নারী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জামাল ভাই আমার অফিসে কাজ করেন। আমার সিনিয়র। বয়স আনুমানিক ৪২ কিংবা ৪৫ হবে। তার একটি বাজে অভ্যাস হলো, তিনি সারাক্ষণই পান চিবোতে থাকেন। মুখে পান ছাড়া তাঁকে কেউ কখনো দেখেছেন কিনা আমি জানি না, তবে আমি দেখিনি। কথা বলার সময় তিনি সাধু–চলিত মিশিয়ে কথা বলেন। মানুষ হিসেবে খুবই মজার একজন মানুষ। তবে তার একটা দিক খুবই খারাপ। সেই খারাপ দিকটা হলো, তিনি একজন চরম নারীবিদ্বেষী মানুষ। তার কাছ থেকে কখনো নারী সমাজ সম্পর্কে কোনো পজিটিভ কথা পাওয়া যাবে না। তার হিসাবে দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যার এক ও একমাত্র কারণ নারী। যে ভয়ে তিনি এখনো বিয়েই করেননি। জামাল ভাই খুবই অলস প্রকৃতির একজন মানুষ। কোনো কাজই তার সহ্য হয় না। শুধু মাত্র জীবনধারণের জন্য একান্ত বাধ্য হয়ে তিনি চাকরি করেন। তার যদি তিনবেলা খাবার কোনো নিশ্চিত ব্যবস্থা থাকত তিনি কখনোই চাকরি করতেন না। তিনি যে এই কষ্ট করে চাকরি করছেন, সে জন্যও তিনি নারী সমাজকেই দোষারূপ করেন।

তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম—জামাল ভাই আপনার তো প্রেমিকা নেই, বউ নেই। তাহলে আপনার চাকরি করার জন্য আপনি নারী সমাজকে কেন দোষ দেন?
—আর কারে দিমু মিয়া, আপনেই কন। শোনেন আল্লাহ যদি নারী না বানাইতো, তাইলে কি হজরত আদম (আ.) গন্ধম ফল খাইতেন? আমরা কি দুনিয়ায় আসতাম? আর দুনিয়ায় না আইলে কি আর আমারে চাকরি করতে হইত? হইত না। কে জানে হয়তো এ সময় আমি বেহেশতে হুইয়া হুইয়া মনের সুখে পান চিবাইতাম। টেনে টেনে সুর করে কথাগুলো বললেন।
—ভাই আপনার চিন্তার শিকড় তো দেখি অনেক গভীরে। আমি তো এভাবে কখনো চিন্তা করিনি।
—শোনেন রানা সাহেব, শুধু আপনি না, কেউই এভাবে চিন্তা করে না। কিন্তু করা উচিত। অধিকাংশ পুরুষই নারীদের আসল রূপ সম্পর্কে কিছুই জানে না। আচ্ছা আপনি তো বিবাহিত। আপনি কি প্রকৃত নারী চেনেন?
