রক্তের বিনিময়ে কেনা বর্ণমালা

উৎসবের একটি দৃশ্য
উৎসবের একটি দৃশ্য

জাপানের টোকিও শহরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে মাল্টিকালচারাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যাল ২০১৭। এই আন্তর্জাতিক উৎসবের উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে দেশে দেশে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা। বহুজাতিক এই সাংস্কৃতিক বিনিময় উৎসবে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, পেরু, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও ডমিনিকান রিপাবলিকসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ। সৌভাগ্যক্রমে এই অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। আমার উপস্থাপনার বিষয়বস্তু ছিল ‘Life for letters’ আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলা ভাষা।

ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, এ কথা জেনে অনুষ্ঠানে সবাই খুব বিস্মিত হন। নিজের দেশকে প্রশংসিত হতে দেখে আমরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। ভাষার জন্য এমন ত্যাগ খুবই বিরল আর তা প্রশংসার দাবিদারও। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন কথা বলে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষার প্রতি আমরা কতটুকু যত্নশীল? অনুশীলনের অভাব আর শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের প্রতি উদ্বেগহীন মনোভাব ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষার দক্ষতা। তার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বিদেশি ভাষাপ্রীতিতো আছেই।
আমাদের অনেকের কাছেই বিদেশি ব্যবহারের দক্ষতা মানে বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি কিংবা সফলতার চাবিকাঠি। আমি বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। আমার অবস্থান এর বিপক্ষেও নয়। কিন্তু যে ভাষা আমাদের স্বকীয়তার প্রতীক সেই বাংলাভাষা ব্যবহারে আমরা কতটুকু সচেতন। আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক (ইংরেজি শিক্ষক, অগ্রণী স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী) বলতেন, ভালো ইংরেজি শিখতে হলে আগে ভালো বাংলা জানা দরকার। আমিও সেটা বিশ্বাস করি, অন্তত নিজের ক্ষেত্রে। মাতৃভাষায় দক্ষতা না থাকলে বিদেশি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করা দুঃসাধ্য।

উৎসবে বক্তব্য দিচ্ছেন লেখক
উৎসবে বক্তব্য দিচ্ছেন লেখক

জাপানের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হলো তাদের ভাষা। জাপানে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে সর্বত্র নিজ ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দক্ষতা ও নির্ভরশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকের কাছেই তা জাপানিদের ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা বলে মনে হয়। এরপরও শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি ও গবেষণায় জাপানের অবস্থান প্রথম সারিতে। তবে আমি মনে করি, সেটা বিদেশি ভাষা দুর্বলতা নয় বরং মাতৃভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও সচেতনতাবোধ। জাপানি ভাষা শিক্ষা প্রসারের জন্য জাপানের শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জাপানি ভাষা স্কুল রয়েছে। জাপানে বসবাসরত বিদেশিদের জাপানি ভাষা শিখতে আগ্রহী করার জন্য এক ধরনের স্কুল রয়েছে যেখানে প্রায় বিনা মূল্যে জাপানি ভাষা শেখানো হয় (প্রাথমিক স্তরে)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জাপানি ভাষা শেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু তাদের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হলো, রান্নাঘর থেকে শুরু গবেষণাগার পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে নিজ ভাষার ব্যাপক প্রয়োগ ও প্রসার। সম্ভবত এ কারণেই তারা নিজেদের ভাষাকে এখনো দক্ষতার সঙ্গে আগলে রেখেছে।
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাভাষা আমাদের। অবহেলায় যেন আমরা তা হারিয়ে না ফেলি। আমি মনে করি শুদ্ধ ও সুন্দর বাংলা ব্যবহারের উদাসীনতা ও অনুশীলনের অভাবেই আমরা বাংলা ভাষার দক্ষতা হারাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাকে হারিয়ে ফেলছি। আমি নিজেও যে তার ব্যতিক্রম নই তা বেশ ভালোই উপলব্ধি করেছি। আমি ও আমরা অনেকেই, বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার না করে এখন অনেক ক্ষেত্রেই গোঁজামিল দিয়ে চলছি।
তাই আসুন, আমি ও আমরা শহীদ মিনারে গিয়ে নয় বরং বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে। শুদ্ধ বাংলা শিখি, সুন্দর বাংলা ব্যবহার করি।

শিমুল সাখাওয়াত: গবেষক, টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, জাপান।