পর্যালোচনা শব্দটা আমাদের দেশে বিরল

শরৎকালের দৃশ্য
শরৎকালের দৃশ্য

ব্লাকবার্ন থেকে ফিরছিলাম ট্রেনে। লিডস থেকে দ্রুতগামী ট্রেন আসছে লন্ডনের উদ্দেশে। ট্রেন ঘণ্টায় এক শ মাইল বেগে চলছে। জানালার পাশের সিটে বসে বাইরের দৃশ্যগুলো দেখছি। পাশের বাড়িঘর আর গাছপালা কেবল দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। সবুজ দৃশ্যগুলো আমাকে বারবার বাংলাদেশে ফিরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিসীমা খুবই কম। অনেক অনেক দূর দেখতে চাইলেও দেখতে পারি না। আমরা কেন অনেক দূর দেখতে পাই না? অতীতের অভিজ্ঞতা যদিও দূরকে কাছে নিয়ে আসে। আমরা দূর শুধু কল্পনা করতে পারি।

যা হোক, বাইরের দৃশ্য আনমন করে তুলছে। দৃশ্যগুলো আমাকে বাংলাদেশের ছোট্ট একটি পল্লিতে নিয়ে যাচ্ছিল বারবার। যে পল্লিতে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন আমার গ্রামের নাম। আমি নিজেকে বারবার হারিয়ে ফেলি এই ভেবে যে, কেন আমরা বাংলাদেশে ফিরে যাই না। কেন পড়ালেখা শেষ করে আমরা এই দেশে আবাস গড়ে তুলি! যে দেশ আমাকে বালিশ হয়ে আদরে বিশ্রামের তৃপ্তি দিয়েছে, যে মাটি দিয়ে আমার শরীর তৈরি হয়েছে, যে নদীতে আমি সাঁতার কেটেছি, যে মাটির গন্ধ আমার শরীর ও হৃদয়ে মেখে আছে, সেই মাটিতে ফিরে যেতে কি সমস্যা। কোনো এক গুণী ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন (আমি তাঁর নাম বলব না) যে, বাংলাদেশ থেকে সব মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে, দেশ চালাবে কে? কিন্তু কেন? এই কেন প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমার লেখায় কিছুটা ফুটে উঠবে।
ইংল্যান্ড আর বাংলাদেশ দুই দেশ (বলাই বাহুল্য), দুই দেশের দুই ভাষা, দুই সংস্কৃতি। মানুষের চেহারা ছবি ভিন্ন ও ভিন্ন রীতিনীতি। আবহাওয়াও ভিন্ন। ইংল্যান্ডে এখন শরৎ প্রায় শেষ হতে চলছে। শরতের এক শীতল সকালে লিডস থেকে দ্রুতগামী ট্রেনে লন্ডন ফিরছি। আমার দেশে এখন হেমন্তকাল (হেমন্তকাল নিয়ে আমার একটা কবিতা আছে)। আর ইংল্যান্ড চার ঋতুর দেশ। এখানে শরৎকাল শেষ হতে চলছে (সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর)। সুন্দর শান্ত দিন সেদিন (রোববার ২৯ অক্টোবর)। ওই দূরে নীল আকাশ। আকাশের দূরত্বটা অনেক বেশি। মাঝে মাঝে তুলার মতো চিলতে চিলতে সাদা মেঘ। মেঘেরা সব সময় পৃথিবীর কাছে। কিন্তু নীল আকাশ দূরে থাকে। নীল আকাশ শুধু কল্পনাতেই পৃথিবীতে নেমে আসে। নীলেরা সুন্দর তাই তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণত এ দেশে এই ঋতুতে দিন হয় কদর্য। কিন্তু সেদিন চমৎকার সুন্দর দিন। পাতায় পাতায় রাস্তাঘাট উপচে পড়ছে। যেমন বৃষ্টির পর রাস্তায় এখানে ওখানে পানি জমে থাকে। শরতে গাছের পাতা ঝরতে থাকে। ঝরতে ঝরতে গাছগুলো শীতের শুরুতেই পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। পাতাশূন্য গাছ দেখতে সুন্দর নয়। ন্যাংটা ন্যাংটা মনে হয় পৃথিবীটাকে।

শরৎকালের দৃশ্য
শরৎকালের দৃশ্য

এখানে আবার বসন্তে যেমন কাপড় ছাড়া নারী, তেমনি শীতে পাতাহীন গাছগাছালি। দৃশ্যত দুটিই অসুন্দর। দুটিই আবৃত আচ্ছাদিত থাকলেই আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। শরৎকালে এ দেশের উপরিভাগ একটি রঙিন চিত্রের মতো (ছবিতে দেখুন)। হলুদ, কমলা রঙের পাতায় গাছগুলো যেন বৈচিত্র্যময়। এ সময় বৃক্ষের পাতাগুলির ধীরে ধীরে ক্লোরোফিল হারিয়ে হলুদ রঙে রঞ্জিত হয় যেন। সূর্য পৃথিবী থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে অবস্থানের কারণে অথবা যেকোনো কারণেই হোক দুর্বল হয়ে যায় (সূর্য কেন পৃথিবীর কাছ থেকে এত দূরে যায়, আমি জানি না)। এই সময়ে দিনগুলি হয়ে যায় খুবই ছোট। এত ছোট দিন যেন তড়িৎগতিতে সন্ধ্যা হচ্ছে (বিকেল সাড়ে ৪টায় সন্ধ্যা, আবার শীতের দিনে সাড়ে ৩টায় সন্ধ্যা)। বলাই বাহুল্য রাত অনেক লম্বা।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আগের পর্বে লিখেছিলাম আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষাব্যবস্থা ও বহির্বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটু আলোকপাত করব। ট্রেন ভ্রমণে অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করার এক চমৎকার সুযোগ। অলস সময়টা কাজে লাগানো আর বিরক্তি পরিহার করা। তাই দ্রুতগামী ট্রেনে বসে যখন লিখছিলাম তখনই একজন প্রীতিপূর্ণ পাঠক মেসেঞ্জারে একটি রিকোয়েস্ট পাঠালেন। লিখেছেন তার হতাশার কথা। তিনি বিনীতভাবে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির রীতিনীতির ওপর আমি যেন আলোকপাত করি। তিনি লিখেছেন বুয়েটে একবার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার মাত্র ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে। মেডিকেলে দুবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে ৫ নম্বর কেটে নেওয়া হয় প্রথমেই। সুতরাং সে সুযোগ থাকা অথবা না থাকা সমান হয়ে যায়। কারণ হাজার হাজার ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় ১ অথবা অর্ধেক নম্বরের পার্থক্যের কারণে। সেখানে ৫ নম্বর কেটে দেওয়া মানে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অনেকাংশে অলীক।
একজন আইনজীবী হওয়ার সুবাদে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলতে পারি, এ ধরনের শিক্ষানীতি চরম বৈষম্যমূলক। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে প্রার্থী নির্বাচন করে উল্লেখ করার আগে আমি প্রশ্ন করতে চাই, আমাদের দেশে যে সব শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বৎসরে ভর্তির সুযোগ পেল না, তারা কি করবে? তাদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন কি প্রতিযোগিতার স্রোতে হারিয়ে যাবে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। ভর্তির যোগ্যতা অথবা নির্ধারণ করার জন্য ভর্তি কমিটি আছে নিশ্চয়। সেই সঙ্গে সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগ নিশ্চয়ই সহযোগিতার ভিত্তিতে একত্রে কাজ করে আসছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন কখনো লক্ষ্য করা যায়নি।

শরৎকালের দৃশ্য
শরৎকালের দৃশ্য

আমার দেশে (আমি এখানে একবচন ব্যবহার করছি বহুবচন অর্থে, সুতরাং আমার দেশ বলতে আমাদের দেশই বোঝানো হচ্ছে) অনেক কিছুই হচ্ছে আবার অনেক কিছুই হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা হয়তো কিছুটা কাম্য, কিছুটা কাম্য নয়। কিন্তু যা হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক তা হচ্ছে না। আমাদের দেশে আমরা কোনো নতুন রীতি করি না, পুরোনো রীতিই বহাল রাখি। কারণ আমরা বুনিয়াদি রীতিতে অটুট থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু আমাদের দেশে আগের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান প্রেক্ষাপট যে সমান নয় সে চিন্তা করারও কেউ নেই। আমাদের দেশে পর্যালোচনা শব্দটা আজকাল খুবই বিরল। আমরা আমাদের কৃত কাজ পর্যালোচনা করি না অথবা করতে সাহস পাই না। পর্যালোচনা করার জন্য সৎ সাহস তখনই থাকে যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেরা নিজেদের কর্মে পরিতৃপ্ত যে, তার কাজে কোনো ফাঁকফোকর নেই। সর্বসাধারণের পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্তের কথা আমাদের দেশে বিরল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে আছেন তারা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসার কোনো পরামর্শ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। (চলবে)

লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত।
ফেসবুক: <shahid.shotabdi>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: