বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

লেখক
লেখক

আগের পর্বে পর্যালোচনা নিয়ে লিখেছিলাম। লেখা প্রকাশের পর আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমরা কেন বাংলাদেশে ফিরে যাই না তা গত পর্বে কেন স্পষ্ট করে লিখলাম না। সংগত কারণে তাঁর নাম এখানে উল্লেখ করলাম না। যদিও আমি জানি আমার বিভিন্ন লেখা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে কেন প্রবাসীরা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী নন। তারপরও আমার বন্ধুর সমালোচনা যত্ন সহকারে শুনলাম। বিদেশে বসবাস করে অন্তত ধৈর্য সহকারে শোনার অভ্যাস আয়ত্তে নিয়ে এসেছি। আমাদের দেশে এই ‘শোনা’ বিষয়টি খুবই বিরল। আমাদের দেশে মন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষক বা কোনো অফিসের কেরানিই বলুন, আমরা কেউই শোনা পছন্দ করি না। আমরা চাই অন্যরা আমাদের কথা শুনুক। আমরা বলতে অধিক পছন্দ করি।

যা হোক, আমার বন্ধুর ফিডব্যাক আমার লেখার মান উন্নয়নের জন্য খুবই জরুরি। একজন লেখকের মূল্যায়ন অত্যন্ত আবশ্যকীয়। তা আসবে পাঠকদের কাছ থেকে। লেখকের ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায় প্রতিটি লেখায় একটি শিক্ষামূলক বিষয় থাকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে একজন লেখক থাকেন পরিবর্তনের অন্বেষণে। অন্তত আমি তাই মনে করি। কিন্তু আমার এই ধারাবাহিক রচনার বিভিন্ন পর্বে আমি আমার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা ও একই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলনা করার চেষ্টা করি। অথবা কখনো কখনো পাঠকের হাতে বিচার ছেড়ে দিই। সোজাসাপ্টা ও সারসংক্ষেপে যা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো আমরা থাকি প্রবাসে কিন্তু আমাদের হৃদয় পড়ে আছে বাংলাদেশে। আমরা বাংলাদেশ ভালোবাসি। আমাদের মাতৃভূমি ও জন্মভূমি ভালোবাসি। আর জন্মভূমি কে না ভালোবাসে! এই প্রবাসে আবাসকে আমি নির্বাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছি।

আমাদের দেশে আমরা কেন ফিরে যেতে চাই না? এক নিরাপত্তার অভাব এবং দুই আমাদের বাচ্চারা আধুনিক ও উন্নতমানের পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এ ছাড়া আছে আরও অনেক কারণ। হসপিটালে যাওয়ার আগেই রোগী মারা যাবে রাস্তায় অনর্থক বা অহেতুক ট্রাফিক জামের কারণে। রাস্তায় বের হলে মোবাইল ফোনের জন্য আমার মতো আরও একজন মানুষ আমাকে খুন করে ফেলতে পারে, যার বিচার পাওয়া হয়তো যাবে না। ভেজাল খেয়ে খেয়ে আমাদের দেশে মানুষ ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আরও অনেক কারণ উল্লেখ করতে পারি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তিন তিনটি হাসপাতালে অ্যাডমিশন নিতে ব্যর্থ হলে আমার দেশে আমার বোন রাস্তায় বাচ্চা প্রসব করে। যে বাচ্চাকে সেই বোন বাঁচাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। আমার দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরা হাতাহাতি করেন, মারধর করেন একে অপরকে। তাই আমি ভাবি তাদের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা কি শিখবে! আমাদের দেশে বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। একজন আইনজীবী হিসেবে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি এই ভেবে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন অনেক এগিয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে। আমাদের চিরাচরিত রীতিনীতি আমরা যাচাই বাছাই করছি না, বদলাই না সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে।