—কি বলেন? নারী চিনব না! অবশ্যই চিনি।
—তাহলে একবাক্যে নারীকে ব্যাখ্যা করেন তো।
—একবাক্যে? একবাক্যে নারী হলো মমতাময়ী।
—না, হইল না। নারী হইল ‘ট’ ময়ী অর্থাৎ প্রকৃত নারী ‘ট’ ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না।
—ভাই বুঝলাম না। কি বললেন? মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। ভেতরে ঢুকল না। একটু যদি খুলে বলতেন।
—শোনেন দুনিয়ার সব ট মার্কা জিনিসই নারীর পছন্দ। যেমন এক নম্বর টাকা। টাকা ছাড়া এরা দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। এদের কাছে টাকাই বড়, ভালোবাসা না। দুই নম্বর হইল টক, মানে কথা বলা। কোনো কারণ ছাড়া এরা যেকোনো বিষয়ে খামাখা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলবে। আপনার কান একসময় হয়তো ব্যথা হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের মুখ কখনই ব্যথা হইবে না। আজ পর্যন্ত দেখছেন কোনো টকশোতে কোনো পুরুষ বক্তা জিতছে? এরা এত কথা বলে যে, এদের কথায় বিরক্ত হয়ে হয়তো আপনার মনে হবে সিমেন্ট বালু দিয়া হয় নিজের কান, না হয় হেগো মুখ চিরতরে বন্ধ কইরা দেই। তিন নম্বর ট্যাংকি মারা। একসাথে এরা কয়েকটা ছেলেরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। কিন্তু ঠিকই সময়মতো টাকাওয়ালা টাক মাথার কাউকে বিয়ে করে আপনাকে টা–টা দিয়ে চলে যাবে। চার নম্বর টর্চার করা। আপনি বুঝতেও পারবেন না কখন, কীভাবে আপনাকে মানসিকভাবে টর্চার করছে। আর বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারবেন না। পাঁচ নম্বর ট, সেটা হলো টলমলে চোখ। এদের চোখে শ্যালোমেশিন লাগানোই আছে, যেকোনো মুহূর্তে স্টার্ট হয়ে যাবে। দেখবেন যখন কোনো যুক্তিতে পারবে না তখন কান্না করে ঠিকই জিতে যাবে। ছয় নম্বর হলো...।
—না ভাই থাক আর লাগবে না। আপনার অবস্থা তো দেখি খুবই ভয়াবহ। আপনি তো আমার মাথাই আউলায়া দিছেন। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে বেশি কথা বললে, আমার বিয়ে হালকা হয়ে যাবে। ভাই আমার বউ এমন না।
—রানা সাহেব, মানেন বা না মানেন নারী এমনই। আমার দীর্ঘ গবেষণায় আমি এমনই দেখেছি। এর বাইরে যদি কাউকে দেখেন, তাইলে বুঝবেন সে নারী না। সে...।
—নাউজুবিল্লা এসব কি বলেন! থাক ভাই, আপনার পায়ে পড়ি। আমারে আর গোমড়াহ কইরেন না।
—কিন্তু আমি তো মিথ্যা বলছি না। নারী আর ট দুজনে দুজনার। আরও দেখেন সব নারীই টক খেতে পছন্দ করে, টফি মানে চকলেট খেতে পছন্দ করে। এখানেও সেই ট। আমার গবেষণা ভুল না।
দেখলাম এ বিষয়ে তার সঙ্গে বেশি কথা বলা যাবে না। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে উঠে পড়লাম।
কিন্তু ওখান থেকে উঠে পড়লেও কেন জানি জামাল ভাইয়ের যুক্তিগুলো মাথা থেকে গেল না। তার ট সংক্রান্ত প্রতিটি পয়েন্টের আলোকে বউকে মনের অজান্তেই যাচাই করতে থাকলাম। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে শুধু ট আর ট ঘুরপাক খেতে লাগল। বউকে ট দিয়ে যাচাই করতে গিয়ে যে ফলাফল পেলাম, তাতে আমার মাথা খারাপের অবস্থা। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আবার জামাল ভাইয়ের কাছে গেলাম।
—জামাল ভাই, আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি।
—কেন, কি হয়েছে।
—ভাই আপনি না বললেন। ট–এর প্রতি যার ঝোঁক নাই, সে নারী না, অন্য কিছু। ভাই আমার মনে হয় তাহলে আমার বউ নারী না।
—কেন, কি হয়েছে। খুলে বলেন তো। কাহিনি কি?
—ভাই আপনার কথা মতো ট–এর প্রতি আমার বউ কত আকৃষ্ট সেটা জানার চেষ্টা করেছিলাম। যতবার চেষ্টা করেছি বিপদে পড়েছি। একদিন বাসায় টক মানে আচার কিনে নিয়ে গেলাম। আচার দেখে বউ বলল, আচার কার জন্য আনছ। আমি মিষ্টি করে বললাম, কার জন্য আবার? তোমার জন্য আনছি। এই কথা শুনে বউ বলল, এই গাধা আমি কি প্রেগন্যান্ট? যে আচার খাব। তার কথা শুনে থতমত খেয়ে বললাম, না আসলে মাঝে মাঝে আমার টক খেতে খুব ইচ্ছে করে তাই কিনলাম। এ কথা শুনে কি বলে জানেন?
—কি বলে?
—বলে, রানা সত্যি করে বলো তোমার কি হয়েছে। তুমি কি ঠিক আছ? তোমার হরমোন কি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? তুমি কি ছেলেদের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করো? জামাল ভাই আপনি হাসছেন?
—আচ্ছা আর হাসব না। তারপর?
—একদিন টফি, মানে চকলেট কিনে বাসায় গেলাম। বললাম, দেখ তোমার জন্য চকলেট এনেছি। চকলেটের বক্স দেখে বলে, আমার জন্য চকলেট? আমি কি পোলাপান, যে চকলেট খাব। বললাম, না আসলে আমি খাব তাই কিনলাম। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আগুন লাগল। ডাইরেক্ট তুমি থেকে তুই–এ নেমে গেল। বলে, হারামজাদা সত্যি করে বল, তোরে কোন মেয়ে চকলেট গিফট করছে? তুই কার প্রেমে পড়ছস? তোরে তো কখনোই চকলেট খেতে দেখিনি। তোর চকলেট খেতে ইচ্ছে করে, না, দাঁড়া আজ তোর চকলেট খাওয়ার শখ মিটাচ্ছি। তুই এখন আমার সামনে বসে সবগুলো চকলেট খাবি।
—তারপর।
—তারপর আর কী। এক বসায় পুরা এক প্যাকেট চকলেট আমারে জোর করে খাওয়াইছে। বিশ্বাস করেন ভাই এখন চকলেট দেখলেই আমার গা গুলায়, বমি বমি আসে।
—বুঝলাম। তা অন্য ট–এর খবর কি? এই যেমন টাকা পয়সা।
—একই অবস্থা। বিয়ের প্রথম দিকে বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা নিয়ে নিত। সেই সব বাজার সদাই করত। আমার হাত খরচের টাকা আমি তার কাছ থেকে চেয়ে নিতাম।
—দেখলেন তো, টাকার প্রতি ঝোঁক ঠিকই আছে।
—নারে ভাই। কয়েক মাস পর থেকে বেতনের টাকা আর নেয় না।
—কেন?
—বলে তোমার এই বেতন দিয়ে মাসের বিশ দিন যায়। বাকি দশ দিন আমার জমানো টাকা থেকে খরচ করতে হয়। তোমার টাকা তুমি রাখো। সংসার কেমনে চালাবা তুমি জানো। আমি এর মধ্যে নাই। এখন আর বেতনের টাকা হাতে নেয় না। কিন্তু ঠিকই আমারে দিয়ে খরচ করায়। আগে তো বেতনের টাকায় বিশ দিন যাইতো। এখন পনেরো দিনও যায় না।
—তা সারাক্ষণ টক মানে বকবক করে না?
—না ভাই, তার আসলে ট না, এস এর রোগ আছে। মানে shopping, sleeping, serial. তার নেশা শপিংমলে মলে ঘোরা আর শপিং করা। আমি অফিসে গেলে শপিংয়ে বের হয়। বলে বাসায় একা একা বসে কি করব। বোরড লাগে। তাই শপিংমলে ঘোরে আর শপিং করে। সারা দিন হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে কথা বলার শক্তি পায় না। তখন হয় টিভি সিরিয়াল দেখে না হলে ঘুমায়। সারাক্ষণ ঘুমায়। একটা মানুষ যে কত টিভি দেখতে পারে আর কত ঘুমাতে পারে, তারে না দেখলে বুঝবেন না।
—তা যেদিন আপনার অফিস বন্ধ থাকে, সেদিন নিশ্চিত সারা দিন ঘরে থাকে আর বকবক করে।
—না ভাই সেদিন আরও বেশি শপিং করে। সঙ্গে আমারেও নিয়া যায়। বলে, অন্য দিন একা একা শপিং করি ভালো লাগে না। আজ দুজনে মিলে শপিং করব।
—আপনি না বললেন আপনার বেতনে পনেরো দিনই চলে না। তাহলে এত শপিং করে কীভাবে?
—ভাই বললাম না, এটা ওর অসুখ। শপিংমলে ঘোরে আর দামাদামি করে। কেনে না। হয়তো দেখা যাবে সারা দিন শপিংমলে ঘুরে সন্ধ্যাবেলা একটা ঢাকনা কিনে বাসায় ফিরছে। যেটা কিনতে হয়তো আমার দশ মিনিট লাগবে।
—রানা সাহেব একটু বসেন। আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বলেই জামাল ভাই উঠে গেলেন। পাশের টেবিলে কাজ করছিলেন সালাম সাহেব। তিনি এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিলেন। কিন্তু কোনো উত্তর দেননি এবং আলোচনায় অংশও নেননি।
জামাল ভাই উঠে যেতেই তিনি বলে উঠলেন, রানা সাহেব, সাবধান। জামাল সাহেবের কথায় কান দেবেন না। মেয়েদের ব্যাপারে ওনার মনোভাব এতটাই নেগেটিভ যে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য নারীরাই দায়ী, এটাও তিনি প্রমাণ করে দিতে পারবেন। ওনার কারণে অনেকের সংসারে ঝামেলা শুরু হয়েছে।
—জি ভাই ঠিক বলেছেন, চরম নেগেটিভ একটা মানুষ। আমার বউ নারী না অন্য কিছু সেই চিন্তা অলরেডি আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
—শোনেন, নিজের স্ত্রীকে সম্মান করবেন। অন্য মানুষের কাছে স্ত্রীর ব্যাপারে আলোচনা করবেন না। যদি করতেই হয় তবে দোষ না, গুন আলোচন করবেন।
—জি ভাই, ঠিক বলেছেন।
এরপর দীর্ঘ দিন আর জামাল ভাই এর সঙ্গে নারী সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। তাঁকে দেখলেই এড়িয়ে চলতাম। কয়েক মাস পরে একদিন সকালে জামাল ভাই অফিসে মিষ্টি নিয়ে আসলেন। কারণ তিনি সদ্য বিবাহ করেছেন।
আমরা সবাই প্রশ্ন করলাম, জামাল ভাই, আপনি! বিবাহ! কীভাবে! আপনার সঙ্গে নারী! যায়! যায় না তো ভাই। এরাই তো সব নষ্টের মূল। আপনার জীবন তো ধ্বংস করে দেবে। আপনার জীবন একেবারে ফানা ফানা কইরা দেবে।
—জানি, আমি জানি। তাও বিয়েটা কইরা ফেললাম। চিন্তা কইরা দেখলাম, সারা দুনিয়াটাই তো ওরা ধ্বংস কইরা দিছে। আমি একা আর ভালো থেকে কি করব। তাই দেরিতে হলেও ফরজ কাজটা করেই ফেললাম।
—তা জামাল ভাই, ভাবির মধ্যে কিসের প্রভাব বেশি? ট না এস নাকি অন্য কিছু? নিচু স্বরে জামাল ভাইকে প্রশ্ন করলাম।
—কোনোটাই না, সে খুবই ভালো কইন্যা। তিনিও নিচু স্বরে উত্তর দিলেন।
—কি বলছেন ভাই? ভাবি তো তাহলে নারী না, অন্য কিছু। এ আপনি কাকে বিয়ে করলেন?
কোনো উত্তর দিলেন না। লাজুক একটা হাসি দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন, অন্যদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য।

বি. দ্রষ্টব্য: নারীকে ফুলের মতো যত্নে রাখুন, বুকের মাঝে আগলে রাখুন। মন থেকে সম্মান দিন। দেখবেন আপনার পৃথিবীটাই বেহেশত হয়ে গেছে।

ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।