ত সান্নিধ্য পেতে চান।

ওদিকে ননগেও এ রকম সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ননগে তখন জেনারেলের গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে একটু নির্জনে যেতে বললে, তাতে জেনারেলের সায় মিলল। ননগে তখন জেনারেল রক্সুকে নিয়ে চোকসিয়েঙ্গু প্যাভিলিয়ন থেকে অল্প দূরে নদীর তীরে একটা নির্জন জায়গায় গেলেন। নদীর তীরে রাখা একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে ননগে জেনারেল রক্সুকে আলিঙ্গনের আহ্বান করলে রক্সু ছুটে গিয়ে ননগের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হন। খুব শক্ত করে ননগেকে জাপটে ধরেন।
ননগের দুই হাতের দশ আঙুলে পরা ছিল দশটি আংটি। যা অনেকটাই অ্যাংকরের মতো কাজ করে। জেনারেল রক্সু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ননগে তাঁকে বাহুবদ্ধ অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে দুজনেরই মৃত্যু হয়। এটি আসলে কোনো নাটক বা সিনেমার দৃশ্য নয়। এটা ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে জাপানিদের হাতে কোরীয় জোসন রাজবংশের পতনের সময়কার ঘটনা। প্রায় চার শ বছর ধরে ননগের এই আত্মত্যাগের কাহিনি কোরীয়দের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে রয়েছে।

নাম নদীর তীর ঘেঁষে চোকসিয়েঙ্গু প্যাভিলিয়ন বা জলসাঘর
নাম নদীর তীর ঘেঁষে চোকসিয়েঙ্গু প্যাভিলিয়ন বা জলসাঘর

১৫৯০ সালে তোয়তোমি হিদোয়সি জাপানের রাজা হওয়ার পর পরই বেশ কয়েকবার কোরিয়াকে শাসন করার জন্য আক্রমণ করেন। তখনকার দিনে কোরিয়ার শাসনক্ষমতা ছিল জোসন রাজবংশের হাতে। ১৫৯২ সালে প্রথমবারের মতো জাপানি রাজা হিদোয়সির বাহিনী কোরিয়া উপদ্বীপ আক্রমণ করে ইমজিন যুদ্ধে জোসন রাজবংশকে পরাজিত করে কোরিয়া দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৭ লাখ সামরিক ও বেসামরিক কোরীয় নিহত হয়। হঠাৎ করেই জাপানিদের অত্যাচারে অনেকটাই শান্তিপ্রিয় কোরীয়দের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ননগের আত্মত্যাগের কাহিনি ঠিক ওই সময়কার।
দেশের শাসন কাজ পরিচালনার জন্য কোরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় জোসন রাজবংশের দুর্গ ছিল। এর মধ্যে নাম নদীর তীরে ছিল সিয়ং দুর্গ। এখান থেকেই জিনজুসহ অন্যান্য অঞ্চলের শাসন কাজ পরিচালিত হতো। রাজ্যর প্রজারা জোসন রাজবংশের ওপর অনেকটাই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের ওপর নেমে আসে ক্ষমতা লোভী জাপানিদের অনভিপ্রেত আক্রমণ। পরাধীন নিরীহ কোরীয়দের ওপর চলতে থাকে নির্মম অত্যাচার।
ননগের স্বামী চই ইমজিন যুদ্ধে নিহত হন। দেশের পরাধীনতা ও স্বামীর মৃত্যু কোনোটাই সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। অপরদিকে দখলদারদের অত্যাচারের মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এমন একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে রেখেছে যে, কেউই প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছে না।

এই পাথরের ওপর থেকে ননগে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন
এই পাথরের ওপর থেকে ননগে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন

ননগে সীমিতভাবে অনেকের সঙ্গেই আলাপ করে একত্রিত করার চেষ্টা করে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু একটা তাঁকেই করতে হবে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও পরাধীন জাতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? ননগে তখন চিন্তা করলেন বড় জেনারেলকে হত্যা করতে পারলে অন্তত বিষয়টা ভীতসন্ত্রস্ত কোরীয়দের অনুপ্রাণিত করবে, যা প্রতিবাদের সাহস জোগাবে।
বড় জেনারেলরা সব সময় দুর্গের ভেতরে থাকেন। তেমন একটা বাইরে বের হন না। ননগে তাঁর স্বামীর চাকরির সুবাদে অনেকবার দুর্গে গেছেন। দুর্গের সবকিছুই তাঁর কাছে পরিচিত। তিনি দুর্গে ঢোকার পরিকল্পনা করেন। কঠোর নিরাপত্তার কারণে অনেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি দেখেন প্রতিদিনই সন্ধ্যায় দুর্গের ভেতর চোকসিয়েঙ্গু প্যাভিলিয়নে নাচ-গানের আসর বসে। তখনই নর্তকী দলের মেয়ে হয়ে দুর্গে ঢোকার বিষয়টা তাঁর মাথায় এল।

সিয়ং দুর্গে ননগে স্মরণে মেলা চলাকালে নাম নদীর একটি দৃশ্য
সিয়ং দুর্গে ননগে স্মরণে মেলা চলাকালে নাম নদীর একটি দৃশ্য

কিন্তু এর জন্যতো আবার নাচ শিখতে হবে। ওই দলে ঢোকার জন্য নর্তকী দলের সর্দারনিকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালেন। খুবেই অল্প সময়ের মধ্যেই নাচ শিখে ফেললেন ননগে। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করলেন। অবশেষে এল কাঙ্ক্ষিত দিন। এমনিতেই ননগে দেখতে অনেক সুন্দর ছিলেন। নাচের পোশাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। দশ আঙুলে পরে নিলেন দশটি আংটি। দলের অন্য মেয়েরা ননগের প্রতিজ্ঞার কথা কিছুই জানতেন না।

লেখক
লেখক

ননগে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করেন। তাঁর এই আত্মদান তখনকার দিনে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল আমার সঠিক জানা নেই। তবে তাঁর এই ত্যাগের স্ফুলিঙ্গ এখনো কোরীয়দের উজ্জীবিত করে। নতুন প্রজন্মের কাছে ননগেকে পরিচিত করার জন্য প্রতি বছরই নাম নদীর তীরে সিয়ং দুর্গে ননগে স্মরণে মেলা বসে। নাম নদীতে ভাসানো হয় প্রদীপ। ননগের পোর্ট্রেট রয়েছে নাম নদীর পাড়ে। যে পাথরের ওপর থেকে ননগে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন, তা এখনো রয়েছে অক্ষত।

*মো. কামরুজ্জামান মিলন: পিএইচডি ফেলো, গিয়নংসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া। ইমেইল: <[email protected]>