কালাম স্যার ও একটি গ্রামের কান্না

লেখিকা
লেখিকা

কান্নারা কূল ভেঙেছে আরও সাত রাত আগে। এপাশ-ওপাশ করে ঘুম যখন সুদূর পরাহত, প্রিয়তম বলল, ব্রেইন স্ট্রোক? আমি বলি, হুম। সিভিয়ার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ভালো হয়ে যাবে স্যার।

বাংলাদেশের বুকের বোঁটা থেকে ছিঁড়ে আসা আমি জানি, এই সকল সান্ত্বনার ছলনা। বাংলাদেশ থেকে বিষাদের ট্রানজিটে করে দূরদেশে আসা দুর্ঘটনার খবরের পরে এখানকার স্বজন–প্রিয়জনদের এটাই হলো নিরুপায় সান্ত্বনা। কিন্তু কেউ না জানুক আমি তো জানি, শান্ত দেখা এই আমার ভেতরটা শান্ত হয় না। তার ভেতরেই বয়ে যায় অশান্ত ভাঙন। কেউ জানে না, কী করে কাচের মতো করে টুকরো টুকরো করে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয় প্রিয়জনদের সান্নিধ্য। কেউ জানে না, তার কতটা জুড়ে থাকে সুখে অসুখে কাছ থেকে স্বজন–পরিজনদের দেখতে না পারার বিহ্বলতা। সাতটা দিন ধরে চলছি–ফিরছি। ক্লাস। ক্লিনিক্যাল ল্যাব। ব্যস্ততা। কিন্তু বুকের ভেতরের যে হাহাকার তাকে না যাচ্ছে ফেরানো না যাচ্ছে মানানো।
আমাদের রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের আবুল কালাম আজাদ স্যার। আমাদের মুগ্ধতা মাখা ব্যক্তিত্বের তালিম দেওয়া রাজাধিরাজ আজ কথা বলছেন না। নিশ্বাস আছে, তবু নিথর। আমাদের স্যার আজ আর ক্লাসে ঢুকে ব্ল্যাকবোর্ডে ব্ল্যাকবোর্ডে ছড়িয়ে দিতে পারছে না রোমান্স। শিক্ষকের সহজাত রোমান্সও যে শিক্ষা, জীবনকে শৈল্পিকভাবে যাপনের সুগন্ধি, এই শিক্ষা তিনিই তো প্রথম দিয়েছেন আমাদের।
মফস্বলের ছোট্ট একটা গ্রামে আর্থিক অসংগতি থাকা ছাত্রদের তিনি আলতো স্বরে ডেকে কানে কানে বলতেন, ‘বিকেলবেলা মাঠে সময় না দিয়ে আমাকে সময় দিলেই তো পারিস! কাল থেকে চলে আসিস। পড়াব তোকে।’
অসহায় ছাত্রের চোখের করিডরে আর্থিক অস্বচ্ছতা তার মতো করে কয়টা শিক্ষক দেখেন, এই সমাজে?
মফস্বলের ছোট্ট একটা গ্রাম রহমতপুর আজ থই থই কান্নাতে ভাসছে। শিক্ষার্থী–অভিভাবক সবার ভাবনাতে আজ একজন আবুল কালাম আজাদ স্যার। সেই স্যার, আমাদের সেই স্যারের আজ নির্বাক চোখ। কাউকে চিনছেন না। এত ভালো পড়াতেন তিনি! পড়ালেখাও যে আনন্দের, তার মতো করে আর কে করাবে অনুধাবন? কজন শিক্ষকের সুস্থতার জন্য যে যার মতো মসজিদ–মন্দির, বুকের কাবায়, মক্কার কাবায় বিধাতার কাছে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি স্যারের জন্য তার শিক্ষার্থীরা আজ পাগলপ্রায়। কাঁদছে অঝোরে। যে যার মতো করে ছুটে যাচ্ছে হাসপাতালে। স্যারের বাড়িতে। পাগলের মতো যোগাযোগ করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা তার হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা।
এমন দেখে স্যারের বুক ভরে যাওয়ার কথা হাসির কোলাহলে।
আমাদের সেই স্যার আজ হাসছেন না। ক্লাসের অবসরে চকে আঁকা ফুল রাখতাম আমরা স্যারের জন্য। সেই ফুল দেখে মৃদু হাসি ঝরত স্যারের। এর ভেতরেই শেখাতেন ইংরেজি Fool বাংলা ফুল। তিনি আমাদের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন যে! কিন্তু কী এক অশনি সংকেত। কোন কারিগর যেন জীবন ঝরার পরিকল্পনা করছে। আমরা সইতে পারছি না!
স্যার আজ হাসপাতালের আইসিউর বিছানা থেকে উঠে মনোবল হারানো আমাদের শাসন করছেন না। বলছেন না, অনেক হলো! যা এবার। স্যারের শাসন মাখা কথাগুলো যে কথা ছিল না, কখনো কখনো বারুদও ছিল। স্নেহকে কখনো দুর্বলতা ভেবো না। বলেছিলেন তার এক ছাত্রকে। অভ্যস্ত হয়ে পড়া সাফল্যের চূড়া থেকে যেবার ছিটকে পড়েছিলাম, আলতো স্বর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন—‘সিংহাসনে ফিরে আসো’। সেই একটা বাক্য একটা জীবন ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
স্যার আজ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে নিস্তেজ। হাত ধরে শব্দ শেখানো, বাক্য গঠন শেখানো আমাদের কালাম স্যার আজ শব্দ গঠন করে কথা বলতে পারছেন না। অবজারভেশনে ১২০ ঘণ্টারও বেশি পেরিয়ে গেছে। আমাদের স্যার এখনো বুঝতে পারছেন না, তার অসংখ্য শিক্ষার্থী কতটা আকুল হয়ে আছে একটু সাড়া দেওয়ার অপেক্ষায়।
স্যারের মেজর অপারেশন আজ কালকের মধ্যেই। মেডিকেল বোর্ডের মতে চূড়ান্ত ভয় আছে। হাই রিস্ক। আমাদের বুকে আজ ব্যথার চূড়া। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা অপেক্ষার পাহাড় শুধুই চেয়ে আছে স্যারের ফিরে আসা দেখতে। স্যার গো, আপনি ফিরে আসেন। আমরা আবার আপনার পা ছুঁতে চাই। আপনার মতো এমন মানুষ একটা গ্রামে কয়টা আসে, বলেন? আপনি আবার কথা বলেন। তীব্র সুন্দর সেই সব ভঙ্গিতে আবার আমাদের বলেন, আচ্ছা! পুরা রহমতপুর গ্রাম গত সাত দিন কেন কাঁদছিল বলত একটু, শুনি।

জাহান রিমা, ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।