চীনের সাতকাহন

রাতের সাংহাই
রাতের সাংহাই

আজ বেশ কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র (স্থলভাগের দিক থেকে) এবং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীনে এসেছি। পৃথিবীর আদিতম সভ্যতাগুলোর একটি বিকশিত হয়েছিল এখানে। ছেলেবেলা থেকে জেনে আসা অঞ্চলগুলো যখন বিমানবন্দরের বাইরে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল তখন থেকেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার মিশেলে চমৎকার রোদেলা দিনটিতে যখন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম তা মনের গহিনে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি তৈরি করেছিল। দেহের ভেতর তখন নিউরোট্রান্সমিটারের আনাগোনা প্রবল হয়ে উঠছিল। মনের অজান্তে শুধু ভেবে যাচ্ছিলাম একটি জাতি কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত উন্নত হয়ে অন্যদের প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যেতে পারে!
চীন সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হলো এই চৈনিক সভ্যতা। চীন নামটি এ দেশবাসীর নিজেদের দেওয়া নাম নয়। এটি মূলত বিদেশিদের দেওয়া নাম। এরা দেশটিকে ডাকে ‘চুংকুয়ো’ বলে। মনে করা হয় এখানে এক সময় (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে) ‘ছিন’ নামের যে রাজবংশ রাজত্ব করত তাদের নামের অপভ্রংশ থেকে এই নামের উৎপত্তি। এখানকার মানুষদের দৈহিক গড়ন আমাদের থেকে যথেষ্টই আলাদা। আমরা দূর থেকে চীন দেশের মানুষদের একই রকম মনে করলেও এখানে এলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর (দাপ্তরিকভাবে ৫৬টি জাতিগোষ্ঠী) লোক বাস করে। এখানকার প্রায় ৯০ ভাগ লোক ‘চুয়া’ (Zhuang) জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্যদের মধ্যে মঙ্গলীয়, উইঘুর, হুই ও তিব্বতীয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কখনো কখনো কিছু জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও এখানে বিরল নয়।

লেখক
লেখক

১৪১ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ এই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ গুণ। ৩৭ লাখ বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের সকল জায়গা অবশ্য মানুষ বসবাসের জন্য সমানভাবে উপযুক্ত নয়। সমভূমি, মালভূমি, পার্বত্য অঞ্চল, নদী, সাগর, মহাসাগর সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই দেশটি। এই দেশটিকে প্রধানত ৩১টি প্রদেশ পর্যায়ের অঞ্চলে ভাগ করা যায়। সবগুলোকে অবশ্য প্রদেশ বলা হয় না। এর মধ্যে ২২টিকে বলা হয় প্রদেশ, পাঁচটিকে বলা হয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আর চারটি হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক সরাসরি পরিচালিত মিউনিসিপ্যালটি। এগুলোর বাইরেও তিনটি বৃহৎ দ্বীপ রয়েছে যেগুলো চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আইনগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কিত। এদের মধ্যে হংকং ও ম্যাকাওকে বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আর তাইওয়ানকে চীন তাদের ২৩তম প্রদেশ হিসেবে মনে করলেও এটির আঞ্চলিক শাসনের ধরন এবং সেখানকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শাসনের ব্যাপারটি মাথায় রাখলে এটিকে মূল চীনের বাইরের অংশ হিসেবে মনে করাটাই যৌক্তিক হবে। এগুলোর পেছনের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবশ্য অনেক বেশি আলোচনা করতে হবে। সেদিকে আর যাচ্ছি না।

সহপাঠীদের সঙ্গে লেখক
সহপাঠীদের সঙ্গে লেখক

চীনে আমি যে অংশে এসেছি তার নাম হলো সাংহাই। এটি রাষ্ট্র কর্তৃক সরাসরি পরিচালিত চারটি মিউনিসিপ্যালটির একটি। এখানে মিউনিসিপ্যালটির অর্থ আমাদের দেশের মতো নয়। এটি প্রকৃত অর্থে প্রদেশগুলোর চাইতেও বেশি মর্যাদা বা সুবিধা দেওয়ার একটি ব্যবস্থা। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি অনেক বড় নগরী। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ২.৫ কোটি। যদিও যতবার বাইরে বের হয়েছি মনে হয়েছে এখানে মানুষের সংখ্যা খুবই স্বাভাবিক এবং কোনোক্রমেই তা সীমাকে অতিক্রম করেনি। তবে পরে বুঝতে পেরেছি পুরো ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে একটি অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে এবং সুনিপুণভাবে। পুরো নগরীতে ট্রাফিক জ্যাম প্রায় নেই বললেই চলে। খুবই সাজানো গোছানো একটি পরিকল্পিত শহর এটি। আকাশপথ বাদ দিলেও পুরো সাংহাইয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বেশ কয়েকটি স্তরের সমন্বয়ে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো সাংহাইয়ের নিচ দিয়ে সাবওয়ে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি হলো মাটির নিচ দিয়ে চলা এক ধরনের দ্রুতগতির আধুনিক ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রায় ৫০-৬০ ফুট মাটির নিচ দিয়ে এই ট্রেন সব সময় চলাচল করে। এ ছাড়া রয়েছে দ্রুতগতির অত্যাধুনিক ম্যাগলেভ ট্রেন।

লেখক পিএইচডি গবেষক, সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই, চীন এবং সহকারী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।