সহজ মানুষ

চট্টগ্রামের গোলপাহাড় থেকে রিকশা করে দেওয়ানহাট যাচ্ছি। শিল্পকলার সামনে আসতেই সহকর্মী সাইফুল ভাই রিকশা থামিয়ে বললেন, ‘সামনে হেঁটে যাওয়া বয়স্ক লোকটা আমার পরিচিত। উনি লালখান বাজার যাবেন। পারলে ওনাকে একটু পথে নামিয়ে দেন!’ লোকটার কাছে গিয়ে রিকশা থামিয়ে বললাম, আপনি তো লালখান বাজার যাবেন। আমার সঙ্গে চলুন। তিনি বললেন, ‘না বাবা, আমি হেঁটে যেতে পারব।’ পরে সাইফুল ভাই এসে বললেন, ‘দাদা উঠে পড়ুন। উনি আমার কলিগ। আপনাকে লালখান বাজারে নামিয়ে দেবেন।’ সাইফুল ভাইয়ের অনুরোধে তিনি রিকশায় উঠলেন। আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি কয়েক বাক্যে আমার পরিচয় দিলাম। তারপর তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর নাম মিলন কৃষ্ণ তালুকদার। বাসা মতি ঝরনা। প্রবর্তক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাঁর সহধর্মিণীও একটি স্কুলের শিক্ষিকা। প্রতিদিন এই পথে হেঁটে যাতায়াত করেন। হাঁটলে নাকি শরীর ভালো থাকে।
প্রবর্তক স্কুলের নাম শুনে আমি থমকে গেলাম। প্রবর্তক অনাথ আশ্রমের অনাথ ছেলেরাই মূলত এই স্কুলে পড়াশোনা করে। আমি ওনাকে জানালাম, আমার বন্ধু সুজন আর প্রকাশ প্রবর্তক স্কুলের ছাত্র ছিল। সুজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনে মাস্টার্স করে বড় একটি চাকরি করে। আর প্রকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেছে। আপনি ওদের চেনেন?
ছাত্রদের পরিচয় পেয়ে লোকটার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আমার অনেক ছাত্র অনেক বড় বড় জায়গায় আছে। সবাইকে মনে রাখতে পারিনি। তুমি ওদেরকে আমার নাম বলবে। ওরা আমাকে অবশ্যই চিনবে।’
ততক্ষণে রিকশা লালখান বাজার মোড়ে এসে থামে। রিকশা থেকে নেমে লোকটি ভাড়া দিয়ে দিতে চাইলেন। আমি ভাড়া না নিয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি আমার হাত ধরে টেনে কপালে চুমু দিলেন। বললেন, ‘তুমি আমার ছেলের মতো। তোমার জন্য আশীর্বাদ।’ আমি আশ্চর্য হই। আমার বাবা কখনো এভাবে আমার কপালে চুমু খেয়েছেন কি না আমার মনে নেই! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে রাস্তা পার হয়ে লোকটা মতি ঝরনার দিকে হাঁটতে থাকেন। আমার রিকশা চলতে থাকে বিপরীত পথে। রিকশার পেছনের পর্দা তুলে আমি অদ্ভুত মানুষটার চলে যাওয়া দেখতে থাকি। আমার কপালে একটি স্নিগ্ধ চুমো নিয়ে ভাবতে থাকি, সহজ মানুষটা আমার বাবার মতো!
শুভাশীষ, চট্টগ্রাম।