ভাষা ও একটি প্রতিবাদ

আট বছর আগে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম একটি ডিপ্লোমা কোর্স করতে। ঝকঝকে সিডনি শহরের একেবারে মাঝখানে ছিল কলেজটি। জায়গাটা যেমন পছন্দ হয়েছিল তেমনি কলেজের সকল স্টাফ, শিক্ষক ও সহপাঠীদেরও সমপরিমাণ পছন্দ হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও বয়সের মানুষের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়া এবং মেশার অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও নেপাল, ফিলিপাইন, চীন, ব্রাজিল ও কিছু আমেরিকান ছেলেমেয়েও ছিল আমার ক্লাসে। প্রথম দিনই সবার সঙ্গে সবার সুন্দর আলাপ-পরিচয় হয়ে গেলেও ধীরে ধীরে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকেরই নিজের নিজের দেশ থেকে আসা মানুষের সঙ্গে একটা করে আলাদা গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে আমিই একমাত্র স্পেসিফিক কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপের সদস্য ছিলাম না। সবার সঙ্গে একই রকম ভাবে মিশতে পেরেছিলাম এবং নিজেকে ভাগ্যবতী বলতে পারি এই কারণে যে, সবাই আমাকে খুব ভালোবাসত।

আমাদের ক্লাসে পাকিস্তানিরা সংখ্যায় একটু বেশি ছিল। তবে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ওদের প্রত্যেকের ব্যবহার মার্জিত ও প্রশংসনীয় ছিল। কোর্সের শুরুর দিকে কয়েকজন ভারতীয় ও পাকিস্তানি আমার কাছে এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি হিন্দি-উর্দু বলতে বা বুঝতে পারি কিনা। আমিও ভদ্রভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, আমি হিন্দি বুঝতে ও বলতে পারি। কারণ আমাদের দেশে প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হিন্দি চ্যানেলগুলো ছোটবেলা থেকে দেখার বদৌলতে সবারই কম-বেশি হিন্দি ভাষাটা রপ্ত হয়ে যায়। তবে উর্দু আমাদের কখনো আলাদা করে জানা বা বলা হয় না। কারণ বাংলাদেশের লোকজন উর্দু সিনেমা বা উর্দু চ্যানেল তেমন একটা দেখে না। আর যত দূর আমি শুনেছি উর্দু শব্দগুলো হিন্দির থেকে আরেকটু কঠিন, আরেকটু প্যাঁচালো। এই উত্তরে পাকিস্তানিরা হেসে ফেলে বলেছিল, তোমার যদি ইচ্ছে করে তাহলে তুমি আমাদের সঙ্গে ইংলিশ ছাড়াও হিন্দিতে কথা বলতে পার, আমরা বুঝে নেব। তারা নিজেদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলত। যদি আমি সেই কনভারসেশনের মধ্যে থাকতাম তারা আমাকে বলত হিন্দি বা ইংলিশে অনুবাদ করে আবার বলবে কিনা? তাদের বিনয় ও ভদ্রতায় মুগ্ধ আমি মৃদু হেসে উত্তর দিতাম, লাগবে না, অল্প কিছু অপরিচিত উর্দু শব্দ ছাড়া তোমাদের সব কথাই আমি বুঝতে পারি। হিন্দি থেকে উর্দু বলার ধরন অনেকটা আলাদা সত্যি, কিন্তু সেটা দুর্বোধ্য নয়। তবে আমি নিজে এই ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারব না। পাকিস্তানি ও ভারতীয়—দুই দলের সঙ্গেই হিন্দি-ইংলিশ মিলিয়ে কথা বলতাম, ওভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
এই ব্যাপারটি আমার এক বাংলাদেশি সহপাঠী ছেলের সহ্য হলো না। সে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। আমার ক্লাসের বাকি যেসব বাঙালি ছাত্রছাত্রী ছিল তাদের সম্মিলিত করে আমার বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন করতে চাইল। তবে লাভ হলো না। অন্যরা কোনো এক অজানা কারণে তার সঙ্গে সহমত হতে পারল না। ছেলেটি তাতেও দমে গেল না। সে যখনই সুযোগ পেত আমাকে উদ্দেশ্য করে অন্যদেরকে জোরে জোরে শুনিয়ে বলত আমি দেশের সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে গাদ্দারি করছি। যে ভাষার জন্য আমাদের দেশের মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে সেই ভাষাকে আমি অবজ্ঞা করছি। পাকিস্তানিদের সঙ্গে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা বিস্মৃত হয়ে আমি নাকি উর্দু বলি। এতে আমি একাত্তরকে অপমান করছি এবং পুরো বাংলাদেশকে অসম্মান করছি। এটা বিরাট অন্যায়।
