ক্যানবেরায় বন্যার্তদের জন্য সংগীতানুষ্ঠান

সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

মানবতার জন্যই শিল্প। এ কথা আবারও প্রমাণ করলেন অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় বসবাসরত বাংলাদেশি শিল্পীরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় জন পল কলেজ অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশের বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শিল্পী লানা, রিফাত বিতা, লুনা, অভিজিৎ, বিপ্লব ও বুশরা গান ও কবিতা পরিবেশন করেন। অর্থ সংগ্রহ মূল উদ্দেশ্য থাকায় অনুষ্ঠানের আড়ম্বরটা তেমন চোখে না পড়লেও অনুষ্ঠানের গুণগত মানের দিক থেকে কিছুটা কমতি ছিল না। তবলায় অভিজিৎদা, কিবোর্ডে আতিক হেলাল ও গিটারে অমিত উইলিয়ামের উপস্থিতি অনুষ্ঠানের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানে শিল্পীরা পরিবেশনার পাশাপাশি আয়োজনের কাজটুকু নিজেরাই করেন। দেশের জন্য কিংবা বিভিন্ন চ্যারিটির জন্য অনেক অনুষ্ঠান আমরা দেখি ক্যানবেরাতে, কিন্তু শিল্পীদের এই ধরনের আয়োজন সম্ভবত এই প্রথম ক্যানবেরাবাসীরা উপভোগ করলেন।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও শব্দনিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতি ও অডিটোরিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ত্রুটির কারণে ৭টা ১৫ মিনিটে বাংলা রেডিও ক্যানবেরার সমন্বয়কারী রাকিবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ইমতিয়াজ হোসেন তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে তিনি এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। এই অনুষ্ঠান আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ক্যানবেরাভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন এটিএন ক্যানবেরা, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া অ্যাসোসিয়েশন, ম্যাক্স ইভেন্ট অস্ট্রেলিয়া ও লেটস ওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ। মঞ্চসজ্জায় রাতুল ফয়াজ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে আসিফ ভাই ও ফটোগ্রাফিতে মুনির ভাইকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে আয়োজকদের অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়ক হয়। এই ধরনের কমিউনিটিভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আরও সহযোগিতা করা উচিত যাতে অনুষ্ঠানের আর্থিক দৈন্যতা কমে আসে।

সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত ‘বিস্তীর্ণ দুপাড়ের অসংখ্য মানুষের’ গানটি দলীয় পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর একে একে রবীন্দ্র-নজরুল আর লালনের গানের মাঝে বিপ্লব আর বুশরার কণ্ঠে আবৃত্তি ছিল দারুণ। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে তবলার শব্দ কিছুটা ম্রিয়মাণ থাকলেও শব্দনিয়ন্ত্রক তপার অশেষ চেষ্টায় সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। ধন্যবাদ তপা ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এস & টি সাউন্ডকে, অনুষ্ঠানের শব্দনিয়ন্ত্রণে সার্বিক সহযোগিতার জন্য।
শিল্পী লানার কণ্ঠে লালনের পরিবেশনা ছিল অতুলনীয়। লানার কণ্ঠে শচীন দেব বর্মণের গাওয়া ‘মন দিল না বধূ’ গানটি শুনে মনে মনে আমরা পুরোনো দিনে ফিরে গেছি। বিতার কণ্ঠে নজরুল সংগীত কেমন উপভোগ করেছে সেটা আর ক্যানবেরাবাসীদের নতুন করে বলার নেই, এক কথায় অসাধারণ। বিতা আর লুনার গাওয়া কীর্তন আর সেই সঙ্গে অভিজিৎদার তবলা সংগত কিছুক্ষণের জন্য দর্শকদের ফেলে আসা সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
সংগীতানুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

ক্যানবেরায় রবীন্দ্রসংগীতে পরীক্ষিত শিল্পী লুনার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতগুলো সব সময়ের মতো অনন্য। অভিজিৎ রবীন্দ্রনাথের ছেলে মারা যাওয়ার পর লেখা চিঠি মাহী আর খালি গলায় ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল’ গানটি অসাধারণ গেয়েছেন। বিপ্লব আর বুশরা তাদের অসাধারণ কণ্ঠশৈলীতে রবীন্দ্রনাথের অন্তর মম বিকশিত করো, হঠাৎ দেখা, সোনার তরী, দুঃসময়, আহসান হাবিবের আনন্দ, রফিক আজাদের যদি ভালোবাসা পাই, সুকান্তের স্মারকসহ আরও কিছু আবৃত্তি করেন। তবে সব থেকে বেশি আবেদন ছিল শুভ দাশগুপ্তের প্রেম কবিতাটি। কিছু মৃত্যু কতটা নাড়া দেয় সেটা আবৃত্তিকাররা শ্রোতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।
অডিটোরিয়ামের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী উপস্থিতি কম না হলেও ক্যানবেরাতে বাংলাদেশি সিনিয়র সিটিজেনদের অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন। তাদের সরব উপস্থিতি ভবিষ্যতে আয়োজকদের আরও ভালো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুপ্রাণিত করবে। খাবার আয়োজনের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের খাবারের কোয়ালিটি এবং পরিমাণে আরও বেশি সচেষ্ট থাকতে হবে। আর সেই সঙ্গে অনুষ্ঠানের শুরুতে দর্শকদের জন্য বিনা মূল্যে চা পরিবেশন করা হলে বসন্তের ঠান্ডা সন্ধ্যায় শীতটা কম অনুভব হতো।
সবশেষে ক্যানবেরা বাংলাদেশি কমিউনিটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ক্যানবেরার বাংলাদেশি প্রবাসীদের পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ এবং সেই সঙ্গে আগামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা উপস্থিত থেকে শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জোগাবেন আয়োজকদের পক্ষ থেকে এই প্রত্যাশা।

নিউটন মুহুরী: সাংস্কৃতিক কর্মী, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া।