চাঁদের প্রদক্ষিণ পথে

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

রুদ্রমূর্তি এক আপদ। আর বিপদ ছিল ওখানে মহাকাশ যান ভেড়ানো। মহাশ্বেতার গা কাঁপতে থাকে। তখনো তার ভয় জড়ানো কণ্ঠ।

—একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ। জয়িতার ঠোঁট কাঁপে। সে মহাশ্বেতার স্পর্শ ছাড়তে চায় না।
—বরফ কি তুলা, কিচ্ছু ধারণা করার উপায় নেই। কীভাবে টের পাওয়া সম্ভব! তুলা কিংবা মেঘ সবই এক রকম মনে হয়। মহাশূন্যে এ এক বড় বিড়ম্বনা!
কল্পিত পৃষ্ঠের ওপর তলা নিয়ে কথা বলে মহাশ্বেতা।
বরফ হলে এর সঙ্গে ঘর্ষণে শেষ হয়ে যেতে পারত মহাকাশ যান। জয়িতার ভেতরেও আতঙ্ক।
সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মহাশ্বেতার মুখ নিচের দিকে। সে বলে, তুলার মতো কিছু হলেও ডুবে যেতে পারতাম আমরা।
এরই মধ্যে আকাশে প্রতিধ্বনিত হয় এক কণ্ঠ। এত সাহস কে দিল তোমায়?
একই ধরনের গায়েবি আওয়াজ।
বলো বলো বলো হে বালিকা! আ-আ-আ... ...ছড়িয়ে পড়ে এ কণ্ঠ চরাচরে।
জয়িতার চোখ পর্দার নিচের দিকে। তাপ-চাপ খেয়াল করে সে। দেখে, পৃথিবী থেকে এখানকার দূরত্ব! এ যে চন্দ্রের প্রদক্ষিণ পথ!
—কার এত স্পর্ধা, চন্দ্রে করে প্রবেশ!
উত্তরের অপেক্ষা করে এ কণ্ঠ। না হলে যেন শান্তি নেই।
—এমন কে চন্দ্রের প্রদক্ষিণ পথে করে বিচরণ! না, না সহ্য করা যাবে না! আ-আ-আ।
—আমরা চন্দ্রের লক্ষ্যে। আমরা চন্দ্রে যাব।
জয়িতা পরিষ্কার করে কথাগুলো বলে। এ সময় তার চোখে মুখে বিস্ময়।

তারা এই একটা প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে এল। মাঝে দম ফেলানোর সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। এরপর বুঝি আরেকটা পর্যায় মোকাবিলা করতে হচ্ছে! আচমকা এই অবস্থায় ওরা কি আসলেই ভয় পেল? ভয় পাওয়ারই কথা। ওদের মুখে কথা সরে না।
হা হা হা। আবার আওয়াজ। এবার আওয়াজের সঙ্গে আগুনের ফুলকি।
—কে, কে তুমি? জয়িতার চিকন গলা কিন্তু টানা জিজ্ঞাসা তার। কি চাও, কি চাও তুমি?
—প্রশ্নটা আমার। আমার…আমার...। প্রতিধ্বনি আসে কানে।
—চন্দ্রে যাব আমরা। সে জন্য তুমি, তুমি যেই হও, মহাশূন্য যানের বাধা হতে পার না।
জয়িতা রাখ ঢাক করে না। সে চট জলদি বলেই ফেলে।
—মুখে তোমার মাতৃদুগ্ধের গন্ধ। এ পথ তোমার নয়। তুমি ফিরে যাও তোমার পৃথিবীতে।
আদেশ না নির্দেশ বোঝা যায় না। উদ্ধত এ বাক্য। জড়ানো কোনো কণ্ঠও নয়।
এ পটভূমিতে জয়িতা তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। পৃথিবী শব্দটি তার হৃদয়ে বাজে। শত্রুও যদি এই শব্দটি উচ্চারণ করে তাতেও সে নতুন অবলম্বন খুঁজে পায়। সে সপ্রাণ হয়ে ওঠে। তবে তার পরও এ বেলা সে উচ্চ কণ্ঠ হয় না।
শুধু প্রিয় নামটি জপে, পৃ-থি-বী!

