হে দুঃখ বিদায়!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আপনি এখন যে কাহিনি পড়তে যাচ্ছেন তা কোনো উপন্যাস বা গল্প নয়। এ হচ্ছে বিলেতের এক মানসিক রোগীর কাহিনি। মানসিক রোগের ডাক্তার হিসেবে যা আমি অবলোকন করেছি, এখানে তারই বর্ণনা। লেখার আকার একটু বড়। সময় নিয়ে পড়ুন। ঘুরে আসুন মানব মনের এক রহস্যময় অধ্যায়কে।

ক্যাথরিন। সংক্ষেপে ক্যাথি। হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে প্রথম আমি দেখি বছর পাঁচেক আগে। ইমারজেন্সি বিভাগকে এখানে এ অ্যান্ড ই (Accident and Emergency—A&E) বলে।

ক্যাথির সমস্যা হলো সে বাঁচতে চায় না। মরে যেতে চায় এবং এ জন্য সে অনেকবার চেষ্টা করেছে। তাঁর বয়স মাত্র বাইশ। কিন্তু সে ইতিমধ্যে কম করে হলেও দশ বার চেষ্টা করেছে আত্মহত্যা করার। অধিকাংশ সময়ই সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে Overdose করে। দুবার অবশ্য সে শরীরে ছুরি দিয়ে হাতের কবজি কেটে নিজেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। বিলেতে ওভারডোজ মানে হলো ইচ্ছে করে নিয়মের বেশি ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা। অনেকে আবার চেষ্টা করে ছুরি দিয়ে শরীর কেটে মারা যাওয়ার। এ উপসর্গকে একসঙ্গে বলা হয় ডেলিবারেট সেলফ হার্ম বা ডিএসএইচ।