তবে আমার দুঃসাহসটা কতখানি সেটা সে নিজে কোনো দিন সত্যিকারের সাহস সঞ্চয় করে আমার সামনে এসে সরাসরি বলতে পারেনি। একবার ভেবেছিলাম নিজেই তার কাছে গিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করে বলি, আমি উর্দু নয়, হিন্দি বলি। অন্যরা আমার হিন্দি বলাটাকে যদি উর্দু বুঝে নেয়, সেটার দায়ভার তাদের, আমার নয়। দ্বিতীয়ত, তাদের ভাষা আমি বুঝতে পারি এটা আমার কৃতিত্ব। তারা আমার বাংলা পারে না এটা তাদের ব্যর্থতা। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের কথোপকথন সিংহভাগই হয় ইংরেজিতে। তখন কেন তুমি কোনো আপত্তি করো না? তুমি মনে হয় ভুলে গেছ ইংরেজরা দুই শ বছর আমাদের ওপর অত্যাচার করে গেছে। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে তো ইংলিশ এ কথা বলে আমরা আমাদের দাদা, পর দাদা ও সেই জেনারেশনের সবার সঙ্গে অন্যায়, অবিচার করছি। ওরাও তো কখনো আমাদের বাংলা বলে না, আমরা কেন ওদের ইংলিশ বলব, এ কথা কেন তোমার মনে হয় না?
পরে ভাবলাম থাক, তাকে এসব বলে আর কি লাভ? যার ভুল ভাবার তাকে হাজারটা সঠিক যুক্তি দিয়েও ভুল ভাঙানো যাবে না। থাকুক সে তার রাগ নিয়ে। আমার কাছে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকাটাই যথেষ্ট।
এই ঘটনার পর বেশ অনেকগুলো মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছি আজ ছয় বছরের কিছু বেশি হলো। ব্রিটিশ নাগরিকত্বও হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। এখন বাইরে গেলে ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষায় কখনোই কারও সঙ্গে কথা বলা হয় না। বিশেষ করে হিন্দি-উর্দু ভুলেও উচ্চারণ করি না। কারণটা বলি, এ দেশে আসার পর থেকে এ দেশের বসবাসরত পাকিস্তানিদের মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। তারা প্রথমে পাকিস্তানি কিনা জিজ্ঞেস করে। যখন বলি, নো, বাংলাদেশি। সঙ্গে সঙ্গে তারা উর্দুতে কথা বলা শুরু করে। তারা ধরেই নেয়, বাংলাদেশি মানেই আমরা উর্দু পারি বা পারব। এক-দুইবার নয়, গত ছয় বছরে ইংল্যান্ডে যত পাকিস্তানির সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় হয়েছে সেটা একজন দোকানদার থেকে শুরু করে একজন চাকরিজীবী, অল্প বয়সী তরুণ থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন, তাদের সবার মধ্যে এখনো এই ধারণা রয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ মানেই আমরা এখনো তাদেরই পার্ট, তাদেরই একটা অংশ। তাই আমরা অবশ্যই উর্দু বলতে বা বুঝতে পারবই। আমরা আদতে ওই ভাষাটা বলতে পারি বা বলতে চাই কিনা সেটা শুধোনোর প্রয়োজন তারা বোধ করে না।
অস্ট্রেলিয়াতে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে পড়তে আসা পাকিস্তানিদের সঙ্গে ইউকের নাগরিক হিসেবে থাকা পাকিস্তানিদের স্বভাবের এই বৈপরীত্য আমাকে সব সময় বিস্মিত করে। যদিও এখানকার পাকিস্তানিরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চেষ্টা করে আমরা আর তারা ভাই ভাই। তবু কেন জানি না, ওদের এই আপন ভাবাটা ও আমার কানে পরিহাসের মতো শোনায়। বাংলাদেশি জানার পরও তারা যখন বিনা অনুমতি নিয়ে নির্দ্বিধায় উর্দুতে কথা বলা শুরু করে আমার অসহ্য বোধ হয়। প্রথম প্রথম ভীষণ আত্মসম্মানে লাগত। অনেক কষ্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কঠিন গলায় জানাতাম, সরি তোমার ভাষা আমি জানি না, কি বলছ সেটা ইংলিশে বলো। এটা শুনে তারা অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থাকত। সেই দৃষ্টিতেও আমি একধরনের বিদ্রূপ অনুভব করতাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেভাবেই হোক, এর মোকাবিলা শক্ত ভাবেই করতে হবে। যত দিন যেতে লাগল তত বেশি করে আমি তাদের এই অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের প্রতিবাদ জানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। তেমন কিছুই হয়তো আজ পর্যন্ত আমি করতে পারিনি বা পারি না, তবে এটুকু ঠিক যে, কেউ যদি আমার সঙ্গে উর্দুতে কথা শুরু করে, আমি কড়া স্বরে তাদের চোখে চোখ রেখে বলি যেটা বলেছ সেটা ইংলিশে রিপিট করো। কারণ আমার পক্ষে তোমার ভাষায় কমিউনিকেট করা সম্ভব নয়। ওই ভাষাটা আমি শিখিনি।

