প্রবাসের একান্নবর্তী পরিবারের গল্প

অভিভাবকদের প্রাণবন্ত আড্ডা
অভিভাবকদের প্রাণবন্ত আড্ডা

আমাদের গ্রামীণ শৈশবের দিনগুলো ছিল রংধনু রঙে রাঙানো। আমরা সবাই বেড়ে উঠেছিলাম একেকটি একান্নবর্তী পরিবারে। যেখানে একই সঙ্গে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপা-ফুপু, চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন সকলেরই ছিল সরব উপস্থিতি। আবার নানু বাড়িতে বেড়াতে গেলে সেখানেও ছিল নানা-নানি, মামা-মামি, খালা-খালুসহ মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের সরব উপস্থিতি। তবে আমি এদিক দিয়ে একটু বেশিই ভাগ্যবান। কারণ আমি দাদা-দাদির আগের প্রজন্মের দেখাও পেয়েছিলাম। তাঁরা ছিলেন আমার দাদির বাবা-মা। যাদের আমি বড় আব্বা ও বড় মা বলে সম্বোধন করতাম।

আমার দাদি ছিলেন আমার বড় আব্বার তিন মেয়ের বড় মেয়ে। তাই আদর করে নাম রেখেছিলেন পরিজান নেছা। তাই দাদি যখন খুবই কম বয়সে বিধবা হয়ে যান বড় আব্বা তখন আমার দাদিকে তার সকল সন্তানসহ নিজের কাছে নিয়ে এসে লালনপালন শুরু করেন। আমার বড় আব্বার মতো পরিশ্রমী মানুষ আমার এই এক জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। আমি যেহেতু সারাক্ষণ ছায়ার মতো তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরতাম তাই তাঁর এই কর্মস্পৃহা আমার কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাঁদের নিজেদের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় আমাকে নিজের ছেলের চাইতে বেশি স্নেহে মানুষ করা শুরু করেন।
একান্নবর্তী সংসারে সবাই যার যার নিজ কাজ নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে আলাদাভাবে বাচ্চা কাচ্চাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় কারও নেই। কিন্তু আমাকে সারাক্ষণ দুই চোখে আগলে রাখতেন আমার বড় মা। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, ঠিকমতো খাচ্ছি কিনা, সবকিছুর দিকেই ছিল তার কড়া নজর। এমনিতে কোনো প্রকার শাসন করতেন না, কিন্তু ঠিকমতো খাচ্ছি কিনা, দুরে কোথাও খেলতে চলে যাচ্ছি কিনা এসব ঠিকই খেয়াল রাখতেন। অসুখ হলে তার ওষুধ-পথ্য জোগাড় করা সবই তিনি একাই সামলাতেন। আমরা শুধু দিন শেষে মায়ের সঙ্গে ঘুমাতাম। কিন্তু দিনের বাকি সময়টা বড় মায়ের আদরে তাঁর আঁচলের ছায়াতলে বড় হয়েছিলাম।

বিরতিতে শিশুদের খাওয়াদাওয়া
বিরতিতে শিশুদের খাওয়াদাওয়া

বড় আব্বারা ছিলেন সাত ভাই। বোন কতজন ছিল সেটা আজ আর মনে নাই। তাঁরা সাত ভাই এক পাড়ায় পাশাপাশি বাস করতেন। বড় আব্বা ছিলেন তাদের সবার বড়। বাকি ভাইদের সকলেরই অনেকগুলো করে ছেলেমেয়ে ছিল। সম্পর্কে তাঁদের সবাইকে দাদা বা দাদি ডাকতাম। তাঁরাও আমাকে খুব বেশি আদর করতেন। দাদাদের একটা বহুল প্রচলিত দুষ্টুমি ছিল, আমাকে কানে ধরে বলতেন, শালা দুলাভাই বল। উত্তরে আমি বলতাম আমারতো বোন নাই, তোমাদেরকে কেন দুলাভাই ডাকব। তখন বলতেন, আচ্ছা ঠিক আছে বোন হলে আমার সঙ্গে বিয়ে দিবি বল। আমি বলতাম, বোন হলে তোমার মতো বুড়োদের সঙ্গে কেন বিয়ে দেব। তখন তাঁরা আরও মজা পেয়ে যেতেন, কী বললি শালা আমি বুড়ো। দাঁড়া আজ আর তোর কান ছাড়ছি না।
দাদিরাও বহুল প্রচলিত দুষ্টুমি করতেন। দেখা হলেই কোলে তুলে নিতেন। সত্যি কথা বলতে আমি কখনো এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি কিংবা এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া হেঁটে যেতাম না। সব সময়ই কোনো না কোনো দাদা-দাদির কোলে চড়ে যাওয়া হতো। দাদিরা কোলে নিয়েই জিজ্ঞেস করতেন, ও মিনসে বউ নেবা না। আমি বলতাম আমিতো ছোট, আমি কীভাবে বিয়ে করব? তখন তাঁরা বলতেন, আচ্ছা ঠিক আছে বড় হয়ে আমাকে বিয়ে করবি কথা দে। এখন আর মনে পড়ে না যে, আমি তাঁদের কথা দিয়েছিলাম কি না? কিন্তু একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম তখনো দাদা-দাদিরা একই রমকের মজা করতেন এবং আমি আরও বেশি লজ্জা পেয়ে যেতাম।
আমি নিশ্চিত আমি যদি এখনো গ্রামে বেড়াতে যাই, যারা বেঁচে আছেন, তাঁরা আমার সঙ্গে একই ঢঙে একই ধরনের রসিকতা করবেন। গ্রামের মানুষের এই সহজ সরল জীবনযাত্রা আমার মনের মধ্যে একধরনের সরলতা তৈরি করে দিয়েছিল। আমি কোনো প্রকার রাখঢাক না করেই সত্যি কথাটা সহজে বলে দিতে পারি। এমনকি এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে সত্যি কথাটা বলে দিই বলে আমি অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছি। কিন্তু তবুও চরিত্রের মধ্যে থেকে এই গুণটা বাদ দিতে পারি না।
নিজে যখন বাবা হলাম তখন মনে মনে নিজের শৈশবের কথা ভাবতাম আর পণ করতাম, আমি আমার শৈশবের ছিটেফোঁটা হলেও আমার ছেলেমেয়েদের জীবনে ফিরিয়ে দেব। কিন্তু তত দিনে আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর এক অখ্যাত চর ভবানীপুরে জন্ম নেওয়া আমি কুষ্টিয়া শহরতলি বাড়াদি হয়ে ঢাকাতে এসে পড়েছি। তবে আমার গিন্নিদের পরিবারের সবাই উত্তরখানে কাছাকাছি বসবাস করতেন। তাই আমার মেয়ে তাহিয়া কিছুটা হলেও আমার শৈশবের কিছুটা অংশ ফিরে পেল। আর আমার নানি শাশুড়ি যেহেতু এখনো জীবিত তাই বড় মায়ের আদরও পেয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে আমার বাবা-মা ও দাদি যেহেতু এখনো জীবিত আছেন তাই এদিকেও সে একই আদর পায়।
কিন্তু জীবনের গতিময়তায় আমি যখন এই সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে এসে পড়লাম তখন খুবই মন খারাপ হয়েছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে একটা ব্যাপারে আমাকে অবশ্যই দোষারোপ করবে যে, আমি তাদের কাছ থেকে তাদের শৈশবের আনন্দ ছিনিয়ে নিয়েছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। আসার পরপরই ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে আমি আবার আমার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম।

শিশুদের অনাড়ম্বর জন্মদিন উদ্‌যাপন
শিশুদের অনাড়ম্বর জন্মদিন উদ্‌যাপন

এখানকার একাডেমিক বিষয়বস্তু নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সেটি হচ্ছে এই স্কুলের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর সরলতা ও আন্তরিকতা। সিডনির বুকে বাংলাদেশিদের সংগঠনের সংখ্যা অনেক আগেই ৫০ ছাড়িয়ে গেছে এবং কিছুদিন পর পর মতের মিল না হওয়ার কারণে একটা সংগঠন থেকে আরও দু-তিনটি সংগঠনের জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু এই একটিমাত্র সংগঠন প্রায় দেড় যুগ ধরে তার অরাজনৈতিক ভাবধারা ধরে রেখে সফলভাবে কর্ম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
এখানে বাচ্চাকে ক্লাসে দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হয় চলমান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। যেটা আমাকে আমার শৈশবের খানকা ঘরের (বৈঠক ঘর) কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার তখন মনে হতে থাকে আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির বৈঠকঘরে বসে আছি আর আমার দাদাদের সেই অকৃত্রিম আড্ডা শুনছি। আর এখানেও আমি আমার গ্রামের বাড়ির মতোই সবার ছোট তাই সবাই যেমন অনেক বেশি মজা করেন আমার সঙ্গে একই সঙ্গে আমাকে অনেক বেশি আদরও করেন। তবে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে আমার ছেলেমেয়েরা।
আমাদের সিডনি আসা সবেমাত্র দুই বছর হয়েছে। তাই জীবনের সকল বাধা অতিক্রম করে একটা স্বাবলম্বী জীবনের স্বপ্ন এখনো চলমান। দেশে দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি, মামা-খালা ফেলে আসা আমার মেয়ে যেন স্কুলে এসে তাদের সকলকে একসঙ্গে ফিরে পেল। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ বয়স অনুযায়ী ওকে বিভিন্ন সম্বোধনে ডাকে ও আদর করে। যার ফলে রোববার এলেই ও স্কুলে আসার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে। তা ছাড়া চাচা-চাচিরা বেড়াতে এলে যেমন বাড়ির বাচ্চাদের জন্য জুস-চিপস নিয়ে আসেন এখানে এলে সেটাও পাওয়া যায়। বিশেষ করে মেয়েকে ক্লাসে দিয়ে আমি আর আমার দুই বছরের ছেলে বাইরে বসে যখন আড্ডা দিই তখন তাঁরা সবাই আমার ছেলেকে এমনভাবে আপন করে নেন যে আমার মনে হয় এ যেন সিডনি নয়, আমার সেই জন্মভূমি যে গ্রামের দাদা-দাদির কোলে কোলে আমি বড় হয়েছি।
আমার ছেলেকে তাঁরা বিভিন্নজন বিভিন্ন নামও দিয়ে দিয়েছেন। কেউ ডাকেন ইটি, কেউ ডাকেন কুদ্দুস, কেউ ডাকেন মাস্তান এমনই আরও কত নাম সে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। তা ছাড়াও বাচ্চাদের মধ্যে যদি কারও বাবা-মা একটু দেরিতে আসেন তাহলে সবাই তার দিকে আলাদাভাবে নজর রাখে। আমি কোনো দিন আসতে না পারলে আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন আমার মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে কিনা? তখন খুবই ভালো লাগে এই মানুষগুলোর আন্তরিকতায়।
এর বাইরে একটা ব্যাপার আলাদাভাবে বলতে চাইছি। সেটা হচ্ছে আর্থিক অসংগতির কারণেই আমরা ছেলেমেয়েদের জন্মদিন সেইভাবে জাঁকজমকপূর্ণ করে পালন করি না। ওদের জন্মদিন এলে তার কাছাকাছি সময়ে স্কুলের যেদিনটা পড়ে, কারণ স্কুল শুধুমাত্র রোববার দিন সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত, সেদিন একটা কেক কিনে নিয়ে এসে স্কুলে দিয়ে দিই। আগে থেকে কাউকে কিছু বলা থাকে না। তখন সবাই মিলে সেই কেকটা এত আনন্দ নিয়ে কাটেন যে, দেখলে নিজের চোখেই জল চলে আসে। একসঙ্গে জনা ত্রিশেক বাচ্চা আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে জন্মদিনের গানটা গাইছে তখন শুনতে এত ভালো লাগে, মনে হয় ওরা যেন অনেক সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছে যাতে করে আমাদেরই শৈশবের দিনগুলো ফিরে পাচ্ছে। ঠিক একইভাবে অন্য কারও ছেলে বা মেয়ের জন্মদিনেও একইভাবে কেক নিয়ে আসেন তাঁরা আর আমরা হইহই করে কাজে লেগে পড়ি। কেউ কাউকে বলে দিচ্ছে না কার কী কাজ করতে হবে কিন্তু সবাই নিজের নিজের মতো করে কাজ করে সেই বাচ্চাকে একটা সুন্দর জন্মদিনের স্মৃতি উপহার দিচ্ছে।
এ যেন বাংলাদেশের একেকটি একান্নবর্তী পরিবারের দৈনন্দিন দৃশ্যের অবতারণা যদিও আমরা অবস্থান করছি বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে। তাই প্রতি রোববার এলেই আমরা মুখিয়ে থাকি কখন সকাল দশটা বাজবে আর আমরা আমাদের সেই পরিবারে গিয়ে হাজির হব। যেখানে রয়েছে পরিবারের বাকি সকল সদস্য। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে আমাদের রোববারের সকালটা।
এখানে আমরা যারা আসি তারা পরিবারের সবাই মিলেই চলে আসি। বাচ্চারা ক্লাসে বসে আর আমরা বসি ক্লাসের বাইরে গোল হয়ে। তারপর চলে আলোচনা। বাবা-মাদের দেখাদেখি বাচ্চারাও আড্ডা দেওয়া শিখে যাচ্ছে এই বয়সেই এবং নিজেদের মধ্যে তৈরি করে নিচ্ছে এক অকৃত্রিম বন্ধুত্বের। আমি নিশ্চিত ওরা যখন বড় হবে তখন এই স্মৃতিটায় জীবনের খারাপ সময়ে ওদেরকে পথ দেখাবে। অনুভব করাবে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা এমন একটা দেশের মানুষ যেখানে ছোটবড় সবাই মিলে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়। বিভিন্ন উপলক্ষে সেই আনন্দ সবার সঙ্গে অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে ভাগাভাগি করা যায়। তাই দেশ থেকে হাজার মাইল দুরে বসেও আমরা স্বপ্ন দেখি বাচ্চাদের একটা দুরন্ত শৈশবের যেখানে তারা বড় হয়ে উঠছে একটা একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য হিসেবে।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।