অন কল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (On Call Psychiatrist) হিসেবে আমাকে ব্লিপ করল ক্যাথিকে দেখার জন্য। এখানকার হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে ইমারজেন্সিতে যারা ডিএসএইট বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে আসে তাদের প্রথম মেডিসিন বা সার্জারি স্পেশালিস্টরা চিকিৎসা করেন। এ ধরনের রোগীদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখতে হবে।
তো একদিন আমি গেলাম ক্যাথিকে দেখতে। অবশ্য যাওয়ার আগে কমপিউটারে রাখা পেশেন্ট ফাইলে রোগীর বৃত্তান্ত পড়ে গেলাম।
বাইশ বছরের ক্যাথিকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই মেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে। চমৎকার সুন্দর সাদা এ মেয়েকে দেখলে যে কারওরই ভালো লাগার কথা। এ মেয়ে কেন আত্মহত্যা করতে চায় তা বোঝা আসলেই কঠিন।
সে কি Depressed, Anxious, Psychotic বা পাগল? না।
পারিবারিক বা আর্থিক সমস্যা? না।
রিলেশনশিপ ইস্যু? না।
সমস্যাটা তাহলে কোথায়?
বিছানার পাশে মা বসে আছেন। রাত দুইটা। চেহারায় ক্লান্তির ছায়া। ক্যাথির অনুমতি নিয়ে কথা বললাম মায়ের সঙ্গে। তারপর কথা বলি ক্যাথির সঙ্গে।
অনেকগুলো প্যারাসিটামল খেয়েছে সে। সকালের দিকে প্যারাসিটামল কিনেছে কয়েকটি ফার্মেসি থেকে। তারপর লিখেছে সুইসাইড নোট। তাতে সে মায়ের কাছে আর এক বন্ধুর কাছে Sorry চেয়েছে। লিখেছে ‘I will miss you. But I must die.’
ক্যাথি একা থাকে এক বন্ধুর সঙ্গে। বাসায় কেউ ছিল না সকালে। দরজা বন্ধ করে সে সব প্যারাসিটামল খেয়ে সোফায় শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মা ফোন করেন কোনো এক কারণে। মেয়ের ফোনে কোনো সাড়া না পেয়ে সরাসরি বাসায় চলে আসেন তিনি। এসে দেখেন মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পাশে প্যারাসিটামলের খালি প্যাক। ৯৯৯-এ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। ক্যাথি আসে হাসপাতালে। প্যারাসিটামলের মাত্রা খুব বেশি হওয়ায় ক্যাথিকে Parvolex Injection দিতে হয়েছে সারা দিন।
কথা বলি ক্যাথির সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করি তার অব্যক্ত কষ্ট।
মা-বাবার একমাত্র সন্তান ক্যাথি। জন্ম লন্ডন শহরে। বাবা আর্মিতে চাকরি করতেন আর মা স্কুলের শিক্ষক। সচ্ছল এক পরিবারে তার জন্ম।
বাবা ছিলেন খুবই কড়াকড়ি মেজাজের লোক। মেয়ের ওপর শাসন ছিল মারাত্মক। চুন থেকে পান খসলেই রক্ষা নেই। পড়ার সময় পড়া। খেলার সময় খেলা। বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা যদিও অবৈধ, বাবা এসব থোড়াই কেয়ার করতেন। বাবা বাসায় থাকলে সব সময় এক ভীতি আর শঙ্কার মধ্যে থাকত ক্যাথি। মা ছিলেন বাবার কড়া মেজাজের কাছে অসহায়।
স্কুলে খারাপ করা শুরু করে ক্যাথি। রাতে চিৎকার দিয়ে ওঠে ঘুমের মধ্যে। স্কুলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়। সোশ্যাল সার্ভিস পর্যন্ত ঘটনা গড়ায়। শেষ পর্যন্ত মা বাবার ছাড়াছাড়ি।
কিছুদিন ভালো যায় ক্যাথির। কিন্তু মা আবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সৎবাবা আসে ঘরে। ক্যাথি তখন সেকেন্ডারি স্কুলে। জীবনের চরম সর্বনাশ হয় সৎবাবার হাতে। ভয়ে কাউকে বলে না। এক সময় সাহস করে মাকে বলে। মা-বাবার আবারও ছাড়াছাড়ি হয়। তত দিনে ক্যাথির জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে সারা জীবনের জন্য।
মাত্র বারো বছর বয়সে ক্যাথি প্রথম চেষ্টা করে আত্মহত্যা করার। প্রথমবার সে তার জীবনের ঝুঁকি নেয় এক বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে। সেখান থেকে শুরু। ছোটখাটো মান অভিমান, রাগারাগি হলেই ক্যাথি তা সহ্য করতে পারে না। আত্মহত্যার চিন্তা তাঁর মাথায় সব সময়। জিপি দেখানো হয়েছে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখছেন, কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না।
যখন আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি, তাঁকে একজন সুস্থ স্বাভাবিক তরুণী বলেই মনে হচ্ছিল। অবলীলায় সে বলে যাচ্ছিল তাঁর আত্মহত্যা চেষ্টার কাহিনি।
সময়ের ব্যবধানে ক্যাথির মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক বিশেষ ধরনের পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ব্যক্তিত্ব সমস্যা যাকে বলা হয় বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। ইংল্যান্ডে কমপক্ষে দুই শতাংশ লোক এ ধরনের পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।
যারা এ সমস্যায় ভোগেন, তাদের সাধারণ উপসর্গ হলো, তারা তাদের আবেগকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। জীবনের লক্ষ্য তাদের স্থির থাকে না। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা তাদের মাথায় থাকে সব সময়। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুকালে তাদের ওপর আবেগ, শারীরিক, যৌন নির্যাতন বা অন্য কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
প্রথমবার আমি যখন দেখি, আমার কাছে মনে হলো ক্যাথির আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাঁকে ভর্তি করি মনোরোগ ওয়ার্ডে। কয়েক সপ্তাহ তাঁকে ভর্তি থাকতে হয় ওই ওয়ার্ডে। তাঁকে পাঠানো হয় সাইকোথেরাপি ডিপার্টমেন্টে বিশেষ চিকিৎসার DBT (Dialectical Behaviour Therapy) জন্য। একসময় তাঁকে ওয়ার্ড থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং পাঠানো হয় বিশেষ ধরনের আবাসিক ব্যবস্থা বা রেসিডেনসিয়াল হোমে যেখানে ক্যাথির মতো লোকদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। ক্যাথিকে অবশ্য তাঁর বিশেষ talking থেরাপি DB-র জন্য ফিজিওথেরাপি ডিপার্টমেন্টে সপ্তাহে দুবার আসতে হচ্ছিল। এর সঙ্গে ক্যাথিকে কিছু ওষুধও লিখে দেওয়া হয়।
ওয়ার্ড থেকে ছেড়ে দেওয়ার পরে ক্যাথিকে আমি আরও কমপক্ষে দুবার দেখি এ অ্যান্ড ইতে। আবার সে DSH করে এসেছিল। কেন জানি তার চেহারা আমার মনে থেকে যায়।
মাসখানিক আগে টাউন সেন্টারে আমার গাড়ি বিকল হয়ে যায়। নিয়ে যাই নিকটবর্তী গ্যারেজে। রিসেপশনে যে মেয়েটা বসে আছে, তাকে কেন যেন আমার পরিচিত লাগছিল।
—Hello Dr Jahan, nice to see you again. It’s Cathy, can you recognise me? I was under your care.
—Oh, ya...মনে করার চেষ্টা করি ক্যাথিকে। How are you, by the way?
—I am fine doctor. Thanks for helping me. The talking therapy helped me a lot. I am OK now. I have started a new job here, my life is worth living now...বলেই সে হাসছিল। তারপর বলেছিল Tea or coffee, doctor?
—No, thanks. I am fine.
—It will take around one hour to fix your car. Please don’t leave without saying good bye to me.
মনে হলো কিছু একটা আনার জন্য সে বাইরে যাচ্ছে।
কথা বেশি আর এগোয় না। অন্য কাস্টমার চলে আসে। আমি চলে যাই কার মেকানিকের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
ঘণ্টাখানিক পরে গাড়ি ঠিক হয়। রিসেপশনে আসি পেমেন্টের জন্য। ক্যাথির সঙ্গে দেখা হয় আবার। চলে আসার সময় আমাকে একটা এনভেলাপ ধরিয়ে দেয় সে আমার হাতে। তারপর বলল, It’s just a thank you card. Have a nice time.
গাড়িতে বসেই ওর দেওয়া খামটা খুলি। সুন্দর হাতের লেখা ‘Thank you doctor for helping me. God bless you.’
গত সপ্তাহের শনিবার। স্থানীয় পত্রিকায় চোখ রাখছিলাম। চোখটা হঠাৎ আঁতকে উঠল।
‘Woman found dead after overdose’ পেপারের হেডলাইন। ওভারডোজ করে তরুণীর মৃত্যু।
ছবিটা আমার পরিচিত। এ হচ্ছে ক্যাথি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখটা ভিজে আসে। টেবিলে তখনো রাখা ক্যাথির দেওয়া কার্ড—Thank you doctor for helping me. God bless you.
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
Sorry! I actually could not help you Cathy! আনমনে বলে উঠি। জানালা দিয়ে বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিই ওর দেওয়া কার্ড। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে ‘…God bless you.’

*এ কাহিনি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। Patient confidentiality issues থাকায় স্থান, কাল ও পাত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ডা. আলী জাহান: ইংল্যান্ডে কর্মরত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন