ফ্ল্যাশ ব্যাক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুবাই এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ। আবিদ অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। ঘণ্টাখানেক পর তার টরন্টোগামী ফ্লাইট। সে ঢাকা থেকে কিনে আনা দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে আরও বিরক্ত হলো। দেশের জন্য কি ভাববার মতো কেউ নেই? একটি দেশ কি কোনো ছেলেখেলার জিনিস? আর জনগণও তো কারও হাতের জিম্মি নয়। তাহলে এমনটা হচ্ছে কীভাবে? সে পত্রিকা সামনের চেয়ারটায় রেখে ল্যাপটপ খুলে নিয়ে বসল। অনেক দিন পর ফেসবুকে গিয়ে দেখল সেই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। একজন লিখেছেন, একটা জাতির মেরুদণ্ড হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শ্রেণির বড় একটা অংশ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। এমনকি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতেও লজ্জাবোধ করে। সবশেষে মন্তব্য হলো রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করলে ফাঁকা মাঠে তাদের নোংরা খেলা বাড়তেই থাকবে। যার কুফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হবে। আবিদ ভাবল তাহলে বিড়ালের গলায় প্রথম ঘণ্টা বাঁধবে কে?

আবিদ ল্যাপটপ বন্ধ করে মেশিন থেকে এক কাপ কফি এনে তার আগের জায়গাতে বসতে গিয়ে দেখল তার দুটি চেয়ার পরেই একজন মধ্যবয়স্কা নারী বড় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে বসে আছে। সে মনে করতে পারল না কফি আনতে যাওয়ার আগে তার এত কাছাকাছি কেউ বসেছিল কিনা? কিছুক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে আনা বোতল থেকে পানি খেয়ে চেয়ারের কোণায় রাখার সময় ধাক্কা লেগে পানি পড়ে তার চেয়ার আর মেঝের কার্পেটের বেশ কিছু অংশ ভিজে গেল। আবিদ তাড়াতাড়ি তার হাতব্যাগ থেকে টিসু পেপার বের করে ভদ্রমহিলাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেল। টিসু পেপার দিয়ে চেয়ার আর কার্পেটের পানি মুছে দিয়ে বলল, ইটস অল রাইট নাউ। ইউ মে টেক এনাদার চেয়ার। থ্যাংকস।
ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ উঠিয়ে পাশের চেয়ারটিতে বসতে গেলে আবিদ দেখল তার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট। আবিদ হেসে বলল, আপনি বাংলাদেশি? কেমন আছেন?
ভদ্রমহিলা খানিকটা সংকুচিত স্বরে বলল, জি ভালো। আপনি সময়মতো এগিয়ে না এলে কার্পেট আর চেয়ারটা আরও ভিজে যেত। অনেক ধন্যবাদ।
—না না ঠিক আছে।
তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা। কিছু বলতে হয় ভেবে আবিদ বলল, আপনার সঙ্গে আর কাউকে যে দেখছি না?
ভদ্রমহিলা আবারও দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে বলল, না মানে আমি একাই নিউইয়র্ক যাচ্ছি। এবারই প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া।
—আমার নাম আবিদুর ইসলাম। আমি সপরিবারে টরন্টো থাকি। ওখানেই একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই।
—আচ্ছা আপনি আবিদ ভাই?
আবিদ কিছুটা অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?
ভদ্রমহিলা কপট অভিমানের সুরে বলে, থাক চিনে আর কাজ নেই।
আবিদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লে ভদ্রমহিলা মাথার বড় ঘোমটাটা একটু সরিয়ে বলল, আমি সাথি। রসুলপুরে আমাদের বাড়ি।
আবিদ কিছুটা সংবিৎ ফিরে পেতে বলল, আরে সাথি কি খবর তোমার?
সাথি পাল্টা প্রশ্ন করে বলল, ভাবি বাচ্চারা সবাই কেমন আছে?
—আমাদের একটি মাত্র মেয়ে, এবার ইউনিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।

আবিদ আবার কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সাথিদের বাড়ি তাদের পাশের গ্রামে আর তারা একই স্কুলে পড়ত। সে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পরিবারের সচ্ছলতার জন্য টিউশনি শুরু করল। সাথিকে সে ক্লাস সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত পড়িয়েছে। আবিদ এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যায় অনার্সে ভর্তি হয়। সাথি নিয়মিত তাকে চিঠি লিখত আর ছুটিতে গ্রামে এলে দেখা হতো। সবকিছু মিলিয়ে একসময় তারা একে অন্যের প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সম্পর্কটা ভালো লাগা থেকে ভালোবাসায় গিয়ে গড়ায়।
আবিদের অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টের আগে আগে সাথির বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। সাথির অনুরোধে আবিদ তার বাবাকে সাথির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠায়। সাথির বাবা তাদের পরিবারকে চরমভাবে অপমান করে। সাথিরা গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার। জমি–জায়গা, ব্যবসা, প্রতিপত্তি তাদের সবই আছে। আবিদের বাবা সামান্য বর্গা চাষি। তাই সাথির বাবার অপমান আবিদের বাবা নীরবে সহ্য করে নেয়।
সাথির বিয়ে হয়ে যায়। আবিদ অনার্স মাস্টার্সে খুব ভালো রেজাল্ট করে কানাডা সরকারের বৃত্তি নিয়ে এমএস পিএইচডি করতে টরন্টো চলে আসে। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়।

আবিদ লক্ষ্য করে সাথিও আনমনে কিছু ভাবছে। সে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, তোমার হাজব্যান্ড সাথে আসেনি?
সাথি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলে, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলাদা থাকি। দশ বছর আগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তারপর থেকে একটি মহিলা কলেজে পড়াই। মেয়েটা বিয়ের পর স্বামীর সাথে বগুড়া থাকে। কলেজ থেকে তিন মাসের ছুটি নেয়ে নিউইয়র্কে ছেলে-বউয়ের কাছে যাচ্ছি। আগামী মাসে আমার নাতি পৃথিবীতে আসছে।
সাথি কথাগুলো বলতে পেরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। আবিদ আরও স্বাভাবিক করার জন্য বলল, চলো এখানকার রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার সেরে নেই।
—না আবিদ ভাই। আমার মেয়ে হটপটে করে শুকনো খাবার দিয়ে দিয়েছে। এই বলে সে পাশে রাখা ব্যাগ থেকে হটপট বের করে আবিদকে দেখাল। তারপর বাটিগুলি আলাদা করে একটিতে আবিদের জন্য খাবার তুলে দিল।
তখন আবিদের এইচএসসি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে। এক দুপুরে তাকে চমকে দিয়ে সাথি এক টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে কলেজে হাজির। তারপর ক্যানটিনে এমনিভাবে একটি বাটিতে খাবার সাজিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছিল।
সাথি হঠাৎ আবিদের চোখের দিকে তাকায়। সেও মুহূর্তের জন্য সাথির চোখে চোখ রেখে আবার নামিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে সাথি প্রশ্ন করে, আচ্ছা আবিদ ভাই আপনি কি এখনো কবিতা লেখেন?
—আবিদ কী বলবে ভেবে পায় না। তারপর আনমনে বলে ওঠে, না, কবিতার তার ছিঁড়ে গেলে কি আর কবিতা লেখা যায়।
সাথি তখন মুচকি হেসে বলে, আপনি আমাকে পড়াতে পড়াতে একদিন আমার খাতায় লিখেছিলেন তার কয়েকটা লাইন আমার আজও মনে পড়ে।
‘তুমি ছিলে আমার জল্পনায়
ছিলে আমার আঁকা আলপনায়
সাথি হয়ে এসো আমার কল্পনায়।’

দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে।
আবিদের ফ্লাইট আরও দুই ঘণ্টা পরে। তাই ঠিক হলো সে সাথিকে ইমিগ্রেশন ডেস্ক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। তারা বোর্ডিং পাসে গেট নম্বর দেখে নিয়ে উঠে পড়ল। এলিভেটরে ওঠার সময় সাথি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলে আবিদ হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সাথি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা মুহূর্তের জন্য ধরে আবার ছেড়ে দেয়।
ইমিগ্রেশন ডেস্কে পৌঁছে আবিদ সাথির ট্রলিটা তার হাতে ধরিয়ে দেয়। স্মৃতির ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে ওঠে, একবার গ্রামের স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার সময় এমনিভাবে সাথি তার ব্যাগটা এগিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য যেন সময় থেমে যায়। দূরে ইমিগ্রেশন ডেস্কের সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। চোখে চোখ রেখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের অজান্তেই আবিদ তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সাথি নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিতে গিয়েও কী মনে করে আবার ফিরিয়ে নেয়। দুটো ভারী দীর্ঘশ্বাস একসঙ্গে বেড়িয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়।

নাইম আবদুল্লাহ: অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী।