অল্পস্বল্প গল্প

তিন পরিবার
তিন পরিবার

আল আইন থেকে বেড়ানোর আহ্বান আজকের নয়। বলতে বলতে এখন তারা হয়রান। এবার আমরাই বলি, আসছি! আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা পূর্বা শিক্ষাক্ষেত্রে হলজীবন শুরু করবে। উর্নিশা তারই সমবয়সী। দুজনের বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলা থেকে। এক যুগ আগে ওরা একসঙ্গে নেচেছে ‘আমরা সবাই রাজা’। প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক, স্কাইপ কিংবা ইমো মাধ্যমে যোগাযোগ আছে তাদের। তারপরও দুই বন্ধুকে এক জায়গা করে দেওয়ার দায়িত্বটুকু মা-বাবার ওপরই বর্তায়। সেভাবেই আল আইন যাওয়া।

দুই পরিবারের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। আগে তারা আবুধাবিতে থাকতেন। এখন আল আইন গেলেও যোগাযোগটা আছে। সেটার বড় কারণ হয়তো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ করি। সংগঠনকে ধরেই আমরা আমাদের এই ভালো লাগার কাজগুলো করতাম। এখনো ধারাটা অব্যাহত আছে। আমরা ডাক দিলে তারা আসেন।
উত্তম হাওলাদার নিয়ে যান সেদিন বাস স্ট্যান্ড থেকে। গাড়ি থেকে নেমে দেখি, বাড়ির দরজা আগেই খুলে রাখা। সেখানে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ঊর্মি মজুমদার দাঁড়িয়ে। সে এক অন্য রকম দৃশ্য! মেয়েরা একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে, মায়েরাও তাই। শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা বিনিময় হয়। এরপর সুযোগ বুঝে এদিক-ওদিক বেড়াই।
রাতের রূপ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। জাখের লেক পাড়ে গেলে সেই সুযোগ কিছুটা খুলে যায়। বসার জায়গাও জুটে যায়। যাত্রী ছাউনির মতো একটা ঘর। মধ্য রাতের আগন্তুক আমরা। বসে পড়ি। কিন্তু না, সবাই যেতে চায় সামনে। মাদুর বের করা হয়। হাঁটতে হাঁটতে যাই লেকের পাড়ে। আমার হাত ধরে এগিয়ে নেয় এরিন। আমাকে নয় শুধু, সে আরও কয়েকজনকেই সাহায্য করে। প্রায় অন্ধকার। তবে চার-পাঁচটা মোবাইলের আলো পথিকের যাত্রাকে সহজ করে দেয়।
একেবারে পানি ছুঁই ছুঁই লেকের পাড়। মাছ নেই হয়তো। বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারতের মানুষেরাই সে সব সাবাড় করেছে! মুক্ত হাঁসের চলাফেরা থাকলেও আমাদের চোখে পড়েনি। রাতে সেটা পড়ার কথাও নয়। তবে এও জানলাম, হাঁস আসলেই উধাও। দূরে দেখি জেবেল হাফিতের চূড়া। আমরা দেখছি ওপরে সমতলের বৃত্তাকার এলাকা। বড় একটা থালার মতো। ভালোই লাগছে। কাশ বন আমাদের ঘিরে আছে। কল্পনায় ছবি এঁকেছিলাম, একটানা ঝিঁঝি পোকার শব্দ আসবে কানে। আমরা আড্ডা দেব। সেটা মেলেনি। তবে এ কথা ঠিক, গল্প করার জন্য মন্দ নয় এ পরিবেশ।