লেখিকা
লেখিকা

এখানের স্কুলগুলোতে জব নিতে গেলে যে সিভি রেডি করতে হয় সেখানে আর কোন কোন ভাষা জানি সেটা মেনশন করলে কাজ পেতে সুবিধে হয়। আর সবার মতো আমিও তাই সিভিতে বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি ও উর্দু এই চারটি ভাষা জানি মেনশন করে সিভিটি সমৃদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু আজ অবধি কাজের ক্ষেত্রে ওই দুটি ভাষা আমি প্রয়োগ করিনি এবং নিতান্ত নিরুপায় না হলে আমি এই ইংল্যান্ডে কখনোই ওই ভাষায় ব্যবহার করে কথা বলব না বলে সংকল্প নিয়েছি।
আজ যখন আমি কোনো উর্দু বা হিন্দি ভাষাবাসীর সংস্পর্শে আসি এবং শুধুমাত্র ইংলিশে কথোপকথন করি তখনই আমার সিডনির কলেজের সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ে। সে আজ কোথায় আছে, কেমন আছে আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, আজকের আমাকে দেখলে বা জানলে তার আমার প্রতি ক্ষোভ ও অভিযোগ দুটোর কোনোটাই হয়তো আর থাকত না। সে বুঝতে পারত, আমার দেশ বা আমার ভাষাকে আমি কখনোই ছোট করিনি। যে বা যারা আমাকে, আমার দেশকে, আমার ভাষাকে সম্মান করেছে আমি তাদের প্রতি সহৃদয় ছিলাম মাত্র, কিন্তু যখনই আমি অনুভব করেছি আমার ভাষা বা আমার দেশ তার যোগ্য সমান পাচ্ছে না তখনই আমি আমার নিজের মতো করে দৃঢ়তার সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেছি এবং সব সময় করব। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও আমি আমার দেশকে এবং আমার মাতৃভাষাকে হৃদয়ে অতি যত্নে ও শ্রদ্ধায় লালন করি এবং আমৃত্যু করে যাব।

সারা বুশরা: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী।