জাপানে একদিন ছুটির দিনে

অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

‘নাহ ভাই। হবে না। এত দিন কেউ কখনো এই প্রতিষ্ঠানের সব বাঙালি এক হয়ে কিছু করতে পারেনি। তাই চেষ্টা করে লাভ নাই।’

রাকুতেন ইনক (Rakuten Inc.) জাপানভিত্তিক আইটি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বের বড় বড় কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর একটি। সম্প্রতি রেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে, জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার গ্লোবাল পার্টনারশিপ অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি সারা বিশ্বেই আলোচিত। এর প্রধান কার্যালয়, যেটাকে বলা হয় ক্রিমসন হাউস ইস্ট (Crimson House East) জাপানের টোকিওতে অবস্থিত। এই হাউস যেন জীবন্ত মানুষের এক জাদুঘর। ৬০ ভাগ জাপানির পাশাপাশি ৪০ ভাগ নানান দেশের, নানান বর্ণের মানুষ মিলে এখানে মোট চাকরিজীবীর সংখ্যা ১২ হাজারের ওপরে। তার মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন বাংলাদেশি। এর ভেতর বেশির ভাগই কম্পিউটার প্রকৌশলী। আর লেখার শুরুর বক্তব্য বেশির ভাগ বাংলাদেশির মনের কথা।
তারপরেও স্রোতের বিপরীতে কিছু অত্যুৎসাহী বোকা মানুষ থাকেন। এ রকমই চারজন ঘোষ দা, মামুন ভাই, সামির ভাই ও এই আর্টিকেলের নগণ্য লেখক। শুরু হলো রাকুতেনের সব বাংলাদেশিকে আরও একবার একসঙ্গে করার প্রচেষ্টা। কিন্তু কীভাবে করা যায়? পটলাক পার্টি, বারবিকিউ পার্টি আর আউটিং টুরকে পরাজিত করে সিদ্ধান্ত হলো, একদিনের একটা ইভেন্টের। যেটার নাম দেওয়া হলো রাকুতে বাংলাদেশি ফ্যামিলি ডে। তারিখ ৭ অক্টোবর শনিবার।
তো শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। প্রথমেই সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো ও প্রথম ধাক্কা খাওয়া। যদিও সবাই বাংলাদেশি, সবাই একই জায়গার এমপ্লয়ি, তবুও সবাই সবাইকে চেনেন না। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল এর পরে। সবাইকে জানানোর পরেও মোট আগ্রহীর সংখ্যা হলো মাত্র ২০ জন। জাতি এই মাত্র ২০ জন বীর ও বিরিয়ানি (নারী বীর) নিয়ে কি করবে? নিন্দুকেরা মিষ্টি মিষ্টি হাসি নিয়ে বলা শুরু করলেন, কি ভাই, বলছিলাম না। জিদ চেপে গেল। ২০ জন কেন, দুজন হলেও অনুষ্ঠান সফল করতে হবে। ঠিক তখনই ঘোষ দা তার যুগান্তকারী অনুরোধ করলেন—ভাই খাবারের মেনুটা সবাইরে জানাই দেন, তাহলে মানুষ বাড়তে পারে।
যেমন কথা তেমন কাজ। গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া হলো খাবারের মেনু। শিঙারা, কাচ্চি বিরিয়ানি, দেশি সালাদ, চমচম ও আনলিমিটেড চা। ভোজনরসিক বাঙালি, খাবারের টানেই হোক অথবা নাড়ির টানেই হোক, ইভেন্টের তিন দিন আগেই আগ্রহীর সংখ্যা ২০ জন থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৩৫-এ। আর ইভেন্টের আগের দিন নিন্দুকের মুখে কালী লেপন করে, আন্ডাবাচ্চা বাদেই এ সংখ্যা দাঁড়াল ৪৫-এ। আয়োজনে গতিশীলতা এল। এ গতিকে আবার থামিয়ে দিল বৃষ্টি। পূর্বাভাস বলছে, ৭ তারিখ শনিবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টি হবে। আর জাপানের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সাধারণত ভুল হয় না।
