প্রবাসীর ত্যাগের ঈদ

লেখক ও অন্যান্য
লেখক ও অন্যান্য

ঈদুল আজহা মানেই হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্যাগ বা বিসর্জন দেওয়া। আর এই ত্যাগ স্বীকারে প্রবাসীরাই এগিয়ে। গতকাল (২ সেপ্টেম্বর) সিঙ্গাপুরে ঈদের পরদিন আর বাংলাদেশে ঈদের দিন ডিউটি থেকে ফিরে দেখলাম আমার রুমমেট পারভেজ উবু হয়ে শুয়ে আছে। হালকা নড়াচড়ায় বুঝলাম সে জেগেই আছে। ঈদের নামাজের পর থেকে সে এভাবেই শুয়ে ছিল। আজও এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম হয়তো সে অসুস্থ। তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পারভেজ শরীর-স্বাস্থ্য ভালো তো? একটু নড়াচড়া করে পারভেজ জবাব দিল, হ্যাঁ ভাই ভালো। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

‘হায়রে, জীবন আমার! বাড়িতে পোলাও-মাংস খাওয়ার মানুষ নেই আর আমি এখানে আলু ভর্তা আর ডিম বাজি দিয়ে ভাত খাই।’

এই কথাটা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি পারভেজ ভাত খাচ্ছে আর স্বগতোক্তি করছে। আমি পাশেই বসে একটি মজার বই পড়ছিলাম। আমার অবসর সময় বেশির ভাগ কাটে বই আর পত্রিকা পড়ে। পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছি না। তার আলু ভর্তা, পোলাও-মাংস কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। বই পড়া বন্ধ করে তার পাশ ঘেঁষে বসলাম। তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ভাইয়া কি দিয়ে ভাত খাচ্ছ! পারভেজ দুই ঠোঁটে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল, এই যে আলুর ভর্তা আর ডিম ভাজি। জানেন আমার বাড়িতে পাতিল ভর্তি নানা পদের খাবার রান্না করে রেখেছে, কিন্তু খাবারের মানুষ নাই।

আমি পারভেজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। যদিও একই রুমে থাকি অনেক দিন যাবৎ। আসলে প্রবাসে একই রুমে একই সঙ্গে থাকলেও দু-একজন ছাড়া বাকি সবার সম্পর্কে জানা খুবই দুরূহ। কারণ সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। খুব ভোরে ডিউটিতে যাও, আবার সন্ধ্যায়, অনেক সময় রাত ১১টায় বাসায় ফেরা। রান্না করা, খাওয়া, বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলা এভাবেই কেটে যায় দিন। একজন আরেকজনের অতীত সম্পর্কে জানার সময় নাই। বর্তমানই ঠিকমতো জানা হয় না।

—তোমার ভাইবোন কয়জন? পারভেজকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
—ভাইবোন নাই আমি একাই। মুখের ভাত গিলতে গিলতে জবাব দিল পারভেজ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বিদেশে। তাহলে তার বাবা-মা আসলেই খুব দুঃখী। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলাম।
—বাড়িতে কে কে আছে?
—মা-বাবা।
সংক্ষিপ্ত জবাব।
—বাড়িতে কথা হয়েছে আজ।
—সকালে মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। আর কথা বলার পর থেকেই মন খারাপ। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সকালে মা কি বলেছে জানেন ভাই।
আমি চুপ করে তার কথা শুনছি, কিছু বললাম না।
পারভেজ নিজেই নিজেই আবার বলতে লাগল। মা বলল বাবা তুই নাই তাই চিন্তা করছি আজকে রান্না করব না। তোরে ছাড়া ঈদ ঈদের মতো লাগে না। আর কোরবানির মাংসও খাব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুই খাবি। তোর ওখানে কেউ গেলে জানাইস। আমি কোরবানির মাংস পাঠাব। তুই যেদিন খাবি সেদিন আমিও খাব। তুই না খাওয়া পর্যন্ত আমি কোরবানির মাংস ছুঁইব না।
দেখলাম পারভেজের দুই চোখে পানি। সে জামার হাতায় চোখের পানি মুছে বলল মায়ের এই কথা শোনার পর আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। কি জবাব দিব বলেন। মায়ের ভালোবাসা যে কি তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। তাই সারা দিন না খেয়ে শুয়ে ছিলাম।
আমি বললাম এখন বাড়িতে ফোন দিয়ে খবর নাও। তোমার মা হয়তো এখনো না খেয়ে আছেন।
পারভেজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখের ভাতটা গিলে পানি খেয়ে মোবাইল হাতে নিল কল করার জন্য।
আমি বললাম, থাক খাবার পরই ফোন দিয়ো।
পারভেজ বলল, না ভাই এখনই ফোন দিই, দেখি মা খেয়েছেন কিনা। বলেই পারভেজ কল দিল। ওপাশে রিং হচ্ছে। সে লাউডস্পিকার অন করে কথা বলছে। দুজনের কথোপকথন আমি শুনতে পাচ্ছি। পারভেজ মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। একপর্যায়ে ওর মা জানতে চাইল, বাবা ভাত খেয়েছ?
পারভেজ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, হ মা খাচ্ছি।
তার মা জানতে চাইলেন ছেলে কি তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। এই প্রশ্নে পারভেজ থতমত খেয়ে গেল। একপলক আমার দিকে আরেক পলক খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, মা আমি পোলাও, মাংস, মাছ আর ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। ওর জবাব শুনে ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা! পারভেজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ভেঙে তার মা বলল, কেন মিথ্যে বলছিস আমার সঙ্গে! তুই আমাকে পেটে ধরেছিস নাকি আমি তোকে পেটে ধরেছি। আমি জানি তুই কি দিয়ে ভাত খাচ্ছিস। আমার এ বিদেশ করা লাগবে না, তুই দেশে চলে আয়।
তার মা আর কিছু বলতে পারলেন না। মনে হচ্ছে মা কাঁদছেন। পারভেজের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ফোনের লাইনটা কেটে দিয়ে পারভেজ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জন্যই ভাই বাড়িতে ফোন দেই নাই। বাড়িতে কোনো উৎসব হলে মা ফোন দিয়ে এভাবে কাঁদে আর আমিও তার সঙ্গে কেঁদে ফেলি।
আমি বললাম, ভাই তুমি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। তোমার বিদেশ থাকা মানায় না।
পারভেজ চোখের পানি মুছে বলল, আমি কেন এখানে পড়ে আছি সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আপনি কেন এখানে একাকী পড়ে আছেন সেটাও আমি জানি না। যার যার প্রবলেম সেই বোঝে।
ইংরেজিতে প্রবাদ আছে—‘The wearer best known where is shoes pins’. আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু বললাম, তারপরও তোমার মা আছে। আমার তো তাও নেই। যিনি আমার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলবেন। ফোন দিয়ে কি খেয়েছি তা জিজ্ঞেস করবেন।
আমার কথা শুনে পারভেজ তার দুঃখ ভুলে দুই ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ঈদ মোবারক ভাই।
কথার মোড় ঘুরে যাওয়ায় আমিও হেসে জবাব দিলাম, ঈদ মোবারক।

এম ওমর ফারুকী (শিপন): সিঙ্গাপুরপ্রবাসী।