ঊর্মি, উল্কা ও ইংকিং
ঊর্মি, উল্কা ও ইংকিং

বিলের পাড় দিয়ে ছোটবেলায় হেঁটেছি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে দূরত্ব বাড়াতে চাইনি। এতটুকু ধৈর্যই বা আছে কার? পরনের প্যান্ট নেংটি করে সোজা নেমে গিয়েছি জলে। সে দলে কখনো সাত-আটজনের কম হতাম না। আমরা পৌঁছে গিয়েছি অন্য পাড়ে। সেই বিলের সঙ্গে এই লেকের মিল আছে। আবার পার্থক্যও আছে।
সেখানে নাড়ার ওপর দিয়ে পানির ভেতর হেঁটে গিয়েছি। ভুর ভুর কাদায় পা ডুবে যায়নি। এখানে নাড়ার অস্তিত্ব নেই। সেখানে কচুরি ছিল। কচুরির ধাপের মধ্যে পানকৌড়ি বাসা বাঁধত। আবার কচুরি পচে গেলে তার ওপর এক সময় বেড়ে উঠত লাউয়ের গাছ। কৃষক তা বেচে পেত কাঁচা পয়সা। ছিল পদ্মফুল। অবশ্য পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আর টিকে থাকতে পারেনি। দুই পাশে ছিল পুকুর। সেখানে পানি থাকত সারা বছর। এখানেও আছে তেমন গভীর জলাশয়।
নিষ্প্রদীপ মহড়া দিই তিন পরিবারের দশ সদস্য। মোবাইলগুলো বন্ধ রাখা হয়। উপভোগ করি অন্ধকার আর এর নিস্তব্ধতা। ইতিমধ্যে অন্ধকারও কমে আসে। ভুঁইফোড় আলোরা কিছু দৃশ্য দেখাচ্ছে। শকুনের ডাকও শুনিনি। কিন্তু কথায় আসে সে বর্ণনা। ঊর্মি গানের মানুষ। এতে কেন যে তার এত আগ্রহ বুঝতে পারিনি। প্রহরে প্রহরে ডাক। শ্রীকান্তের সেই রাতের কথা মনে পড়ে।
রাত্রির এ রূপ পৃথিবীর কাদা মাটি, বন জঙ্গল, নদী সৈকত, পাহাড় পর্বত প্রভৃতি থেকে একেবারেই আলাদা। কালো নীলিম আকাশতলে পৃথিবী জোড় আসন করে বসে আছে। আর সমস্ত বিশ্ব চরাচর তারই অটল শান্তি রক্ষা করে। দেখতে দেখতে সৌন্দর্যের তরঙ্গ খেলে যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমন একটি প্রেক্ষাপটে দারুণ সাহসের কথা বলেছিলেন। কোন মিথ্যাবাদী প্রচার করেছে—আলোরই রূপ আছে, অন্ধকারের রূপ নেই। আমরা কথাশিল্পীকে স্মরণ করি।
আসে অল্পস্বল্প গল্পের পালা। এবার ঊর্মি হাওলাদারই গল্পের সূত্রটি উসকে দেন। সেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। উল্কা হালদার বলেন, এখন হবে স্কুল পালানোর গল্প। এ নিয়ে এক গল্প আমিই শুনিয়েছি। বাড়ি থেকে স্কুলের নাম করে বের হয় একদল দস্যি ছেলে। পথে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে তারা। সময় কাটায় আত্মগোপনে। মানুষ যায় পথ বেয়ে। ওরা দেখে, ভয় পায় পাছে জেনে ফেলে। এইভাবে কতক্ষণ আর! একপর্যায়ে ‘কু’ শব্দ কানে যায় পথচারীর। কে, কেরে...বলে চিৎকার করে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায়। ওরা দৌড়ে পালাবে কি, এসে পড়ে ভোলা কাকার সামনে। বগলে বই সবার। সেদিন ওদের পরিণাম কি হয়েছিল তা অন্য কেউ না জানলেও আমি জানি।
বিকো চৌধুরী। সাতক্ষীরার গ্রামে জন্ম। সিনেমা দেখতে গিয়েছেন দল ধরে। প্রথম অভিযান তার। নিচের ক্লাসের ছাত্র তখন। এ জন্য ঘটনাটি ঘটে গোপনে, খুবই সন্তর্পণে। কিন্তু এ খবর তার বাবার কানে চলে যায়। বাড়ি থেকে সহজে বেরোলেও ফিরে আসার হিম্মত ছিল না। আমগাছের ডালে কাটিয়েছিলেন সারা দিন। তারপর বৃদ্ধা ঠাকুরমার অভয় দানে নিচে নামেন। ইংকিং মিটি মিটি হাসেন। এ হাসি হালকা আলোতেই অন্যদের চোখে পড়ে।
উত্তম কুমার বেড়াতে যান নিকটতম আত্মীয়ের বাড়িতে। বাড়ির সমবয়সীদের সঙ্গে হাফ প্যান্ট পরা বালক উত্তম যান স্কুলে। টিকাদান চলছিল সেদিন। দরজার সামনে টেবিল নিয়ে বসা ছিল টিকাদার। তার সঙ্গে স্যারেরা। লং জাম্পের অনুশীলন কাজে লেগেছিল। টেবিল পেছনে ফেলে স্যারদের কাঁধের ওপর দিয়ে বারান্দায় এসে পড়েন উত্তম। তারপর ভোঁ দৌড়। পেছনে তাকাননি আর।

এরিনসহ
এরিনসহ


আমারও আছে অল্পস্বল্প গল্প। ছুটির দিনে স্কুলের চেহারা দেখতে গিয়েছি। স্কুল ঘরের পেছনে জার্মানি লতা। সেখানে ফড়িং ওড়ে। বিস্তৃত ছন খেত ডাকে আমায়্ এরপর সংকীর্ণ বুনো পথ ধরে যাই সামনের উঁচু ভিটায়। ছড় ছড় করে ঘুঘু পালায়। ঘুঘুর বাসা আমার চোখ এড়ায় না। আমি ঘুঘুর ডিম নামাই না, তবে ডালের ওপরে উঠি। দেখতে চাই, মা ঘুঘু আসে কখন!
এদিকে অনেক সময় চলে গিয়েছে। সেকালে লোকের এখনকার মতো চলাফেরা ছিল না। একবার এদিকে আসি আবার ফিরে যাই। আবার ওদিকেও লোকালয় একেবারে কাছে না। কিছুটা গিয়ে একইভাবে ফিরে আসি। ভয় ছাড়ে না। এখনো সে আতঙ্কের অনুভূতি মনের মধ্যে।
রাত গভীর হয়। আমাদের গল্প শেষ হয় না। পূর্বা-দূর্বা-উর্নিশাও মশগুল তাদের নিজস্ব ভুবনে। তারা বসেছে আলাদা জায়গায়, এক পাশে। কিন্তু শেষ তো করতেই হবে। এবার আমরা চলি ভিন্ন পথে। একেবারেই বিপরীত দিকে। উদ্দেশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফার বাড়ি রাউদা প্যালেস দেখা। উত্তম ও বিকো দুজন মিলে পরিকল্পনাটি নেন। উল্লেখ করতে হয়, শুরু থেকে শেখ পরিবার বাসস্থানের জন্য আল আইন শহরকে বেছে নেয়। এই দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ থাকতেন মাকাম প্যালেসে। তার শৈশব কাটে যে রাজপ্রাসাদে সেটা এখন প্যালেস মিউজিয়াম। আবুধাবি হচ্ছে রাজধানী, তা শুধু রাজকার্য পরিচালনার জন্য।
বহর চলল টানা পথ ধরে। বাঁ দিকে ভেতরের দিকে সেই বাড়ি। গাড়ি আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। সামনে নিরাপত্তা কর্মীরা বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়ানো। নীরব নিথর পরিবেশ। কেউ টু শব্দটি করছে না। বিশাল দরজা প্রেসিডেন্টের বিশালত্বই প্রকাশ করছে। সেখানে দিনের আলোর মতো সবকিছু দেখা যায়। তাদের ডানে রেখে ঘুরে আসি আমরা। পাশের শোয়ানো ট্যাংক অতিক্রম করে আবার সেই দিকে মূল পথে।
ছুটি আমরা, উর্নিশাই বাতলে দেয় ডান বাম। বুঝতে পারি, ওরা ছুটির ফাঁকে কিংবা বিনোদনে চলে আসে এমন কোনো জায়গায়ই বৃত্তীয় চক্কর দিয়ে আসি হাই ওয়েতে। আকাশে লাখ তারার হাতছানি। কবি গুরু গেয়ে ওঠেন হৃদয়ের ঠিক মধ্যে খান থেকে।
তোমার আঁধার তোমার আলো দুই আমারে লাগল ভালো—
আমার হাসি বেড়ায় ভাসি তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে।।
পরিচ্ছন্ন এক আকাশ। চমৎকার, চমৎকার সে অনুভূতি!

উত্তম, ঊর্মি ও উল্কা
উত্তম, ঊর্মি ও উল্কা

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।