গত পর্বে উল্লেখ করেছিলাম আমরা পর্যালোচনার প্রয়োজন মনে করি না। পর্যালোচনা নিয়ে আমার বিদেশের অভিজ্ঞতার সামান্য অংশ সংগত কারণেই পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। আমি প্রায় ২০ বছর হলো ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। পড়াশোনার জন্য এসেছিলাম। এসেই আমি ব্যারিস্টার অথবা সলিসিটার হিসেবে কাজ শুরু করিনি; তা বলাই বাহুল্য। এখানে এসে প্রথমে ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করেছি সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ঘণ্টায় বেতন ছিল চার পাউন্ড। বর্তমান বেতনের দুই শতাংশ মাত্র। দেখলাম আমাদের (কর্মচারীদের) কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করা হচ্ছে, পর্যালোচনা করা হচ্ছে কীভাবে খাবারের মান উন্নত করা যায়; অথবা ভোক্তারা বিক্রেতার কাছ থেকে অতিরিক্ত কী আশা পোষণ করেন।
এই কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করতে চাকরিদাতা একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে ভোক্তাদের (কাস্টমারদের) কাছে বিতরণ করেন। মান নিরীক্ষা করতে পাঁচ মিনিটের একটি জরিপ চালানো হয় কিংবা আরও অধিক মানসম্পন্ন খাবার কীভাবে পরিবেশন করা যায় তাদের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয় জরিপের মাধ্যমে। কিন্তু বেশির ভাগ ভোক্তা ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকে তার খাবারটা খেয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে চান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তারা আরও পাঁচ মিনিট নষ্ট করতে চান না। তাই এই ভোক্তাদের প্ররোচিত করতে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। যারা এই জরিপে অংশ নেন তাদের একটি রসিদ দেওয়া হতো। যা তারা পরবর্তীতে দোকানে এসে দেখালে পাঁচ পাউন্ডের খাবারে এক পাউন্ড ডিসকাউন্ট দেওয়া হতো।
কেন এই ডিসকাউন্ট দেওয়া হতো? যাতে ভোক্তারা জরিপে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত হন। এ দেশে প্রতিটি সেক্টরে এই জরিপকাজ লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি টার্ম শেষে শিক্ষকের কর্মক্ষমতা অথবা পড়ালেখার মানদণ্ড পর্যালোচনা করতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে জরিপ চালানো হয়। শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানতে চাওয়া হয় কীভাবে এই বিষয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রদান করা যায় অথবা জানতে চাওয়া হয় কীভাবে শিক্ষক আরও বেশি কার্যকর শিক্ষা প্রদান করতে পারেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অথবা যেকোনো ভর্তি পরীক্ষার পর অনুরূপ জরিপকাজ চালানো হয়। চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রেও চাকরিজীবীদের পরামর্শ চাওয়া হয়। সর্বশেষে এই জরিপের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে বিদ্যমান পলিসি পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয় অথবা পরিবর্তন করা হয়। এভাবে বিদ্যমান পলিসি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিংয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া ও মতামত খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসনসংখ্যা খুবই সীমিত। কীভাবে বেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা যায় সে দিকে কারও লক্ষ্য নেই। আজ যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি (যেকোনো কারণেই হোক) তাদের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির কাতারে ফেলে দেওয়ার কারণে তারা আর স্বাভাবিক পড়ালেখা করতে পারবে না। অথবা সে পরিবেশ পাবে না। স্বাভাবিকভাবেই তারা পড়ালেখার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। কোনো কলেজে যদি ভর্তি নেয় তবে হয়তো ঠিকমতো ক্লাস হবে না অথবা শিক্ষকেরা কী পড়াবেন অথবা পরীক্ষায় কী কী প্রশ্ন থাকবে তা জানবে না। কারণ পড়াবেন কলেজের শিক্ষক আর প্রশ্ন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খণ্ড অথবা নৈশ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে পারত। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? (চলবে)

লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত।
ফেসবুক: shahid.shotabdi