দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা

সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে ডিন ও পিএইচডি অধ্যাপকের (ডানে) সঙ্গে লেখক
সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে ডিন ও পিএইচডি অধ্যাপকের (ডানে) সঙ্গে লেখক

আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় এসেছি ২০১১ সালের আগস্ট মাসে। আমার ডিগ্রি প্রোগ্রাম ছিল কম্বাইন এমএস পিএইচডি। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করি। দীর্ঘ দিন কোরিয়ায় থাকায় অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর কিছু আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

কেন দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা? আমাদের সবারই স্বপ্ন থাকে উচ্চশিক্ষার জন্য উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ অথবা অস্ট্রেলিয়ার ডিগ্রি নেওয়া। কিন্তু কেন এই সব দেশ বাদ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে বেছে নেওয়া। এর অনেকগুলো উত্তর হতে পারে। প্রথমেই বলে রাখি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের গবেষণা খাতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, কোরিয়ান টেকনোলজি ও লাইফ স্টাইলও কোরিয়ায় আসার অন্যতম কারণ। যদিও ভাষাগত কিছু সমস্যা থাকে। তবে কোরিয়ায় আসার জন্য সব চেয়ে যে ফ্যাক্টর কাজ করে তা হলো ভালো স্কলারশিপ (টিউশন ফি‍ ‍+ থাকার খরচ)। যে কারণে শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম জবের কথা একদম চিন্তা করতে হয় না। একজন অধ্যাপকের ফান্ড পাওয়াটাও কিন্তু একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ওপর নির্ভর করে। তাই কোরীয় অধ্যাপকেরা ভালো প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নিয়ে থাকেন। যেমন আমার ল্যাবে কোরীয় শিক্ষার্থী আছে দুজন। আর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আছে চারজন।

কোরীয় শিক্ষার বর্তমান অগ্রগতির পরিসংখ্যান দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
<www.topuniversities.com/system-strength-rankings/2016utm_source=Facebook&utm_medium=SMPost&utm_campaign=QS+Higher+Education+System+Strength+Rankings#sorting=rank+custom=rank+order=desc+search=>

সম্প্রতি Nature News Feature-এ দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণা নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত করা হয়। পড়তে নিচের লিংক ক্লিক করুন:
<www.nature.com/news/why-south-korea-is-the-world-s-biggest-investor-in-research-1.19997>

সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক
সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক

কোরীয় অধ্যাপক

কোরীয় অধ্যাপকদের নিয়ে সবারই একটা নেগেটিভ ধারণা থাকে। যদিও অনেকে এ ব্যাপারে বিপরীত মত পোষণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আমি বলব এটা যেকোনো দেশই হতে পারে, এমনকি আমেরিকা কিংবা ইউরোপের যেকোনো ল্যাবে। আমার পরিচিত অনেকই আছেন যারা অস্ট্রেলিয়া অথবা ইউরোপ গিয়ে অধ্যাপকের আচরণ ভালো না হওয়াতে আবার ফিরে এসে কোরিয়া অথবা জাপানে ডিগ্রি নিচ্ছেন।
আমার পরামর্শ হলো আপনি যদি কোরিয়াতে আসতে চান তবে ল্যাব ও অধ্যাপক সম্পর্কে ভালো করে জেনে আসুন। দরকার হলে সময় নিন। এখন ইন্টারনেটের যুগে যেকোনো ল্যাব নিয়ে জানা খুব কষ্টের কিছু নয়। কমপক্ষে যদি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বাঙালি থাকেন তার মাধ্যমেও খোঁজ নিতে পারেন। এখন ফেসবুকে এ সব দেশের শিক্ষার্থীদের গ্রুপ থাকে। তারাও আপনাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। দরকার কেবলমাত্র আপনার ইচ্ছে ও প্রচেষ্টা।
অনেকে অভিযোগ করে থাকেন কোরীয় অধ্যাপকেরা আসার পর টাকা ঠিকমতো দেন না। এ ক্ষেত্রে আমি বলব কোরিয়ায় আসার আগে অধ্যাপকের সঙ্গে সবকিছু ক্লিয়ার করে আসবেন। এতে লজ্জার কিছু নেই। একজন অধ্যাপক তার ল্যাবে কতজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেবেন তা তার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা থাকে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেওয়াটা নির্ভর করে অধ্যাপকের ফান্ড ও তার ল্যাবের অবস্থার ওপর।
আর আপনি যে ল্যাবে আসতে চান সেই ল্যাবে যদি কোনো বাঙালি থাকেন আর তিনি যদি আপনার জন্য সুপারিশ করেন তাহলে আপনার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায় (যদি আপনি ওই ল্যাবের জন্য যোগ্য হয়ে থাকেন)। তবে এ ক্ষেত্রে আপনাকে স্পষ্টভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। কারণ আপনার জন্য কেউ সুপারিশ করলেন, কিন্তু আপনি এলেন না। এতে যিনি আপনার জন্য সুপারিশ করেছেন তিনি অধ্যাপকের কাছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন। ঠিক একইভাবে আপনিও বাঙালিদের ব্যাপারে অধ্যাপকের কাছে একটা খারাপ নজির সৃষ্টি করলেন।
কোরীয় অধ্যাপকেরা সাধারণত ফ্রেশ অনার্স করা স্টুডেন্ট চান। কারণ তারা চান একজন শিক্ষার্থী তার ল্যাবে যেন দীর্ঘ সময় ধরে থাকেন (৫-৬ বছর)। তাই এখনকার অধ্যাপকেরা কম্বাইন এমএস পিএইচডি ডিগ্রি প্রোগ্রামের জন্য শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে বলে থাকেন। তবে আপনি যদি শুধু এমএস করতে চান তাহলে আসার আগেই অধ্যাপককে এটা বলে রাখবেন। অনেকে আবার কোরিয়া আসার পর কম্বাইন ডিগ্রি এমএসে পরিবর্তন করে থাকেন।

কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সনদ গ্রহণ করছেন লেখক
কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সনদ গ্রহণ করছেন লেখক

ল্যাবের পরিবেশ

কোরিয়ায় ল্যাবের ওয়ার্কিং সময়টা একটু বেশি। এখানকার অধ্যাপকেরা মনে করেন চাপ দিলে সবই সম্ভব। কেউ সহ্য করতে পারেন কেউ পারেন না। এটাও আপনার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আপনাকে এটা বলতে পারি কষ্টের ফল সব সময় মধুর হয়, শুধু আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে।

কোরিয়ায় ডিগ্রির সময়কাল

সাধারণত এমএস ডিগ্রির জন্য ২ বছর লাগে। পিএইচডি ৩-৪ বছর। কম্বাইন এমএস পিএইচডি ৫-৬ বছর পর্যন্ত সময় লাগে।

নমুনা সংগ্রহকালে ল্যাবের সহকর্মী ও অধ্যাপকের সঙ্গে লেখক
নমুনা সংগ্রহকালে ল্যাবের সহকর্মী ও অধ্যাপকের সঙ্গে লেখক

কোরিয়ায় এমএস ডিগ্রি

আপনারা অনেকে হয়তো উচ্চশিক্ষার জন্য উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ অথবা অস্ট্রেলিয়ার ডিগ্রি নেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আপনাকে সে ক্ষেত্রে ছোট একটা উপদেশ দিতে পারি। আমি উলসান ইউনিভার্সিটিতে (University of Ulsan) আছি। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ডিগ্রি শেষ করেছেন তাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী পিএইচডি করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তারপর আছেন কানাডা ও আমেরিকায়। ইউরোপে আছেন বেশ কয়েকজন। যারা কোরীয় এমএস পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করে অন্য যেন যেকোনো দেশে আবেদন করে থাকেন না কেন, ওই সব অধ্যাপকদের কাছে আপনার মূল্য আছে। কারণ তারা জানেন আপনি ল্যাবে কতটা পরিশ্রম করতে পারেন।
সব শেষে বলতে চাই, স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আপনাকে সাহসী হতে হবে। অবশ্যই সাফল্য আসবে। ধৈর্য ধরতে হবে আর চেষ্টা করে যেতে হবে। সবার সফলতা কামনা করছি।

ড. সাহেদ উদ্দীন আহমেদ (সজীব): রিসার্চ প্রফেসর, উলসান বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ কোরিয়া।