আমরা পৃথিবীর কল্যাণে গ্রহ থেকে উপগ্রহে। পৃথিবীর মানুষের উন্নতির জন্য আমাদের ছুটে চলা। মহাশ্বেতা বলে যায়। আমাদের স্বপ্ন পৃথিবী নিয়ে, ঠিক নামটিই উল্লেখ করেছ তুমি।
পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল চেয়ে আমরা চন্দ্রে গবেষণা করব। চন্দ্রকে করব মানুষের বাসযোগ্য গ্রাম। জয়িতার মুখটি চাপা এক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

মহাশূন্যে আছে কত আবর্জনা! গ্যাসীয়, পাথুরে কত জঞ্জাল। কত পাহাড়-পর্বত, কত নদী-সাগর কে জানে! এই পথে আছে দৈত্য-দানব কত কী! সেই বিবেচনায় তাদের কথাবার্তাও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। তারা এক কদম এগোয়তো দুই কদম পেছায়। দুই কিশোরীর মুখে তাই আনন্দ আর শঙ্কার মিশ্রণ। এ কারণে তাদের কণ্ঠও এক হয়ে যায়।
আমাদের আনন্দ, আমরা কল্যাণকামী। আমাদের তৃপ্তি, পৃথিবীর মানুষের জন্য আমরা নিবেদিত।
আমাদের শিক্ষা, আমরা আলো জ্বালব পথে। আমাদের প্রত্যয়, আমরা সবাইকে নিয়ে যাব সামনে।
ওদের হাত পা নড়ে ওঠে। যেন সব বাধা পেরিয়ে তারা চলছে মশাল হাতে।

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

—চন্দ্রলোকে কর্দমাক্ত পৃথিবীর কথা শুনতে চাই না আমি। যাও যাও ফিরে যাও তোমরা তোমাদের কুটিরে।
একই কণ্ঠ, একই ভাষ্য! প্রকৃতিও যেন চুপ।
ইতিমধ্যে বিশাল এক ওলট পালট অবস্থা! হতে পারে তা প্রমত্ত নদীর ঢেউয়ে পার ভাঙার শব্দ, কিংবা মহাশূন্য থেকে স্যাটেলাইট। পতনের সে আওয়াজ গোটা প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনে। ওরা এদিক-ওদিক তাকায়। মানে? এর আসল অর্থ খোঁজে দুই জোড়া চোখ।
পৃথিবী নামক গ্রহটি আজ মানুষের। কালে কালে কত দেবতা-অপদেবতা এই ভূখণ্ডের আধিপত্য নিতে চেয়েছে। কত দস্যু এসেছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অজুহাতে। কিন্তু তারা দখল নিতে পারেনি। মানুষ তার অধিকার বলে, সত্যকে বুকে নিয়ে মোকাবিলা করেছে প্রতিটা পরিস্থিতিকে। আজ সেই তার আমানত, সেই জায়গাটিকে নির্দেশ করবে কর্দমাক্ত বলে! এ বড় বেমানান, অসহ্য! মহাশ্বেতা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। এ কাঁপুনি জয়িতাকেও নাড়ায়।
চন্দ্রের আলো পবিত্র। অপবিত্র তোমার কথা। পৃথিবী মাটির, তবে অস্পৃশ্য নয়। রাক্ষসের বাচ্চার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয় জয়িতা। কিন্তু সে মেজাজ সামলে নেয় বড় কষ্টে।
এখানে ঘুমিয়ে আছে রাজকন্যা। সারা রাত পরিদের সঙ্গে ঘুরেছে। এখন গভীর নিদ্রায়। গলার স্বর নামে রাক্ষস বাচ্চার। এবার একটু ধীরে ধীরেই কথাগুলো বেরোয় তার মুখ থেকে।
জয়িতার মনে পড়ে পৃথিবীর কন্যার কথা। সেও এক রাজকন্যা। তার ফুলের বাগান আছে। পরিরা তার সহচরী। বোধ করি এখানেও সেই একই গল্প। সুতরাং এই রাজকন্যার শান্তি সে নষ্ট করবে কেন!
পৃথিবীর রাজকন্যা সুরঞ্জনা। মধুমতির ছন্দ তার চলায়, কাব্য তার কথায়। এ কারণে নাচ হয়ে ওঠে তার চর্চার বিষয়। রাজ বাড়ির বাগান মানে রাজকন্যারই। সেখানে নাচের আসর বসে সহচরীদের নিয়ে।
বাগানের এ আসরে আসে পরিরা। তারা এখানে নাচে-গায়। কখনোবা ওড়ে। এ ডাল থেকে ও ডালে যায়। জ্যোৎস্না রাতে তারা আনন্দময় করে তোলে চরাচর।
একবার একটা ঘটনা ঘটে যায়। পরিদের সেখানে অসম্মান করা হয়। এটা ছিল ধারণার বাইরে। রাজকন্যার কাছে দূরের সখীরা এসেছে সে পূর্ণিমায়। তারা গলা ছেড়ে গান গাইছে। প্রকৃতির বন্দনা করছে। হে বসুন্ধরা, তুমি আছ বলেই আমরা এত সুখী। তুমি মহান। তুমি এত উদার বলেই বৃক্ষ দিয়ে সাজিয়েছ এই পৃথিবী। তুমি শান্তির বলে তোমার গাছে গাছে পাখি ডাকে, গান গায়। নৃত্যও তাদের একই রকম দোলা দেয়।
আনন্দ আনন্দ আবেশে নাচে রাজকন্যার সহচরীরা। স্বর্গীয় এক ঘোরের মধ্য দিয়ে নাচ চলে দীর্ঘক্ষণ। এ আসরে পরিরাও নাচবে। কিন্তু সময় কমে যেতে থাকে।
অসন্তোষ প্রকাশ করে ছোট। ওরা সাত বোন।
—আমরা নাচব। নাচব এই পূর্ণিমা রাতে।
—একটু দেরি করতে হবে। সহচরীর যেজন সঞ্চালনা করে সেই বলে।
—আচ্ছা! ছোট পরি ফিরে যায়।
সময় যায়।
একটুখানি দেরি কর। সেজ পরি, মেজ পরি ফিরে যায়।
সবশেষে বড় পরিকেও ফিরে যেতে হয়।
ওদের সাত বোনের মুখে অন্ধকার নেমে আসে।
জন্ম থেকে পরিরা জানে ফুলের মধ্যে ওদের চলাফেরা। ফুল ওদের প্রিয়। ফুল ওদের মাথায়, ফুল বেণিতে, কনুইতে। ফুলময় তারা। পরি কন্যারা ফুলের বাগানে আসে বলে সেখানে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে চলে। ফুলের গন্ধ পরিবেশকে মিষ্টি করে তোলে। দূর পথে জ্যোৎস্না রাতের পথচারীরা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এলাকায় পরিদের অস্তিত্ব অনুভব করে তারা।
ভাগ্যবান সে মানুষেরা ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ করে। ঈশ্বরের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। এ তাদের কৃতজ্ঞতা। হে ঈশ্বর ওরা যেন এখানকার এই বাগানে নিরুপদ্রব থাকতে পারে! তাদের শান্তি মানে, এলাকার মানুষের সুখময় জীবন।
রাজকন্যা এগিয়ে আসে। তাদের আহ্বান জানায়, নাচের মঞ্চে।
ততক্ষণে সূর্য উঠি উঠি।
না, আর সময় নেই হাতে। বড় কন্যার হাত ধরে ছোটরাও একটু দূরে দাঁড়ায়।
সঞ্চালক আসে রাজকন্যার সামনে।
—যাক ওরা, তুমি নাচবে এখন!
—আমি? কিন্তু ওরা যে...।
রাজকন্যাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সঞ্চালক বলে, দেখ, ওরা সুন্দরী তুমিও অপ্সরা। ওরা শাড়ি পরেছে, তুমিও শাড়িতে লাবণ্যময়ী।
কিন্তু ওরা তো অতিথি। রাজকন্যা বলে, ওরা স্বর্গের বর কন্যা ওদের মুখ দিয়ে জ্যোতি বেরোয়।

তোমার অঙ্গ থেকে ঝরে পড়ে সৌন্দর্য। তা দেখে আমরা ধন্য হই।
সঞ্চালক তার নিজস্ব অনুভূতি ঢেলে দেয়।

