ভিনদেশের শৈশব

পাইন গাছের খোল
পাইন গাছের খোল

দেশের বাইরে এসে দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধরে রাখার এবং সেটা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা ভাবনা প্রায় সকল প্রবাসীর মনেই কাজ করে যায় অহর্নিশ। বিশেষ করে শিশুদের বাঙালি ও প্রবাসী ভাবধারার মিশেলে একটা একটা চমৎকার শৈশব উপহার দেওয়াটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর আমার ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশি ভাবধারার একটা চমৎকার শৈশব কীভাবে উপহার দেওয়া যায় সেটার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। অবশেষে একে একে বাংলাদেশের দুরন্ত শৈশবের প্রায় সকল উপকরণই জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছি। আজ সে গল্পই বলব আপনাদের, যাতে করে আপনারাও কিঞ্চিৎ উৎসাহিত বোধ করবেন আশা করি।

প্রত্যন্ত মফস্বলে বেড়ে ওঠা দুরন্ত শৈশব ছিল আমাদের। আমাদের খেলাধুলার সকল উপকরণ আমরা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতাম। ঠিক তেমনি একটা খুবই জনপ্রিয় খেলার উপকরণ ছিল সুপারি গাছের খোল। সুপারি গাছের খোলটা শুকিয়ে নিচে পড়ে গেলে আমরা সেটা সংগ্রহ করে তার ডাটা থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে সেটাকে পরিষ্কার করে নিতাম যাতে সহজে হাতে ধরা যায়। এরপর আমরা পালাক্রমে চড়ে বসতাম খোলের ওপর আর অন্য একজন হাতলটা ধরে টেনে নিয়ে যেত। সুপারির খোলটা একটু বড় হলে আমরা কখনোবা দুজনও চড়ে বসতাম। এটাতে চড়ার একটা ঝুঁকি ছিল সেটা হচ্ছে বসাটা ঠিকমতো না হলে ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পরি ঘুড়ি
পরি ঘুড়ি

এখানে বাসা থেকে স্টেশনে যাওয়া আসার পথে এক বাসায় বেশ কিছু পাইন গাছের তলায় দেখলাম পাইন গাছের খোল পড়ে আছে। দেখতে অবিকল সুপারির খোলের মতো, তবে আকারে বেশ বড়। দেখামাত্র আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। একদিন ভোরবেলা আমরা বাপ-বেটি মিলে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। তারপর তার হাতল থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে সেটাকে একেবারে সুপারির খোলার মতো গাড়ি বানিয়ে ফেললাম। এরপর ছেলেমেয়ে দুজনকে সেটাতে বসিয়ে আমি তাদের টেনে নিয়ে বেশ কয়বার চক্কর দিলাম বাসার সামনে। আমি ভেবেছিলাম প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষে বেড়ে ওঠা ওরা হয়তো তেমন একটা আনন্দ পাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ওরা খুবই উপভোগ করল ব্যাপারটা এবং সেটা জানিয়ে দিল মুখ ভরা হাসি দিয়ে। ছেলেতো নামতেই চায় না। যতবারই নামাতে যাই সে চিৎকার শুরু করে দেয়। পরে অনেক বুদ্ধি করে ওদেরকে নিবৃত্ত করতে পেরেছিলাম।
গ্রামীণ শৈশবের অন্য উপকরণগুলোর মধ্যে ছিল লুডু, মার্বেল, দাবা, তাস ও ঘুড়ি ইত্যাদি। অস্ট্রেলিয়াতে এগুলো কোথায় পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে বের করে ফেললাম এখানকার বাঙালি দোকানগুলোতে লুডু পাওয়া যায়। একদিন কেনাকাটার সময় দাম জিজ্ঞেস করে দমে গেলাম। কিন্তু মেয়ে যেহেতু বাংলাদেশে লুডু খেলে এসেছে সেহেতু সে নেবেই। অবস্থা দেখে দোকানদার ভাইয়া আমাকে বললেন, এটা নিয়ে যান দাম দেওয়া লাগবে না। এটা ভাতিজির জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। কথাটা শুনে চোখটা ভিজে গেল। মানুষে মানুষে এমন সহমর্মিতা দেখলে মানুষের ওপর আমার বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়।
এরপর তাসের সন্ধানে প্রায় এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে সিডনির বাংলাদেশিদের রাজধানী বলে বিখ্যাত লাকেম্বা চলে গেলাম এবং একসঙ্গে তিন সেট কিনে নিয়ে এলাম। এখন আমি আর আমার মেয়ে অবসর পেলেই তাস নিয়ে বসে যাই। আমরা তেমন কিছু খেলি না জোড়া মেলানো ছাড়া। এ ছাড়া আমরা আমাদের মতো করে কিছু খেলা আবিষ্কার করে ফেলেছি ইতিমধ্যেই। পরবর্তীতে অবশ্য আরও বেশ কিছু জায়গায় তাসের সন্ধান পেয়েছি।
পরে মার্বেল আর দাবার সন্ধানও পেয়ে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত চেইন শপ কে-মার্টে। তখন আর আমাদের পায় কে। সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিয়ে এসে এক দান করে খেলে ফেললাম আমরা বাপ-বেটি। প্রতিবেশী আরলিনকে তার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেখে জানতে চাইলাম এগুলো কোথায় পাওয়া যায়। আরলিনের গিন্নির কাছ থেকে শুনলাম চেইন শপ এলডিতে মাঝে মধ্যে সেলে দেয়। তাকে বলে রাখলাম এরপর কখনো সেলে দিলে যেন আমাদের জানান। পরের সপ্তাহে তিনি আমাকে ডেকে বললেন, দেখ আমাদের একটা পরি ঘুড়ি আছে, আমার মেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন কিনেছিলাম। এখন আর ওরা সেটা ওড়ায় না, তুমি কিছু মনে না করলে নিতে পারো। আমরা বাপ-বেটি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। এরপর যেদিনই দেখি একটু জোরে বাতাস বইছে আমরা ঘুড়ি নিয়ে মাঠে চলে যাই।

তারাবাজি পোড়ানো
তারাবাজি পোড়ানো

বাংলাদেশের শৈশবের আরও একটা খেলার উপকরণ ছিল কাগজ দিয়ে নিজের হাতে তৈরি বিভিন্ন রকমের খেলনা। আমরা কাগজ দিয়ে উড়োজাহাজ, নৌকা, শাপলা ফুল ও ছিকা বানাতাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাপলা ফুল বানানোটা ভুলে গেছি, বাকিগুলো মনে আছে। আমরা শুধুমাত্র উড়োজাহাজ ও নৌকা বানানোর জন্য দোকান থেকে সস্তার রংবেরঙের একগাদা কাগজ কিনে আনলাম। তারপর সেই কাগজ দিয়ে আমি আমার মেয়েকে উড়োজাহাজ বানিয়ে দিলে সে সারা ঘরময় সেটা উড়িয়ে বেড়ায়। এমনকি আমাদের বাসায় যতজন বাচ্চাকাচ্চা বেড়াতে আসে তাদেরও বানিয়ে দিতে হয়। কারটা ভালো উড়ছে, কারটা উড়ছে না সেটা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। তখন আবার আমাকে নতুন করে বানিয়ে দিতে হয়।
আমরা বুদ্ধি করেছি রেখেছি কোনো এক বর্ষায় বাসার কাছের নদীতে অনেক পানি হলে আমরা বিভিন্ন রঙের কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেব। কিন্তু তাই বলে আমাদের নৌকা বানানো থেমে নেই। এখনো আমরা নৌকা বানাই তবে সেটা বাসায় বালতিতে বা বাথটাবের পানিতে। সেটা দেখে আমার সদ্য হাঁটা শেখা ছেলের সে কী আনন্দ। সে বারবার হাত বাড়িয়ে নৌকাটা ধরতে যায় কিন্তু তার হাতের ঢেউয়ে সেটা দূরে সরে যায়। এভাবেই চলে আমাদের বিনি পয়সার অফুরান আনন্দের খেলা।
ভিনদেশে আসার সবচেয়ে বড় মুশকিলটা টের পাওয়া যায় উৎসবের দিনগুলোতে। এখানে কখন রোজা শুরু হয়, কখন কোন দিক দিয়ে ঈদ এসে যায় কিছুই টের পাওয়া যায় না। আর বাৎসরিক উৎসবের দিনগুলোতে ছুটি না থাকায় সেটাকে আলাদাভাবে আর অনুভব করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা ঘটা করে চাঁদ রাত পালন করতাম। টঙ্গী থেকে সব রকমের পটকা কিনে আনা হতো। পাড়ার মেহেদি গাছের পাতা সংগ্রহ করে অনেক রাত অবধি বাটা চলতো। তারপর সবার হাতে হাতে মেহেদি দেওয়ার কাজটা করত মেয়েরা আর ছেলেরা ব্যস্ত থাকত পটকা ফুটানোতে। এখানে কোথায় পটকা পাওয়া যায় খোঁজ নিতে শুরু করলাম।
অবশেষে চেইন শপ উলিসে আমরা পেয়ে গেলাম তারাবাজি। তখন আর আমাদের পায় কে। চাঁদ রাতের আগে সেটা কিনে আনা হলো। তারপর চাঁদ রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আমরা তারাবাজি পোড়ালাম। মেয়েতো অনেক আনন্দ পাচ্ছিলোই, আমি দুঃসাহস দেখিয়ে ছেলের হাতেও দিয়েছিলাম একটা। কিন্তু ছেলে সেটা কী বোঝার জন্য আগুনটা ধরে ফেলাতে ওর হাতের আঙুলের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গিয়েছিল। এ কারণে আমাকে এখনো ওদের মায়ের বকুনি খেতে হয়।

