স্বপ্ন হবে সত্যি

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের ভাষা দিবস উদ্‌যাপনে সপরিবারে লেখিকা
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের ভাষা দিবস উদ্‌যাপনে সপরিবারে লেখিকা

স্বপ্নটা আমার মেয়ের বাংলা শেখা নিয়ে। আমার মেয়ে সুমাইরা নূরীণ খান। বয়স আট। মিন্টোর ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আমার মেয়ে যখন আমার পেটে, সবাই বলত কথা বলবে বাচ্চাটার সঙ্গে, ওরা শুনতে পায়। তো আমার স্বামী ডাকত ‘বাবা, বাবা’। জানি না বাচ্চাটা শুনত কিনা? আমার স্বামী আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে গান শোনাত। প্রতিদিন একটাই গান—‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। তারপর ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে পেনড্রাইভে দিল যেটা, আমি প্রতিদিন গাড়ির সিডি প্লেয়ারে বাজাতাম। যখন মেয়ের জন্ম হলো ওর বাবা ডাকল ‘বাবা’। আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কয়েক মিনিট বয়স্ক আমার মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজছিল কে ডাকছে ওকে সেই পরিচিত নামে। প্রেমে পড়ে গেলাম আমার ছোট্ট মেয়েটার।

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের অভিভাবক ও শিক্ষিকাদের সঙ্গে লেখিকা
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের অভিভাবক ও শিক্ষিকাদের সঙ্গে লেখিকা

সুমাইরার ঘুমের সমস্যা ছিল। অনেক সময় নিত ঘুমাতে। আমাদের ঘরে একটা বিরাট আয়না ছিল। ও আয়নার দিকে ফিরে শুতো আর আমি আয়নার উল্টো দিকে চেয়ারে বসে থাকতাম। তো সুমাইরা আয়না দিয়ে আমাকে দেখত আর জোরে জোরে আওয়াজ করে কিছু বলত। এভাবেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। কমিউনিটি নার্স আসত বাসায় ওর ঘুমের প্যাটার্ন ঠিক করার জন্য। আমি নার্সকে বললাম যে, ও প্রতিদিন এইরকম আওয়াজ করতে করতে ঘুমায়, এটার কারণ কি হতে পারে? নার্স বললেন, বাচ্চারা দুইভাবে ঘুমায়—এক-খুব কান্না করে, আরেক-ওরা গান গায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মেয়ে ও আমার দেশের মাটি গানটাই গেয়ে গেয়ে প্রতি রাতে ঘুমাত। এই আমার মেয়ে। আধো আধো বোলে বাংলা বলত। আস্তে আস্তে পুরো বাঙালি। বাংলা কথা, বাংলা গান, বাংলা ছড়া এমনকি বাংলা নাচ। সাড়ে তিন বছর বয়সে গ্লেনফিল্ড লোকোমেলায় স্টেজে ‘চুড়ির তালে নুড়ির মালা’ নাচ করে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল।

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের গানের ক্লাস
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের গানের ক্লাস

সমস্যা শুরু হলো যখন প্রি স্কুল শুরু করল। ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত, যদিও আমরা বাসায় বাংলা বলতাম ওর সঙ্গে। বাংলাদেশে গিয়ে শহীদ মিনার আর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর খালামণি ওকে কয়েকটা শিশুদের বাংলা গল্পের বই কিনে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ফিরে এসে প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বলত, মা, আমাকে পাঁচ পরির গল্পটা শোনাও। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নিজে পড়তে ইচ্ছে করে না? উত্তরে ও বলেছিল ‘করে’। ব্যস আর কোনো দিকে তাকাইনি। ক্যাম্পবেলটাউন বাংলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। প্রথম প্রথম যেতে চাইত না। বাসায় পড়ানো শুরু করলাম স্কুলের পাশাপাশি। ধীরে ধীরে পড়তে শিখল। এখন বানান করে করে পড়তে পারে এবং অনেক আগ্রহ নিয়ে বাংলা পড়ে।
আমার স্বপ্ন হচ্ছে আমার মেয়ে বাংলা বলতে ও পড়তে পারবে। বাংলার বিখ্যাত গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা সম্পর্কে জানবে। কবি–সাহিত্যিকদের চিনবে। বাংলাদেশকে জানবে। বাংলার মানুষের কাছাকাছি যেতে ভাষা যেন কোনো বাধা না হয়। আর আমাকে আমার প্রিয় বাংলা গানগুলো গেয়ে শোনাবে অথবা পিয়ানোতে গান তুলবে। আমি জানি আমার স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে।

রুমানা খান: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।