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সে কথা ভিন্ন। ওরা আমাদের ফুল বাগানের...।
এবারও রাজকন্যার কথা শেষ করতে দেয় না সঞ্চালক। সে বলে, অতিথি তা ঠিক তবে কে দেবে তাদের আলাদা মর্যাদা!
এ বুঝি সঞ্চালকের অভিযোগ। কিন্তু তারা কি অতিরিক্ত কোনো মর্যাদা চেয়েছে? যেটা চেয়েছে সেটা অনিবার্য। ওরাতো এই মাটির পৃথিবীর নয়।
সঞ্চালক পরি কন্যার দিকে লক্ষ্য করে বলে, তোমরা সরে যাও! এ বাগান তোমাদের জন্য নয়, রাজকন্যা কেবল নাচবে এখন।
পরিরা পরস্পরের দিকে তাকাতাকি করে।
মানে? সাত কন্যার মেজটিই তাদের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলে।
অন্যদের মুখে কোনো কথা সরে না। সঞ্চালক তার মতো করে সঞ্চালনা করে চলতি এ পর্ব।
মেজ বলে, ঠিক আছে।
বলছি তো, এ বাগান রাজবাড়ির। এ আমাদের স্বর্গ। তার কণ্ঠ মাটির সমতল থেকে গাছের ডাল পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
আচ্ছা! মেজ কন্যা মেনে নেয়। পরিরা কখন ও ঝামেলায় যায় না। সেও তাই কিন্তু ভেতরে কষ্টটা রয়ে যায়।
রাজকন্যাই এখানকার প্রধান। সঞ্চালকের কণ্ঠ আগের মতোই ঝাঁজালো। এখনো তোমরা দাঁড়িয়ে!
রাজকন্যা নরম প্রকৃতির। কখনো নিজের ন্যায্য কথাটি জোর দিয়ে বলতে পারে না। আজকে আরও পারেনি শুরুতে বিষয়টির প্রতি অমনোযোগী থাকার কারণে।
সূত্রধর থেকে সূত্র কন্যা, সেই সঞ্চালক। আজকের কর্মসূচি তারই দেখার কথা। সে-ই দেখেছে। মা দীর্ঘদিন রাজবাড়ির অন্দর মহলের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। এ বাড়িতে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। এই ধারাবাহিকতায় তার কন্যারও তেমন প্রভাব! সূত্র কন্যা মনে করে, এটা তার অধিকার। তার খবরদারিতে প্রকৃতি মাথা নোয়ায়। ধরণি কাঁপতে থাকে।
ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। পরিরা চলে যায় তাদের নিজস্ব ধামে।
জয়িতারও তন্দ্রা কেটে যায়।

জয়িতা রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
আগেই বলেছি রাজকন্যা ঘুমিয়ে। রাক্ষস বাচ্চা আবারও চিৎকার করে ওঠে।
জয়িতা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, তার সঙ্গে কথা না বলে আমরা যাব না!
যেতে পারি কিন্তু কেন যাব? মহাশ্বেতা আরও একধাপ এগোয়। যেন আর তোয়াক্কা নয়।
গড় গড় শব্দ মহাকাশ যানের। এ শব্দ পিশাচের পক্ষের কোনো ঘোষণা নয়। এ শব্দ পৃথিবীর মানুষের পক্ষে। এ শব্দ অধিকারের—এ শব্দ নিজেরটুকু বুঝে নেওয়ার। জয়িতা মনে করে, চন্দ্র মানুষের। এ সম্পদ, এ ভূমি অন্য কারও নয়, পৃথিবীর মানুষের। সে তার দুই ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে। জয়িতার বেলায় বোধ হয় এটাই অধিকার বুঝে নেওয়ার দৃঢ়তা।
রাক্ষস বাচ্চা চন্দ্রের দ্বার আরও একবার শক্ত করে বাধার ইঙ্গিত দেয়। তার দেহের ভাষা দিয়ে সেটাই সে বোঝায়। এ সময় প্রচণ্ড এক শব্দ হয়। সে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে। উচ্চারণ করে, ব-ন-ধ।
চন্দ্রের রাজকন্যার মুখটি ভাসে জয়িতা-মহাশ্বেতার সামনে। তারা মেলায় দুই কন্যাকে। একজন চন্দ্রের, একজন পৃথিবীর। একজনের মুখ আনে আরেক জনের সামনে। একজন নাচে, আরেকজনও। একজন পরিদের নিয়ে বাগানে আসর বসায়, আরেকজনও। একজন ফুল তোলে, আরেকজনও। তারা শান্তির সহাবস্থান খুঁজে পায়। তাদের সামনে ভেসে ওঠে পবিত্র এক চিত্র। (ক্রমশ)

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: