জার্মানির নির্বাচন বনাম বাংলাদেশের নির্বাচন

নির্বাচনী পোস্টার
নির্বাচনী পোস্টার

আমাদের দেশে একটা রীতি আছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয় আউলিয়াদের মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে। জার্মান দেশে নির্বাচনকে ঘিরে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে যাওয়ার ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই আমার গল্পের শুরু করতে চাই জিয়ারত ছাড়াই।

গত দুই সপ্তাহ ধরে জার্মানির রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী পোস্টার। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রার্থীর ছবির সঙ্গে পোস্টারে নেই কোনো প্রতীকের ছবি। তবে কোনো কোনো প্রার্থীর পক্ষ থেকে পোস্টারে ছোট করে স্লোগান লেখা আছে বা প্রার্থীর ছবিবিহীন শুধুই স্লোগানও আছে। কোনো কোনো পার্টির আছে বিভিন্ন কৌশলমূলক স্লোগানও। সেই স্লোগানে দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশকে নিয়ে কার কি চিন্তা-পরিকল্পনা আছে বা জার্মানিকে তারা কেমন দেশ হিসেবে গড়তে চান তার ইঙ্গিত আছে।
নির্বাচন অফিস থেকে বাসায় সবার চিঠি এসেছে। চিঠিতে উল্লেখ করা আছে কবে কত তারিখ নির্বাচন। কোথায় গিয়ে ভোট প্রদান করতে হবে এবং ভোট প্রদানের সময়সূচি ইত্যাদি। সবার চিঠি এলেও আমার জন্য আসেনি কোনো চিঠি। কারণ জার্মানিতে আমি এখনো ভোটার হইনি। তাই ভোটার লিস্ট নাম ওঠেনি। ভোট প্রদান করতে অবশ্যই জার্মান নাগরিক হতে হবে।
আমি একটি ছোট্ট শহরে থাকি। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে কোথাও নেই কোনো আলাপ-আলোচনা বা মিছিল-মিটিং। আর বড় বড় শহরে নির্বাচনী সভা-মিছিল যাই হচ্ছে তাও বদ্ধ ঘরে। রাজপথে গাড়ি-ঘোড়া ঠিক আগের মতোই চলছে—নিয়মিত গতিতেই ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। এমন শান্ত পরিবেশ! মনে হবে জার্মানরা রাজনীতি জানেই না।
ডান দল, বাম দল, সবুজ দল—মোট ছয়-সাতটি প্রধান দল নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে জার্মানির জাতীয় নির্বাচন। ফলাফল জানানো হবে পরদিন ২৫ তারিখে। দল ও প্রার্থীরা যে যার মতো করে একটু-আধটু প্রচারণা চালাচ্ছেন ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এতে সাধারণ জনগণের নেই কোনো বিশেষ চাওয়া।

নির্বাচনী পোস্টার
নির্বাচনী পোস্টার


জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা স্লোগানে প্রাধান্য পাচ্ছে পরিবার, নিরাপত্তা আর বেকারত্ব একদম কমিয়ে আনার মতো বিষয়। জার্মানির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এর চাইতে বেশি তথ্য আমার কাছে নাই। গল্পের শুরুতেই বলেছি নির্বাচনকে ঘিরে নেই কোনো আলাপ-আলোচনা। তো তথ্য পাব কই!
প্রায় এক যুগ ধরে প্রবাসে থাকি। দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটার হওয়ার পর ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়েছে জীবনে একবার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যাকে ভোট দিয়েছিলাম সেই ব্যালট পেপারে সিলসহ ক্যামেরাবন্দী করেছিলাম। জীবনের প্রথম ভোট। পরে প্রার্থীকে দেখিয়েও ছিলাম সেই ছবি। প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভও করেছিলেন এক ভোটে। আমার ধারণা আমার ওই ভোটেই তিনি জিতেছিলেন।
দেশের জাতীয় নির্বাচনে ছোটবেলা থেকেই বাপ-চাচাদের দেখেছি লাঙল-লাঙল বলে স্লোগান দিতে। লাঙলের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র ইত্যাদি বলে। দেশ ডিজিটাল হলো। দেশে মাড়াই আর হালচাষের ডিজিটাল মেশিনও এল কিন্তু আমাদের এলাকার আসনে এখনো লাঙলই রয়ে গেছে। লাঙলই জনপ্রিয়।
দেশে আমাদের গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই ভালো। বাড়ির সামনেই মহাসড়ক। কিন্তু আমাদের পিছের গায়ের লোকজনদের বড়ই বিপদ। বছরের ছয় মাসই নৌকায় করে যাতায়াত করতে হয়। আর বাকি ছয় মাস নদীর পানি একটু কমে গেলে সাঁকো বসানো হয়। গ্রামবাসীর একটাই চাওয়া—একটা সেতু চাই। আমার ক্যালেন্ডার হিসাবে গত বিশ বছরে ধরে কত নেতা এলেন-গেলেন। দিলেন কত প্রতিশ্রুতি, কিন্তু আজও ওই গ্রামবাসীর আশা পূরণ হয়নি।

লেখক
লেখক


দেশে নির্বাচনকে ঘিরে সবার মাঝে একটা আলাদা আমেজ থাকে। সবার মুখে মুখে থাকে নির্বাচনী আলোচনা। অনেক সময় প্রার্থীর পক্ষ থেকে চা-নাশতার ব্যবস্থাও থাকে। নির্বাচনে সবাই হাসি খুশি। সে যেন এক উৎসব!
একবার এক প্রার্থী মিষ্টান্ন খাওয়ার জন্য আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। বললেন, আমার জন্য দোয়া করবেন। দোয়া আমি কেমনে করব, তখনতো আমি ভোটারই হইনি!
একদিন এক নির্বাচনী মিছিলে গিয়েছিলাম। প্রার্থীর নাম ছিল সুফিয়ান আর মার্কা ছিল আনারস। মিছিলের শেষে ছিল খাওয়ার আয়োজন। ছোট ছোট পলিথিন ব্যাগে। এলাকায় আমরা বলে থাকি চার আনার ব্যাগ। ব্যাগের তলায় কয়েক মুষ্টি পোলাও। আনারসের পক্ষে মিছিল দিতে দিতে নির্বাচনী এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তখনকার ১৫ বছরের আমি ১৫ কিলোমিটার দৌড়ে যে ক্ষুধা পেয়েছিলাম, ওই কয়েক মুঠো পোলাও খেয়ে পেট খুশি হয় কি করে। আরেক ব্যাগের জন্য হাত বাড়িয়ে যে ধমক খেয়েছিলাম তা আজও ভুলিনি।
আমার ভোট আমি দেব। সুযোগ করে না দিলে কেমনে দেব? জার্মান দেশের নাগরিক নই বলে এই দেশে ভোট দিতে পারব না। প্রবাসে থাকি বলে সময় সুযোগে দেশে গিয়েও ভোট দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক দেশের নাগরিকেরা আছেন তারা দুনিয়ার যেখানেই থাকেন না কেন, তারা তাদের ভোট প্রদান করতে পারেন। এমনকি দুনিয়ার বাইরে থেকেও।
পৃথিবীর দেশে-দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি। ভোটের মাধ্যমে আমাদের মতামত প্রদান করার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

নাঈম হাবিব: উল্ম, জার্মানি।