পালিত সন্তান

স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

গত সপ্তাহে আমেরিকার নাগরিকত্বের শপথ নিলাম। এটা আমার তৃতীয় নাগরিকত্ব। এর আগে হয়েছিলাম কানাডার নাগরিক। আমেরিকার নাগরিকত্ব নেওয়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম কানাডার পাসপোর্টটা দিয়েই চালিয়ে নেব। কিন্তু ট্রাম্প এসে ওভার ট্রাম্প করার কারণে বিশেষ ভরসা পাচ্ছি না। তাই, অনেকটা বাধ্য হয়েই শুভ কাজ সেরে ফেললাম। সবাই এই আমেরিকান নাগরিকত্বের আশায় যেমন উন্মুখ হয়ে থাকেন, ভেবেছিলাম সেরকম বড় মাপেরই একটা খুশি লাগবে। কিন্তু তেমন কিছু অনুভূতি হচ্ছিল না। বরং অন্য একটা অনুভূতি আর অজস্র উল্টোপাল্টা প্রশ্ন মনের ভেতরে তোলপাড় করছিল।

শপথ গ্রহণের একপর্যায়ে বলতে হয়—‘যদি দরকার হয়, আমেরিকার জন্য আমি অস্ত্র ধারণ করব।’ আমি আমার বরকে বললাম, আচ্ছা যদি, আমেরিকা কোনো কারণে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, তাহলে কি করব? শপথ তো নিয়ে নিয়েছি। সে বলল, আমেরিকা কোনো কারণে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেলে, তোমাকে অস্ত্র ধারণ করতে হবে না। তার আগেই যা হওয়ার হয়ে যাবে। তবু, আমার মন খুঁতখুঁত করে, আমি জানি আমি তখন ভেঙে চৌচির হয়ে যাব।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন এক ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা। তিনি ভিয়েতনামিজ বংশোদ্ভূত নারী। যুদ্ধের সময় তার মা দেশ থেকে বিতাড়িত হন। তিনি তখন মায়ের পেটে। তার জন্ম এক জঙ্গলে এবং জীবনের প্রথম ছয় বছর তিনি ছিলেন রিফিউজি ক্যাম্পে। তারপরে তিনি আমেরিকা এসেছেন মা ও পরিবারের সঙ্গে। এখানেই তার বেড়ে ওঠা। তার মা ঠিকমতো ইংরেজি বলতে পারতেন না। তারপরও তার ভাইবোনদের এখানে প্রতিষ্ঠিত হতে কোনো সমস্যা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই পুরো পরিবার কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ। সেই নারী ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক বছর আর্মিতে ছিলেন। জানি না তাকে অস্ত্র ধারণ করতে হয়েছিল কিনা। আমার প্রথমে খটকা লাগছিল যে, যুদ্ধের কারণে তার জন্ম জঙ্গলে, শৈশব কেটেছে রিফিউজি ক্যাম্পে, নিজ হাতে অস্ত্র নিয়ে সেরকম আরেকটি যুদ্ধে যোগ দিতে তার বিবেকে বাধল না? অনেক চিন্তা করে নিজেই উত্তর পেলাম। আমেরিকা এক অর্থে তার ও তার পরিবারের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। জীবনের বিনিময়ে যেকোনো কিছু করাই আসলে তার কাছে যুক্তিযুক্ত হওয়ারই কথা।

ফিরে আসি নিজের কথায়। শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে একটা ভিডিও দেখাচ্ছিল। সেখানে নব্য নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য কী সেগুলো দেখানো হচ্ছিল। এক সময় লেখা দেখি—‘তোমার অবশ্যই সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে তোমাকে নতুন পালক নেওয়া দেশের সেবা করতে (প্রতিদান দিতে)।’ সঙ্গে সঙ্গে আমার মন বিষাদে ছেয়ে গেল। পালিত সন্তান! আমি পালিত সন্তান? আমি কি কোনো দিন এ জীবন থাকতে আমার মা-বাবাকে ছেড়ে অন্য কোনো মা-বাবার পালিত সন্তান হতে চাইব স্বেচ্ছায়? তবে? দেশকে যদি মায়ের মতোই ভালোবাসি, তাহলে সেই দেশকে ছেড়ে অন্য দেশের পালিত সন্তান হলাম কেন স্বেচ্ছায়?

এই প্রশ্ন যেদিন প্রথম বিদেশে এসেছি তখন থেকেই মাথায় ঘুরছে। বিদেশে থাকব? নাকি দেশে ফেরত যাব? আমার মায়ের মতো দেশকে ফেলে, দেশের বুকে, আমার মা-বাবা, ভাইকে রেখে বিদেশে থেকে যাব? এই সিদ্ধান্ত কিন্তু সহজ সিদ্ধান্ত নয়। প্রচণ্ড কঠিন এক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর উত্তর আমরা আসলে জানি। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে দেশের যে সব খবর পাই, যা কিছু পড়ি, শুনি, কোনো কিছুর মধ্যে সামান্য আশার আলো দেখি না। মানুষের নৈতিক অবক্ষয়, আইন শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে কোথাও কোনো কিছুতেই সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপনের ন্যূনতম গ্যারান্টিটুকু নেই। কত কষ্টে নিজের দেশ ছেড়ে মানুষ পরবাসে পালিত সন্তান হয় সেটা শুধু আমাদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরাই জানেন।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।