হনুমানের সঙ্গে সেলফি
হনুমানের সঙ্গে সেলফি

ঈদের দিন সকালে আমরা তিনজন একেবারে উৎসবের আমেজে গোসল করে বাসার কাছে একটা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়তে যাই। নামাজ শেষ করে আমি যেন জিলাপি নিতে না ভুলে যাই মেয়ে সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়। এখানে আসার পর আমরা পূজার সময় প্রতিমা দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম প্রতি বছর। তারপরও একদিন মন্দির খুঁজে বের করে আমরা সবাই মিলে চলে গেলাম প্রতিমা দেখতে। গিয়ে দেখি সেটা দক্ষিণ ভারতের অনুসারীদের মন্দির। ভেতরে তখন গণেশ চতুর্থীর পূজা চলছিল। আপাতত সেটা করেই আমরা প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ফেরার পথে বজরঙ্গি হনুমানের সঙ্গে একটা সেলফিও তুলে ফেললাম। এবার ফেসবুকের কল্যাণে খুব সহজেই জানতে পারছি কবে কোথায় প্রতিমা উঠবে। তার মধ্যে থেকে বাসার কাছাকাছি একটা জায়গা আমরা ঠিক করে রেখেছি। এইবার আর ইনশা আল্লাহ আমাদের প্রতিমা দর্শন কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এ ছাড়া আমরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রাতে সবকিছুর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা হচ্ছে লুকোচুরি। আমাদের লুকানোর জায়গাগুলোও অভিনব। খাটের নিচে, সোফার নিচে আমরা লুকাই। এ ছাড়া আমাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা হচ্ছে জানালার পর্দার পেছনে, কাপবোর্ডের ভেতরে, জুতার বাক্সের মধ্যে। তা ছাড়াও বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে লুকানোও আমাদের অনেক পছন্দের। আমরা প্রায় প্রতি রাতেই ঘুমাতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ কুস্তি করি। কুস্তিগিরদের মতো করে আমি ছেলেকে একবার আবার মেয়েকে একবার কাঁধের ওপর তুলে বিছানার ওপর চিৎ করে ফেলি। সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠে আবার আমার সামনে চলে আসে। খেলতে খেলতে আমি একসময় ক্লান্ত হয়ে যাই কিন্তু ওরা কিন্তু ক্লান্ত হয় না। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে আমাকেই হার মানতে হয়। এরপর বিছানায় গিয়ে আমাদের আরেক খেলা শুরু হয়। বিছানার চাদরের নিচে আমরা অনেক সময় ধরে হুল্লোড় করি। একজন অন্যজনকে খুঁজি। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না যে, কম্বলের তলায় আসলে কতজন খেলছে। এভাবে খেলতে খেলতে একসময় আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মধ্যে ঘুমানোর আগে ঠাকুরমার ঝুলি বা উপেন্দ্রকিশোর থেকে গল্প পড়ে ওদের শোনাতে হয়। অথবা আইপ্যাডে মহাভারত বা রামায়ণ দেখতে দেখতে আমরা স্বপ্নের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ি।
বিদেশে আসার পর সবচেয়ে মুশকিলে পড়ে যায় শিশুরা। কারণ দেশে তাদের সঙ্গে খেলার জন্য কত আত্মীয়স্বজন থাকে। কিন্তু এখানে আসার পর স্কুলের বাইরে তাদের সঙ্গে খেলার জন্য তেমন কেউ থাকে না। আর বাবা-মা দুজন কাজ করলে ওরা আরও বেশি একাকিত্বে ভোগা শুরু করে। দেশে ফেলে আসা দাদা-দাদি, নানা-নানি সকলের অভাব এখানে শুধুমাত্র বাবা-মাকেই পূরণ করতে হয়। তাই শিশুদের একটু বেশি সময় দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। কখনো আপনি তাদের সহপাঠী, কখনো আবার বন্ধু, কখনো আবার খেলার সাথি, কখনো বা আপনাকে দাদা-দাদি, নানা-নানির চরিত্রেও রূপদান করতে হয়। আবার একই সঙ্গে তাদের আপনি অভিভাবক ও শিক্ষকও বটে। এত কিছু মিলিয়ে ওদেরকে একটা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন উপহার দেওয়া আসলেই অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তবে সেটা অসম্ভব নয়। তাই প্রবাসে আপনি আপনার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি যদি ওদেরকে একটু খেলাধুলাতেও সঙ্গ দেন তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ভবিষ্যৎ জীবনে ওরা যখনই কোনো খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাবে তখন এই সুন্দর রঙিন অতীত ওদেরকে মানসিকভাবে শক্তি জোগাবে এবং ওরা কখনোই হেরে যাবে না। কারণ উন্নত বিশ্বের এই যান্ত্রিকতায় আমরা মানুষেরা খুবই দ্রুত হাঁপিয়ে উঠি। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা সবচেয়ে আজব একটা বস্তু দিয়ে পাঠিয়েছেন সেটা হচ্ছে আমাদের মন।

মো. ইয়াকুব আলী: অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী।