ভালোবেসে মানুষই দাঁড়ায় পাশে

লেখিকা
লেখিকা

প্রবাস জীবনের নানাবিধ সুখ-দুঃখের ঘটনা নিয়েই এই লেখা। শেকড়বিহীন বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা এই প্রবাস জীবন প্রতিদিন জন্ম দেয় নানাবিধ ঘটনার। তার কিছু কিছু রয়ে যায় স্মৃতিতে অম্লান, জ্বলজ্বলে ছবি হয়ে ভাসে। যার পেছনে লুকিয়ে থাকে কিছু বেদনা, কিছু ভালোবাসা, কিছু অমলিন মুখের ছবি আর গল্প-কথা। সেসব নিয়েই এই আয়োজন।

কানাডায় সেবার আমাদের প্রথম শীতাভিজ্ঞান। স্বাগতিক শীত হিসেবে ২০১৩ সালের শীতটা একটু বেশিই কাঁটা দেওয়া ছিল বোধ হয়। প্রথম শীত, অনুভূতিতে প্রথম প্রেমের মতোই কিছুটা শঙ্কার আর কিছুটা সলাজ আবেগের। ভিনদেশি শীতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের যাপিত জীবনও নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় প্রতিদিনই হচ্ছে ঋদ্ধ! শরীর ও মনের অবিরাম স্নায়ুযুদ্ধ শেষে একটু একটু করে বাড়ছে আমাদের অভিযোজন ক্ষমতা। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেই দেখা গেল শীতের প্রথম প্রহরের পূর্বাভাস। যদিও অফিশিয়ালি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় পাতাঝরার মৌসুম। যাকে এরা ‘ফল’ নামে ডাকে। এখানকার ফল আমাদের বসন্তেরও কয়েক কাঠি ওপরে। প্রকৃতির রং-রূপের এত বৈচিত্র্য এই ফল–এ যা সত্যিই বসন্ত বলে ভ্রম হয়। প্রকৃতির মেজাজের ওপর নির্ভর করে মাসের মাঝামাঝিতে এদের মৌসুম শুরু হয়। শীত শুরু হবে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। শীত এলে এখানে শুরু হয়ে যায় ক্যালেন্ডারের দিন গোনা। এদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ও দীর্ঘ হলিডের জন্য সুদীর্ঘ প্রস্তুতি আর অপেক্ষা। উৎসবের জন্য গৃহস্থ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, দিনমজুর সকলেরই ব্যস্ততা বেড়ে যায়। দুই পয়সা বেশি বিক্রির, বাড়তি রোজগারের আর অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো শপিংয়ের। ওই বছরও উৎসবকে ঘিরে এমনই স্বাভাবিক ব্যস্ততায় মেতে উঠেছিল এ শহর। সবকিছুই চলছিল স্বাভাবিকই, হঠাৎই যেন থেমে গেল জীবন! এক মৌন নিথর স্তব্ধতা! হিমশীতল নীরবতা ভীষণভাবে বাজল বুকের গোপন কোণে! উৎসবের সকল আনন্দ হলো ম্রিয়মাণ।
পড়াশোনার ব্যস্ততায় তখন ফেলে আসা দেশ, পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব বেশি মন খারাপের জো নেই। কেবল দিন শেষে ঘরে ফিরলেই মনে হতো কোথাও কেউ নেই। এ যেন এক মৃত্যুপুরী! আঁধার ঘিরে আছে চারধারে খুব। আর বুঝি আসবে না ভোরের সূর্য। এমনটা হয় আমার, ঋতুজনিত ইমোশনাল চেঞ্জ। দেখতে দেখতে অবশেষে বহু কাঙ্ক্ষিত লম্বা ছুটির দিনের মাস ডিসেম্বর এসে গেল। চারদিকে সাজ সাজ রব! মেরি ক্রিসমাসের বিশাল আয়োজন। বিশেষ বিশেষ পথঘাট, লংটার্ম কেয়ার হোম, অরফানেজ হোম এবং স্কুলগুলি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নানা রঙে, ছবি, খেলনা, আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়। শপিংমলগুলোও নানারকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে রাখে। ডিসকাউন্ট-প্রমোশন থাকে অনেক। মানুষের ভিড়ও বেড়ে যায় মলে। আমাদের দেশের মতন ঈদ-পুজোতে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায় না এখানে। এরা বরং দাম কমিয়ে দিয়ে বিক্রি বাড়ায়। চারদিকে উৎসবের আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছে দারুণভাবে। এ সময়ে অনেকেই দূরে কোথাও বেড়ানোর প্ল্যান করে। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ক্রিসমাসের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য। ডিসেম্বরের বিশ থেকে শুরু হয়ে এই ছুটি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ায়। ঠিক আমাদের ঈদের মতন, গুরুত্বপূর্ণ সকল অফিস-আদালত তখন বন্ধ থাকে।
আর মাত্র চার দিন পরেই শুরু হবে মেরি ক্রিসমাসের ছুটি। হঠাৎই শুরু হয়ে গেল অস্বাভাবিক তুষারবৃষ্টি। গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারকণার সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। যাকে এরা ফ্রিজিং রেইন নামেই ডাকে। এই ফ্রিজিং রেইন অল্পস্বল্প শুরু হয়ে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্গে বাতাসের দোর্দণ্ড দস্যিপনা। বাতাসের এই দূরন্তপনাই মুহূর্তের মধ্যে ফ্রিজিং রেইনকে পরিণত করল তুষার ঝড় বা স্নো স্টর্মে। স্নো স্টর্ম অনেকটা আমাদের কালবৈশাখির মতো; প্রতি বছর শীতেই অল্পবিস্তর দেখা মেলে তার, অচেনা কিছু নয়। তবে সেবারেরটা মাত্রাতিরিক্ত, দীর্ঘমেয়াদি ও নিয়ন্ত্রণহীন! খবরে প্রকাশ গত বিশ বছরেও এত প্রচণ্ড দাপুটে স্নো স্টর্ম শহরবাসী অবলোকন করেনি।
রাতের বেলা হঠাৎই ঘুম ভেঙে ঘরের আলো না দেখে ভাবলাম বাল্ব ফিউজ হয়েছে। আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। দ্বিতীয়বার ঝড়ের তাণ্ডবেই ঘুম ভাঙল! এবার লক্ষ্য করলাম আমার বাড়ির ওপর তলায়ও আলো নেই, একটু ধন্দে পড়লাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম আশপাশের কোনো বিল্ডিং–রাস্তায় কোথাও কোনো আলো নেই। মোবাইল ফোনে সময় দেখলাম, ভোর পাঁচটা। অগত্যা বিছানায় গা গলিয়ে দিলাম। ঘুম আসছে না। এক অজানা আশঙ্কায় মন উচাটন। তবুও ভোরের অপেক্ষা।
সকাল দশটা। নাহ! তখনো পর্যন্ত কোথাও কোনো আলোর পরশ নেই; না প্রাকৃতিক, না জাগতিক। কৌতূহলী মন ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে যা দেখল তা ছিল কল্পনারও অতীত! রাস্তায় বিশালাকৃতির অনেক গাছ, শেকড়সুদ্ধ, আবার বড় বড় ডালও এমনভাবে পড়ে আছে যে, যানবাহন-মানুষ চলাচল দুরস্ত। সেই সঙ্গে ইলেকট্রিক পোলও ভেঙেছে এবং যথারীতি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তুষার স্তূপের উচ্চতা ছয় থেকে আট ফুটের মতো; কোথাও বা কিছু কম। পাতাবিহীন কঙ্কালরুপি যে গাছগুলো দাঁড়িয়েছিল শীতের বোঝা মাথায় নিয়ে, তাদের ডালেও শ্বেত পাথরের চিকিমিকি আর সূর্যের আলোর ঝিলিক ক্রিস্টালের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। চারিদিক ছেয়ে গেছে যেন শুভ্র তুষার ফুলের মেলায়! এমন দুর্যোগেও এই ক্রিস্টাল তুষার ফুলের ছবি তোলার আনন্দে মেতেছে অনেকে।
মনে মনে ভাবলাম, রহস্যে ভরা এই প্রকৃতি সত্যিই সুন্দরের পূজারি; এমন ধ্বংসলীলার মাঝেও সে তার নান্দনিকতা হারায়নি! চারদিকে সুনসান-নীরবতা, নিঝুম পুরি মনে হচ্ছে শহরটাকে। ঝড়ের তাণ্ডব দেখে মনে হলো কেউ যেন এক রাতেই পৃথিবীটাকে ধোপার ঘাটে কাপড় কাচার মতো করে আছাড় মেরে থেঁতলে দিয়েছে, সে পড়ে আছে নিথর-নিষ্প্রাণ; মুখ থুবড়ে।
বহি দর্শন শেষে ঘরে ফিরে ভাবছি এ আর এমন কী? বিদ্যুৎ ফিরে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কারণ, বিদ্যুৎহীন সময়ের দৈর্ঘ্য কয়েক সেকেন্ডের বেশি হতে পারে গত আট মাসে এই ধারণাই জন্মায়নি। তবুও শঙ্কা পুরোপুরি দূর করতে ফোন করলাম প্রতিবেশীকে। তিনি যা বললেন, তা শুনে তো চক্ষু চড়ক গাছ! জানা গেল, পরবর্তী বাহাত্তর ঘণ্টায়ও বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক হবে বলে আশা করা যায় না। অতএব, ঘরে শুকনো খাবার, দেশলাই, মোমবাতি, পানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
সংগত কারণেই পাঠকের মনে এই প্রশ্ন উদিত হতে পারে, বিদ্যুৎ নেই এতে এতটা শঙ্কিত হওয়ার কারণ কি? বাংলাদেশে যেখানে এটা নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। কারণ আছে বৈকি! বিদ্যুৎহীনতায় সে বছর সড়ক বাতি জ্বলেনি, রাস্তার নিয়মিত বাতি জ্বলেনি বেশ কিছু এলাকায়, মুদি দোকান, ডাক্তারখানা, ওষুধের দোকান, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ ও শপিং মলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার দোকানপাট বন্ধ ছিল। রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টও ছিল খুবই সীমিত। প্রধান সড়কসমূহে ৭–৮ ফুট উচ্চতার বিশালাকৃতির স্নো স্তূপ রাতারাতি সরিয়ে ফেলাও সম্ভব হয়নি। যাদের গাড়ি ছিল তারাও তখন গাড়ি ব্যবহার করতে পারেনি রাস্তার পরিস্থিতি ও গ্যাস স্টেশন বন্ধের কারণে। আমাদের ঢাকা শহরের সঙ্গে তুলনা করলে এই বিদ্যুৎহীনতার প্রকৃতি ও ভয়াবহতা খুব সহজে অনুমান করা যাবে না।
সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে হিমাঙ্কের নিচে বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সুউচ্চ বরফের পাহাড়ের যৌথ আয়োজনে বিদ্যুৎবিহীন বেসমেন্টে (মাটির নিচেরতলার ঘরে) বসবাস রীতিমতো ভয়াবহ ও সংকটাপন্ন। আমার শঙ্কারা তখন দ্রুতই ডালপালায় বিস্তার করতে লাগল। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল স্বল্প পরিচিতা কলেজের বন্ধু তিলকার কথা; যে থাকে টরন্টোর অদূরে আরেকটি নতুন বেড়ে ওঠা শহর মার্কহামে। ওকে ফোন দিতেই স্টর্ম বিষয়ক কিছু বাড়তি তথ্য পেলাম, যা আমাকে আরও বেশি ভাবনায় আচ্ছন্ন করল। আমার কণ্ঠস্বরে শঙ্কার সুর পেয়েই সে বলল, ‘তুমি কি আসবে আমাদের বাসায়? আমি তোমাকে নিয়ে আসতে পারি, তুমি তৈরি থেকো।’ এ কথা শুনেই আমার হৃদয়ে নাচন শুরু হলো। যদিও আমার স্বামী দেবতা তথৈবচ নিরুৎসাহী হয়েই আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন কেন আমি অযথাই চিন্তা করছি, এটা কিছু নয়, ঠিক হয়ে যাবে সহসাই এসব বলে। তবু আমি দমবার পাত্রী নই, শেষটায় তাকে ছাড়াই মেয়েসহ চলে গেলাম বন্ধু তিলকার বাসায়।
ওর বাসার সবাই অত্যন্ত নিজ আপনজনের মতো আমাদের সাদরে গ্রহণ করল। বেডরুম ছেড়ে দিয়ে লিভিং রুমে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করল। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে কোনো কিছুতে যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে তিলকার দুই মেয়ে, বৃদ্ধা মাসহ শ্রীলঙ্কা থেকে দুই মাসের জন্য বেড়াতে আসা তিলকার স্বামীরও নজরদারির কোনো ঘাটতি ছিল না। তিলকার বাড়িকে আমার নিজের বাড়ি ভাবতে এক মুহূর্তও সময় লাগল না। তেমনি আমার নয় বছরের মেয়েও তিলকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কানাডীয় দুই মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে নিল।
তবু আমার মন মানে না। দিনমান পড়ে থাকি টিভি সেটের সামনে, রিমোট টিপে টিপে নিউজ আপডেট দেখি। মন পড়ে আছে বাসায় ফেলে রাখা স্বামীর পানে, কী না জানি বাজে অবস্থায় আছে বেচারা। এসব দেশের নো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের বাড়িতে ঘন ঘন ধোঁয়া; মানে মোম জ্বালানো কিংবা অন্য কোনো আগুনের উৎস থাকলে কার্বন মনো অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটারও সম্ভাবনা থাকে। তেমন ঘটনা বেশ কয়েকটি ইতিমধ্যেই রিপোর্ট হয়েছে শহরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে।
আমার দুশ্চিন্তার গতি ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যারপরনাই কঠিন হয়ে গেল। নো নেটওয়ার্ক, নো বিদ্যুৎ, নো চার্জ! তিলকার বাসার টিভি চ্যানেল, কিচেন আর ডাইনিং টেবিলই আমার সঙ্গী হলো। খবরে জানলাম, সিটি মেয়র জরুরি ভিত্তিতে স্কুলসহ কিছু কিছু হাসপাতালে ওয়ার্মিং সেন্টার ওপেন করেছেন। সকলকে সেখানে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। চার দিন পরে শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম। তাকে ওয়ার্মিং সেন্টারের যাওয়ার জন্য বললাম। সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ। এদিকে আমার বন্ধু ওয়ার্মিং সেন্টারে যেতে দেবে না আমায়। সে বলল, এখানে সমস্যা কি? তুমি থাক যত দিন দরকার, বেড়াতে তো আসোনি, এসেছ বিপদে পড়ে। বন্ধুর আতিথেয়তা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সে যাত্রা মা-মেয়ে দুর্যোগের পুরো সপ্তাহ পাড় করলাম ওদের বাড়িতে। পুরো এক সপ্তাহ পরে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে এল।
সরকারি সহায়তায় প্রায় প্রতিদিনই বড় কন্ডোমিনিয়াম–অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ট্রাকে করে জারে জারে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তখন। যা পানীয়-গৃহস্থালির কাজ ছাড়াও পয়োনিষ্কাশনে সাহায্য করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মুদি বাজারের জন্য ১০০ ডলার করে পরিবার প্রতি দেওয়া হয়েছে। আর ওয়ার্ম সেন্টার তো ছিলই। এসবের পরেও প্রায় তিন লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন সাত দিন টরন্টোতে সেটা ছিল স্মরণকালের একটি ভয়াবহ দুর্যোগ ও আবহাওয়াবিদদের রিপোর্ট অনুযায়ী এক শ বছরের ইতিহাসে তেমন কোনো রেকর্ড নেই বলেই জানা গেছে।
সিটি মেয়র খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দিলেন, এটা দুর্যোগ; মোকাবিলায় সময় হয়তো লাগবে, তবে আমরা সক্ষম এটি মোকাবিলায়, অন্য কারও সাহায্য চাই না। সকল সরকারি কর্মীদের ক্রিস মাসের ছুটি বাতিল করা হলো দুর্যোগাক্রান্ত মানুষকে সহায়তার জন্য। বিশেষ করে, পানি, বিদ্যুৎ, ফায়ার ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের কর্মীদের। অনাকাঙ্ক্ষিত এই দুর্যোগের জন্য প্রশাসনিক প্রস্তুতি না থাকলেও সরকারের আন্তরিকতা আর দায়বদ্ধতার কারণে খুবই সুষ্ঠুভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে মেইনটেন্যান্সের সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
ছয় দিনের দিন রাতেই নিউজে জেনেছিলাম বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে আমার এলাকায়, আমরা ফিরে এলাম পরদিন সকালেই। এবারেও তিলকাই পৌঁছে দিয়ে গেল। আমাদের দুর্যোগের কাল কেটেছে, মনের শঙ্কা কমেনি। কাদের সঙ্গে মিশি আমি? কাদেরকে নিজের কমিউনিটি বলে গর্ব করি? ফিরতি পথে একটা পুরোনো প্রবাদই বারবার মনে পড়ছিল, ‘দেশি কুকুর, বিদেশি ঠাকুর!’ শ্রীলঙ্কান এই মেয়ের সঙ্গে আমার মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়, ওর দেশ, সংস্কৃতি, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস এমনকি ভাষাও আমার অচেনা। আমার চেনা জগতের সঙ্গে আত্মার আত্মীয় হতে পারি এমন সময়ও গড়ায়নি আমাদের। তথাপিও একটি ফোন কলের পরেই আমার দুরবস্থা আঁচ করে মেয়েটি আমাদের ঠাঁই দিল ওর ভালোবাসার মন্দিরে। সে কি শুধু বন্ধুত্বের দায়? নাকি ওর শিক্ষা, বিবেকবোধ আর মানবিকতা? ওর কাছে আমার ভালোবাসার ঋণ জমা থাকল আজীবনের জন্য। প্রার্থনা করি ঈশ্বর ওর মঙ্গল করুন।
আমাদের সংস্কৃতির শিক্ষা-আচার-প্রথা নিয়ে আমরা প্রায়শই গর্ব করি। তবে, আমারই অতি দুর্ভাগ্য যে, সেই দুর্দিনে এই প্রবাসে আমার চৌদ্দ বছরের পুরোনো বন্ধুও আমারই সঙ্গে একই বাড়ির ভাড়াটে হয়েও সেই মহানুভবতা দেখাতে পারলেন না! তিনি জানতেনই না আমরা কোথায় ছিলাম সে সাত দিন।
যাপিত জীবনের গল্পের ঝুলি ঘাঁটতে গিয়ে চোখের পর্দায় ভাসছিল প্রিয় স্বদেশের এ বছরের বন্যার্তদের সহায়তা নিয়ে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক খবরাখবরের পাতাগুলো। আমরা কি আমাদের ভাবনার জগৎকে আরও একটু প্রসারিত করতে পারি না যা আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চতাকে খাটো নয় বরং দীর্ঘই করবে, উজ্জীবিত হবে মানবতা, মানুষের দুর্দিনে ভালোবেসে মানুষই তো দাঁড়াবে পাশে!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন: লেখক। টরন্টো, কানাডা।