চুরি বিদ্যা ও বিদ্যা চুরি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সিঁধেল চুরি করা যেমন চৌর্যবৃত্তি, ব্যাংকের টাকা চুরি করাও চৌর্যবৃত্তি। তেমনি মানুষের কথা, ভাবনা কিংবা উদ্ভাবন চুরি করাও চৌর্যবৃত্তি। কথা, লেখা, সুর, উদ্ভাবন-আবিষ্কার এগুলো হলো ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির মালিক থাকেন। স্বত্বাধিকারী থাকেন। মালিকের অনুমতি না নিয়ে অথবা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে সেটাকে নিজের নামে ব্যবহার করা অপরাধ। অন্যায়। অন্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিকে নিজের নামে ব্যবহার করা বা প্রচার করাকে বলা হয় কুম্ভিলতা (Plagiarism)।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কুম্ভিলতার (Plagiarism) অভিযোগ উঠেছে। এই সংবাদটা অসম্ভব দুঃখজনক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই কুম্ভিলতা সেখানে অহরহ হচ্ছে। দেশের বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রমোশনের জন্য এই কাজটি করছেন। নামে-বেনামে, ভিত্তিহীন, অস্তিত্বহীন জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করছেন। সেসব পাবলিকেশন দেখিয়ে প্রমোশনের নিচ্ছেন। আমরা আদতে চৌর্যবৃত্তির চক্রেই বাস করছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা পাসের জন্য প্রশ্ন চুরি করছে আর তাদের পথপ্রদর্শকেরা প্রমোশনের জন্য গবেষণাকর্ম বা লেখা চুরি করছেন।

আমি যে গবেষণা করি, সেটার ফলাফল গবেষণাপত্র আকারে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করি। সেসব কাজ যদি কেউ আমার নাম উল্লেখ না করে ব্যবহার করেন, তাহলে সেটা অপরাধ। কেউ যদি একই ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করেন কিন্তু আমার কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করেন, তাহলে সেটা অনৈতিকতা (unethical)। এই কাজ করলে মৌলিকত্ব নষ্ট হয়। অজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। স্বত্বাধিকারী হুমকিতে পড়েন। তাই কুম্ভিলতারও শাস্তি আছে। কয়েক বছর আগে রসায়নের এক অধ্যাপক কুম্ভিলতায় ধরা পড়েছিলেন। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (ACS) তাঁকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। তিনি এসিএস জার্নালে কোনো দিন তাঁর গবেষণাকর্ম প্রকাশ করতে পারবেন না। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি সেটা করেছেন, সে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিদায় দিয়েছে। উন্নত সমাজে কুম্ভিলতাকে শক্ত হাতে দমন করা হয়।

চুরি করার কৌশলই হলো চুরি বিদ্যা। মানুষ জন্মগতভাবেই সেটা নিয়ে আসে। যে চুরি করে না, সেও জানে চুরি কীভাবে করতে হয়। তবে সে বিদ্যা প্রয়োগ করাই অপরাধ। মানুষ খাদ্য চুরি করে। অর্থ চুরি করে। দুর্নীতি, ব্যাংক চুরি, অর্থ চুরি এগুলো সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বিদ্যা চুরি। নিজে বিদ্বান না হওয়া সত্ত্বেও অন্যের বিদ্যাকে নিজের নামে ব্যবহার করা ভয়ংকর অবক্ষয়। বিদ্যা চুরি করলে সমাজ মূল থেকে পচে যায়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যে সমাজে বিদ্যা চুরি হয়, সেখানে সত্যিকারের বিদ্বান-বিদগ্ধরা থাকে না। থাকতে পারে না। কারণ, বিদ্যা চুরি করা লোক, বিদ্বানের মূল্যায়ন করতে জানেন না। তার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য, তার চেয়ে নিম্নমানের কাউকে দরকার হয়!
গবেষণার মৌলিকত্ব, ধারা, নিয়ম-নীতি কিংবা কুম্ভিলতা ও এর পরিণাম ইত্যাদি বিষয়গুলো একজন গবেষক তার যৌবনে শেখেন। কেউ যখন পিএইচডি-পোস্টডক করেন তখন গবেষণার বিভিন্ন বিষয়গুলো শিখে নেন। তাই গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া যখন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হন তখন বিদ্যা চুরির মতো অনৈতিক কাজ হরহামেশা হয়। এই যে গবেষণা হচ্ছে, যেভাবে-সেভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে, প্রমোশন নিচ্ছে—এগুলো দেখার কি শক্ত কোনো অভিভাবক আছে? নেই। আজকে যদি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌলিক গবেষণা চর্চা থাকত, যদি গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া না হতো, যদি গবেষণার ভিত্তিতে প্রমোশন, বেতন-ভাতা ইত্যাদি নির্ভর করত তাহলে প্রচুর গবেষক তৈরি হতো। গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে উঠত। কুম্ভিলতার মতো এমন অবক্ষয় দমন করার মতো মানুষ তৈরি হতো। আজকে সেই পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে, অর্থ ও সামাজিক প্রতিপত্তি দেখিয়ে শিক্ষক ও নামধারী গবেষকরাও অনৈতিক কাজ করছেন। দ্বিধা-সংকোচহীন চিত্ত উঁচিয়ে চলছেন। দেশের মানুষের করের টাকায় বেতন ভোগ করছেন।
একটা ক্রিকেট ম্যাচ হারলে দেশের মানুষ হই-চই শুরু করে দেন। জলাবদ্ধতায় নগর ডুবলে মানুষ চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। অথচ একটা দেশের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যখন কুম্ভিলতায় জড়িয়ে আছেন, সেটা নিয়ে মানুষের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। অথচ সেটা নগর ডুবির চেয়ে কোনো অংশেই কম উদ্বেগজনক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কুম্ভিলতার ঘটনাকে যারা তদন্ত করছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, অভিযুক্তরা যদি সত্যি সত্যি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন তাহলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। বিদ্যা চুরির হাত থেকে বাঁচান এ সমাজ! প্লিজ!

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>