শিক্ষার আলোর দিশারি আমাদের সবার প্রিয় হেড স্যার

মুহাম্মদ তজম্মুল আলী
মুহাম্মদ তজম্মুল আলী

আমাদের সবার জীবনেই কিছু কিছু মানুষের ভূমিকা এমন যে, সেটা কখনোই অস্বীকার করা তো দূরের কথা, ভুলে যাওয়াও যেন দুষ্কর। আমার জীবনে তেমনি একজন মানুষ ছিলেন আমাদের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ তজম্মুল আলী। আমরা সকল ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে হেড স্যার বলেই ডাকতাম। বাস্তবে তাঁর ছাত্র ছাত্রীরাই শুধু নয়, আমাদের এলাকার সকল মানুষই তাঁকে হেড স্যার বলেই ডাকতেন ও চিনতেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবন এতটাই সুদীর্ঘ যে তিনি একই পরিবারের বাপ, ছেলে, নাতি মানে তিন জেনারেশনের হেড স্যার ছিলেন বলে শোনা যায়।

আমরা যখন সেই স্কুলের ছাত্র তখনই শুনতাম হেড স্যারের অবসরে চলে যাওয়ার কথা। বয়স হলেও তাঁকে দেখে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। দেখতে ছোটখাটো শরীরের গড়ন, আমাদের হেড স্যারের শরীর স্বাস্থ্য ছিল খুব ভালো। বয়স যেন তাঁর জীবনের কোনো একটা বাঁকে এসে থেমে গেছে। তবু সময়ের ধারা এমন, জীবনের ভারের কাছে নত হয়ে যেতে হয় মানুষের। একেবারেই যখন আর পাঠদান সম্ভব ছিল না, তখন বছর কয় আগে হেড স্যার নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবসরে চলে যান।
কিছুদিন আগে খবর পেলাম আমাদের সবার প্রিয় হেড স্যার এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। খবরটা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। স্যারের সঙ্গে শেষ আমার কবে দেখা হয়েছিল ঠিকমতো মনেই করতে পারছি না। ১২ থেকে ১৪ বছর আগে হবে, তখন আমি বুয়েটে ইইই ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করি। একবার কোনো এক ছুটিতে সিলেটের বিশ্বনাথে আমাদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়। সেই চিরায়ত মিটিমিটি চাহনি। স্যারের দুই চোখ সারাক্ষণই মিটিমিটি করে পলক ফেলতে থাকত, সরাসরি চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলতেন। সুতীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি দিয়েই যেন পড়ে ফেলতে পারতেন একজন মানুষকে।
অনেক অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। সবকিছুর খবরাখবর নিলেন। আমার জীবন, আমার সংসার, আমার কর্মক্ষেত্র, সব বিষয়েই কথা বললেন। বুয়েটের শিক্ষক হয়ে কী অনুভূতি, ছাত্রছাত্রী পড়াতে, গবেষণা করতে কেমন লাগে, ইত্যাদি আরও নানা কথাবার্তা। প্রায় সব কথাবার্তার মাঝেই বলে উঠলেন একটি কথা, আমি জানতাম তুই একদিন অনেক বড় হবি, জীবনে এমন পর্যায়ে যাবি, দোয়া করি জীবনে আরও বহুদূর যা, আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর। আমাদের হেড স্যার সব সময় তুই তোকারি করেই কথা বলতেন।
সেদিন কথাবার্তার একফাঁকে মৃদু হেসে হেসে বললেন (আমাদের সিলেটী ভাষায় অবশ্যই), তুই বাক্কা বড় বেটা হই গেছস এখন (সমসাময়িক কালের সকলকে ছাড়িয়ে বুয়েটে পড়ালেখা করে এখন সেখানে শিক্ষকতা করি, জীবনে অনেক উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন)। স্যার ঠিক এমনিভাবেই কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে সেই ছাত্রজীবনেও। আমাকে এই কথাটা বলে আসলে স্যার নিজেই গর্ববোধ করছিলেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। নিজেকে দেখতে চেয়েছেন আমাদেরই মাঝে, আমাদের সফলতার মাঝে। একজন শিক্ষকের জীবনে বুঝি এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া! বলাবাহুল্য, আমাদের হাইস্কুল থেকে সমসাময়িক কালে এবং আমার জানামতে এখন পর্যন্ত আমিই তাঁর একমাত্র ছাত্র, যে কিনা মাধ্যমিকের পর নটর ডেম কলেজ, তারপর বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম নিজ যোগ্যতাবলে। আর আমার সেই যোগ্যতার ভিতটা গড়তে অনেকের মাঝে আমাদের হেড স্যারের অবদানটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ছাত্রজীবনে বহু শিক্ষক পেয়েছি, তাঁদের শিক্ষার সান্নিধ্যে এসেছি। একজন শিক্ষার্থীর জীবনে সফল হওয়ার পেছনে তার সকল শিক্ষকেরই ভূমিকা থাকে, কিছুটা কম আর কিছুটা বেশি। তবে আমি আমার পুরো ছাত্রজীবনে দুজন শিক্ষকের নাম আলাদা করে বলতে পারি যাদের সঙ্গে আমার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছাড়িয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা-সন্তানের এবং সর্বোপরি বন্ধুর সম্পর্কের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাঁদের একজন হলেন আমাদের হাই স্কুল ‘রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চবিদ্যালয়, বিশ্বনাথ, সিলেট’-এর শ্রদ্ধেয় এবং সবার প্রিয় হেড স্যার।
স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে তাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের তরে। জীবনের ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘোরে, চোখ বন্ধ করেই যেন দেখতে পাই ফেলে আসা সেই সব সুমধুর দিনগুলো। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় আগের কথা। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চবিদ্যালয়, সিলেট জেলার অন্তর্গত আমাদের বিশ্বনাথ থানার একমাত্র এবং সবচেয়ে ভালো হাইস্কুল। আমরা প্রাইমারি শিক্ষা শেষে বিশ্বনাথের এই হাইস্কুলে সবে এসে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। আমি এসেছি এক অজপাড়া গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুল থেকে।
নতুন স্কুল, নতুন বন্ধুবান্ধব, কিছুটা স্বাধীনতার ছোঁয়া, সব মিলিয়ে দিনগুলো তখন খুব রঙিন। ক্লাসে সারাক্ষণ হই হুল্লোড়, দৌড়ঝাঁপ, আমরা বেঞ্চের ওপর দিয়ে লাফালাফি করে বেড়াই। একদিন তেমনি হই হুল্লোড়ের আর হাঙ্গামার মাঝে আমাদের ইংলিশের ক্লাসে বেঁটে মতন একজন মানুষ এসে হাজির। কোনদিকে না তাকিয়ে, আমাদের চিল্লাপাল্লার মধ্যেই সরাসরি ডায়াসের ওপর উঠে আসলেন। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর ওপরে সাদা সার্ট, অনেকটা পাঞ্জাবির মতো। উনি আমাদের ইংলিশের শিক্ষক না, আমরা কেউই বুঝতে পারিনি উনি কে। আমরা সবাই মিলে তাই চিল্লাচিল্লিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিই। তার মধ্যে কে একজন যেন ফিসফিস করে চুপি চুপি বলে উঠল, হেড স্যার। আমরা দৌড়ঝাঁপ থামিয়ে যে যেমনে পারি পড়িমরি করে কোনোরকমে বেঞ্চে এদিক-ওদিক করে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। শুধু সিলিং ফ্যানের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া ক্লাসে আর কোনো শব্দ নেই। সেদিনই আমি প্রথম আমাদের হেড স্যারকে দেখি।
তিনি এসেছিলেন আমাদের ইংলিশের স্যারের প্রক্সি দিতে। পরে শুনেছি, হেড স্যার এ রকম যখন-তখন যেকোনো ক্লাসে প্রক্সির নাম করে চলে যেতেন এবং ক্লাস নিতেন। আমার ধারণা, স্যার স্বচক্ষে দেখতে চাইতেন কোন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা, ইত্যাদি। কর্মক্ষেত্রে হেড স্যারের দক্ষতা ও দূরদর্শিতার এমন উদাহরণ ছাত্রজীবনে আরও বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি।
প্রক্সি দিতে এসে সেটা যে ক্লাসই হোক না কেন, হেড স্যার সব সময় ইংলিশের ক্লাস নিয়ে নিতেন। পরবর্তীতে স্যারের আরও কাছাকাছি এসে জেনেছি হেড স্যার ছিলেন ইংলিশে প্রচণ্ড তুখোড়। আমার হাইস্কুল জীবনে সেই ছোটবেলায় স্যারের কাছ থেকে এমন কিছু ইংরেজি শব্দ শিখেছিলাম যেগুলো আমেরিকায় আসার আগে যখন জিআরইর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনো কাজে লেগেছিল। তখন আবারও হেড স্যার কোন লেভেলের ঝানু মেধাবী ছিলেন সেটা ভেবে মাথা হেঁট হয়ে যেত।
সেদিন হেড স্যার তাঁর স্বভাবচরিত মিটিমিটি হেসে আমাদের ইংলিশের ক্লাস নিলেন। কোনো বই নেই, কোনো চোথা নেই, হাসি হাসি মুখে আমাদের কিছু ইংরেজি শব্দ, কিছু গ্রামার, কিছু বাংলা-টু-ইংরেজি জিজ্ঞেস করলেন। ক্লাসের বাকি সব ছাত্র নীরব, আমিই শুধু স্যারের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলাম। মনে হয়েছিল যেন, স্যার আর আমি ক্লাসের মধ্যে কথাবার্তা বলে যাচ্ছি ইংরেজিতে। দ্রুতগতিতে ক্লাসের সময় শেষ হয়ে গেল। যাওয়ার সময় স্যার শুধু আমাকে বলে গেলেন, তুমি তো ইংলিশে খুব ভালো। ঠিকমতো পড়ালেখা করো। বলে হনহন করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা বন্ধুরা যেই কী সেই, স্যার চলে যাওয়া মাত্র আবার চিল্লাপাল্লা করে ক্লাসে বাজার শুরু করে দিলাম।
এর কিছুদিন পর একদিন স্কুলের পিয়ন এসে ক্লাসে হাজির। জিজ্ঞেস করল, খায়ের কে? হেড স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। সেদিনের পর থেকে হেড স্যার আমার পড়ালেখার প্রতি আলাদা নজর রাখা শুরু করে দেন। তিনি ছিলেন তীব্র দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। আমার মধ্যে সুপ্ত একটুখানি মেধার সন্ধান পেয়েছিলেন কিনা, সেইটুকু মেধাকে প্রজ্বলিত করতে ওনার নিরন্তর প্রয়াসের সেই শুরু। তিনি ছিলেন এমনি মানুষ, শিক্ষার আলোর দিশারি। আমার আগে (এবং আমার ধারণা, আমার পরেও) এমনি অনেক শত শত ছাত্রের মাঝের সুপ্ত প্রতিভাকে নিরন্তর চেষ্টা আর পরিশ্রম দিয়ে তিনি প্রজ্বলিত করেছেন। তাঁর হাজার হাজার ছাত্র তাঁর সেই নিঃস্বার্থ শিক্ষা আর অধ্যবসায়ী হাত ধরেই জীবনে সফল হয়েছেন, যে যার জায়গায় এখন আছেন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে।
হেড স্যার আমার পড়ালেখার সরাসরি তত্ত্বাবধান করেছিলেন সেই ক্লাস সিক্স থেকে। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা, তারপর এসএসসি পরীক্ষা, ইত্যাদির জন্য আমার চেয়ে দেখতাম স্যারের চিন্তা বেশি। হেড স্যারের খুব ইচ্ছা, আমাদের স্কুল থেকে কেউ একদিন বোর্ডে স্ট্যান্ড করবে। স্যারের কথা আমাকে দিয়ে সেটা হবে। আর তাই বুঝি আমার পেছনে স্যারের এত শত মূল্যবান সময় ব্যয় করা। ম্যাথ, সায়েন্স, ইংলিশসহ সব সাবজেক্টের স্যারদের আপ্রাণ চেষ্টা, আমাকে আলাদাভাবে পাঠদান। সবারই একই কথা হেড স্যারের মতো, খায়ের, তুই চেষ্টা কর, স্ট্যান্ড করতে পারবি।
দুর্ভাগ্য যে, বোর্ডে স্ট্যান্ড আমি করতে পারিনি। হেড স্যারের মুখ উজ্জ্বল করা তাই আমার আর হয়ে ওঠেনি। আমাদের এসএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে বিশতম মেধাস্থানের নম্বর ছিল ৮৫৭, আমার থেকে ৭ নম্বর বেশি। আমি এসএসসি-তে ৮৫০ নম্বর পেয়ে আমাদের স্কুলের সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করলেও বোর্ডে মেধাস্থান অর্জন করতে পারিনি। এসএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়, সাত নম্বরের জন্য স্ট্যান্ড করতে পারিনি, সেটা ভেবে আমার মন মোটেই খারাপ হয়নি, মন খারাপ হয়ে ছিল এই ভেবে যে, হেড স্যার হয়তো কষ্ট পাবেন। অথচ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে রেজাল্টের দিন স্যার ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে স্যারের রুমে গিয়ে দেখি মিষ্টি, সবাইকে ডেকে এনেছেন আর মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, সেই একই কায়দায় (অবশ্যই সিলেটী ভাষায়), কিরে মন খারাপ করেছিস? মন খারাপ করিস না, আরও বহুদূর যেতে হবে তোকে। মনে রাখিস, এসএসসি মাত্র একটা পরীক্ষা, মাত্র তোর জীবনের শুরু। যেসব ভুল হয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। স্যারের চোখের কোণে কী একটুখানি জল এসেছিল, ঝাপসা হয়ে এসেছিল দৃষ্টি! এখন আর ঠিক মনে নেই।
জানি, একটি লেখায় আমাদের হেড স্যারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার ছাত্রজীবনে তাঁর অবদান, স্মৃতির কথা কখনোই ভুলবার নয়। আমাদের বিশ্বনাথের হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীর জীবনে একটি স্মৃতিময় চন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে স্যারের চিরন্তন উপাখ্যান।
প্রায় দেড় যুগ আগে আমার বাবা যখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন কেমন যেন একটা শূন্যতা, একটা একাকিত্ব, একটা না-জানা অবসন্নতা বাতাসে ভেসে এসে এই নিস্তেজ কায়ায় ক্ষণে ক্ষণেই নাড়া দিয়ে দিয়ে যেত। আজ এতগুলি বছর পরে কেন যেন সেই একই বাতাস একই কায়দায় অনুভূতিগুলোকে আবারও নেড়ে দিয়ে যায়-একাকী, আমার অজান্তে।

বাপ্পী খায়ের: ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র। লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।