সেটা প্রমাণ করার জন্যই কিনা, শনিবার সকাল শুরুই হলো মুষলধারায় বৃষ্টি দিয়ে। আয়োজকসহ সবার মুখ মেঘের মতোই অন্ধকার। সব ভাবিদের মুখ আরও বেশি অন্ধকার। কারণ তাদের বলা হয়েছিল অনুষ্ঠানের ছবি পত্রিকায় যাবে। তাই তারা শাড়ি লিপস্টিক নিয়ে আগের দিন থেকে রেডি। এখন যদি বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠানই না হয়, তাহলে আর সাজগোজ করে কি হবে?
কিন্তু আমরাও বীরের জাতি। বৃষ্টিকে ভয় পেলে কি আর চলে? জানি না এ দুর্বার সাহসের কারণেই কিনা, সকাল দশটার আগেই বৃষ্টি রণেভঙ্গ দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিল। দৃশ্যপটে আগমন ঘটল এক সাহসী ঝলমলে সূর্যের। সূর্যের সাত রঙের ঝলমলে রশ্মি আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের বয়স এখনো দশের নিচে, তাদের কলকাকলিতে যেন পার্কের সমস্ত ফুল, পাখি আর গাছ খিলখিল করে হেসে উঠল। সারা রাত বৃষ্টির গুমোট নীরবতা ভেঙে জেগে উঠল জাপানের টোকিও শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সুন্দর মনোরম কাসাই রিঙ্কাই পার্ক।
শুরু হলো নাজনীন ভাবির নিজ হাতে তৈরি সুস্বাদু শিঙারা দিয়ে। শিঙাড়ার স্বাদে সবাই এতই বিমোহিত যে, কেউ টেরই পেলেন না কখন দুপুর একটা বেজে গেছে। এই একটার সময় আয়োজকদের মনে পড়ল, আরে! কাচ্চি বিরিয়ানির গাড়িতো সাড়ে বারোটায় এসে পৌঁছানোর কথা ছিল। অলরেডি ত্রিশ মিনিট লেট। আরও এক ঘণ্টা পর, টোটাল দেড় ঘণ্টা দেরিতে যখন খাবার গাড়ি এসে পৌঁছাল তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁই ছুঁই। ক্ষুধায় সবার কাহিল অবস্থা। তারপর আবার সবাই দেশি কাচ্চির স্বাদে বিমোহিত। ভুলেই গেলেন দুই ঘণ্টা দেরিতে খাবার কথা। বাবুর্চির প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। পেটপুরে কাচ্চির পর একটা করে দেশি চমচম। আহা! দূরদেশে দেশের বিয়ে বাড়ির স্বাদ। আয়োজন সফল।
তারপর সবাই মাইল আড্ডা গল্প, সময় একসময় সন্ধ্যাকে ডেকে আনল। সঙ্গে একঝাঁক মশা বাহিনী। এবার বিদায়ের পালা। একটা গ্রুপ ছবি না হলে কি চলে? ক্যামেরাম্যান শিমুল আর মইনেরের ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ঠিক করতে করতেই, সবাই অন্তত পাঁচ মিনিট হাসিমুখে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবি তোলা যখন শেষ হলো, ততক্ষণে সবাই গড়ে পাঁচটি করে জংলি মশার কামড় হজম করে ফেলেছে। তারপর একটি সুন্দর দিনের সমাপ্তি। বাসায় ফেরার পর দেখি আমার এক বছর বয়সী মেয়ের হাতে পায়ে মুখে, অন্তত চারটি মশার কামড়ের লাল দাগ টকটক করছে। তারপরেও কচি মুখে সুন্দর, নির্মল ও মিষ্টি একটি হাসি।

মো. খায়রুল কবীর: সফটওয়্যার প্রকৌশলী, রাকুতেন ইনক, টোকিও, জাপান।