আপনজন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইট ইজ স্টিংকিং হট। দিস ইজ হোয়াই আই ডিডনট ওয়ান্ট টু কাম। আঠারো বছরের যুবক নাহিদ সামান্য রাগী গলাতেই বলে।

—হোয়াট ডিড ইউ সে? ১৫ সিটের মাইক্রো বাসের মাঝের আসন থেকে মাহমুদ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে।
—আহ তুমি চুপ করতো। শফিক গাড়ির এসিটা ফুল করে দেওতো। অ্যান্ড নাহিদ ইউ শুডনট সে দ্যাট। মাহমুদের স্ত্রী ঝরনা তাড়াতাড়ি সামাল দেন। নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে বাইরের তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২৭ ডিগ্রি। দেশের হিসাবে অতটা গরম না। তবে নিউজার্সির হিসাবে অনেক গরম।
দুই দিন আগে টরন্টো থেকে মারুফ ফোন করে। তখন নিউজার্সিতে রাত দেড়টা। গত দুই বছর যাবৎ যে ভয়টা ছিল সেই দুঃসংবাদটাই শোনা হয়। ফোনটা রেখে স্ত্রী ঝরনাকে কেমন নিরুত্তাপভাবে খবরটা দেয় মাহমুদ। দিয়ে বিছানার পাশে থম ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ঝরনা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কী বলে কিছুই শোনা হয় না মাহমুদের। টেলিফোনটা আবার বাজতে থাকে। একবার বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার রিং হতে কেমন যন্ত্রের মতো ফোন ধরে মাহমুদ। মেহেদি ফোন করেছে সিডনি থেকে। এরপরে আরও আধা ঘণ্টা দেশ, কানাডা আর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও পাঁচ-ছয়টা ফোন এল।
এতগুলো ফোনের পর কেমন পরিশ্রান্তের মতো মুখ তুলে মাহমুদ বলে, এক কাপ কফি দেও না।
পরিচিত ভঙ্গির কথাটা শুনে একটু স্বস্তি পায় ঝরনা। মাহমুদের শরীরটাও বিশেষ ভালো না। হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবেটিসতো আছেই। ইদানীং যোগ হয়েছে তিরিক্ষি মেজাজ। ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে ছেলেটা এসব মানতে চায় না। সবদিক সামাল দিতে দিতে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে ঝরনার।
ঝরনা কফি নিয়ে এসে দেখে মাহমুদ তখনো ফোনে ব্যস্ত। তবে গলার স্বর কিছুটা স্বাভাবিক। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ফোন রেখে মাহমুদ বলে, কালকে দুপুরেই ফ্লাইট। সবাই যাচ্ছি। মারুফ আর মেহেদিও যাচ্ছে, সবাইকে নিয়েই। শফিক বলেছে মার লাশ দুই দিন রাখা যাবে। আমরা যাওয়ার পরেই দাফন হবে।
—কিন্তু নাহিদ, লুনার স্কুল। ওরাতো এখনো জানেই না।
—সকালেই স্কুলে ফোন করব। নয় দিনের জন্য যাওয়া। এসব ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় না। ওদেরকে ঘুম থেকে ওঠাও।
এরপরে আর কথা থাকে না। নাহিদ-লুনাকে ঘুম থেকে ওঠালেন ঝরনা। খবরটা শুনে লুনার মুখে একটু আঁধার নেমে এলেও নাহিদের তেমন ভাবান্তর হলো না। বরং দেশে যাওয়ার কথা শুনে একটু বিরক্তই হলো।
—মাম মাই স্কুল, বাস্কেটবল ম্যাচ...। মৃদুস্বরে আপত্তি করার চেষ্টা করে নাহিদ।
—লিসেন নাহিদ। দিস ইজ নট এ টাইম টু আরগু। উই আর গোয়িং।
ছেলেকে কথা বাড়াবার সুযোগ দেন না ঝরনা। এরপরের সময়টুকু ঝড়ের মতো গেল। মাহমুদ, ঝরনা কাজের জায়গায় ফোন ইমেইল করল। সুটকেস গোছানো, ফ্রিজ খালি করা, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বদলানো। এর মাঝে ফোনতো আছেই। দুইবার টরন্টো-সিডনিতেও কথা বলতে হলো। ওরাও অবশ্য একইরকম তাড়ার মাঝে আছে। তাই দরকারি কথাটুকুই শুধু বলা হয়।

সময় মেনে তিনটা ফ্লাইট আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা বিমানবন্দরে নামে। ঘণ্টাখানেক পরে আরেকটা ফ্লাইটে সবাই মিলে যশোরও ঠিকমতোই আসা হয়। ঢাকা বিমানবন্দরে তিন ভাইয়ের দেখা হওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে কেউই তেমন আবেগও প্রকাশ করে নাই। দীর্ঘ যাত্রায় সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই শফিকের পড়াশোনা কম হলেও দারুণ চালাক চতুর। তাইতো বুদ্ধি করে এই দামি মাইক্রোবাসটা ভাড়া করেছে। গাড়িতে বরফ ঠান্ডা বেশ কিছু পানির বোতলও রেখেছে।

মাইক্রোবাস যশোর থেকে খুলনার দিকে যাচ্ছে। সবারই চোখ ঢুলুঢুলু। কিন্তু শফিক বেশ টেনশনে আছে। দুই বছর আগে চাচির ব্রেনস্ট্রোক করার কিছুদিন পর থেকেই আছে সে চাচির বাসায়। তিন প্রবাসী ছেলে প্রথম দুই মাস একজনের পর একজন এসে থেকেছে। দুই মাস পর হাসপাতাল থেকে চাচিকে বাসায় নিয়ে আসা হলো সামান্য উন্নতি নিয়ে। উন্নতি বলতে চাচি শুধু কথা বলতে পারেন আর মাথাটা নাড়াতে পারেন। সেই থেকে শফিক আর শফিকের মা আছে চাচির সঙ্গে। তিন ভাই টাকা পয়সা পাঠায় আর শফিক খরচ করে। মা একটু বোকা আছে শফিকের। সেটাই প্রথম দুশ্চিন্তা শফিকের। বারবার করে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে মাকে। তাও মা যে কখন কি বলে। তবে নিজের কাছে পরিষ্কার শফিক। এমনতো না যে সে চাচিকে ওষুধ কিনে দেয় নাই। ওষুধ, ফিজিও সব নিয়মিতই সে করেছে। কিন্তু আটাত্তর বছরের বৃদ্ধাতো চাইলেও ভালো খাইতে পারে না। তাই...। তা ছাড়া মাঝে মাঝেই এটা-সেটা বলে বাড়তি কিছু টাকা নিয়েছে। ব্যবসাটা প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে...। আরও একটা চিন্তা নাজু। ধনী লোকের মেয়ে নাজুকে বলা হয়েছে এত বিশাল বাড়িটা দাদার বাড়ি। এখন তিন ভাই মিলে বাড়িটা যদি বিক্রি করে দেয়। নাজুকে কথাটা হয়তো মিথ্যা বলেছে কিন্তু ভালোবাসাটাতো মিথ্যা নয়। কিন্তু কেউই এসব বুঝতে চায় না...শফিক জানে নাজুও বুঝবে না।

ঘণ্টা দেড়েক পরেই খুলনার পাবলায় সালেহা মঞ্জিলের সামনে থামে মাইক্রোবাস। থমথমে মুখে গাড়ি থেকে বের হয় তিন ভাই। তিন বউও নেমে আসে ছেলেমেয়েসহ। মুহূর্তে শোক নেমে আসে বিশাল বাড়িতে। বাসার সামনের উঠানে সাদা কাফনে মোড়ানো দুই দিনের লাশ। আঁতর, লোবান আর চাপাতার মিশ্র গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশ।
—মিয়াভাই লাশ আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। মাহমুদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে শফিক। মাহমুদও মৃদুস্বরে মারুফ আর মেহেদিকে একই কথা বলে। বুড়ি ছোঁয়ার মতো সবার এক নজর দেখা হয়ে গেলেই সালেহা বেগমের লাশ রওনা হয় চূড়ান্ত গন্তব্যে।

তিন দিন পরের সকাল। প্রাথমিক শোক কেটে গেছে। তিন ভাই সস্ত্রীক নাশতা করছে। বাচ্চারা সব ঘুমে।
—শান এখন কেমন? মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
—কাল রাত নয়টার পরে আর টয়লেট হয় নাই দাদা। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রুমু উত্তর দেয়।
—রঞ্জুও শুনলাম কাল রাতে বমি করেছে? ছোট ভাই মেহেদি জিজ্ঞেস করে।
—হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খাওয়াইছি। মেজ বউ শিলা উত্তর দেয়।
—ভালোমতো খেয়াল রেখো শিলা। গত দুই দিন শানকে নিয়ে যা হলো এ রকম হলেতো হাসপাতালেই থাকতে হবে বাকি কয়দিন। মাহমুদ আবার বলে।
—এর মাঝে গতকাল আবার তোমাদের ছোট মামি এসে একগাদা কথা শুনিয়ে গেল। ঝরনা একটু ঝাঁজের সঙ্গে বলে।
—মামি আবার কি বলল? মারুফ জিজ্ঞেস করে।
—জান না তোমার ছোট মামি মিষ্টি মিষ্টি করে কত তিতা কথা বলতে পারে। মারুফের স্ত্রী শিলা উত্তর দেয়।
—বলো না কি বলছে? মারুফ আবার জিজ্ঞেস করে।
—কী আবার বলবে। বলল জান আমার বড় ছেলেকে কী বলি—বলি যে তোকে বড় করার চেয়ে একটা অস্ট্রেলিয়ান গরু বড় করাই ভালো। গরুর দুধ বেচে অনেক টাকা পাওয়া যাইতো। বুড়া বয়সে আমার ভাগ্য ভালো হলে তুই কিছু টাকাইতো দিবি। দেখ না সালেহা বুবুকে। কত কষ্ট করে তিন ছেলেকে মানুষ করল। বয়সকালে একটা ভালো শাড়ি ছিল না। কোনো বিয়ে শাদিতে যাইতো না শুধু ভালো কাপড় নাই এ জন্য। কি লাভ হইছে এত কষ্ট করে। এখন অন্ধকার অপরিষ্কার এক ঘরে শুয়ে আছে। দূর সম্পর্কের বাটপার দেবরের ছেলে আর তার মার তদারকিতে। শিলার কথা শুনে সবার মুখ কালো হয়ে যায়।
—ছোট মামির কথা বাদ দাও। আর্মি অফিসারের বউরা নাকি এক র‍্যাংক ওপরে থাকে। জামাই ক্যাপ্টেন হইলে বউ মেজর। ছোট মামি সব সময় ছিল দুই র‍্যাংক ওপরে। মামাতো ব্রিগেডিয়ার হয়ে অবসর নিছে। হিসাবমতো মামি তাহলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল। গত বছর ছোট মামি তার এই ছেলের জন্যই কতবার ফোন করেছে। আমেরিকার ভিসার জন্য। আমি স্পনসরশিপ ঠিকই পাঠিয়েছি। অ্যামব্যাসি ভিসা না দিলে আমি কি করব। মাহমুদ বলে।
—যাই বলো। শফিক কতটা মার যত্ন নিছে সন্দেহ আছে। মার রুমটা দেখছ কি অপরিষ্কার। শফিককে টাকাতো অনেক দেওয়া হতো। মেহেদি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে।
—হুমম। চাচিও জানি কেমন? কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে শফিক জানে। রুমু বলে।
—এ ছাড়া আমাদেরতো কোনো উপায় ছিল না। সুস্থ অবস্থায়তো মা আমাদের কারও বাসায় দুই মাসের বেশি থাকতে চাইত না। আর এ রকম অবস্থায়...।
কথা শেষ করে না মাহমুদ। তিন ভাইয়ের বউই মনে মনে বলে, আমাদের বাসায় ঠিকই থাকতে চাইত। ঠিকমতো সময়, যত্ন না দিলে মা কীভাবে বিদেশে থাকবে। অন্য অনেক কিছুর মতো এই ভাবনার সত্যতাও অমীমাংসিত থেকে যায়।
—শফিক কোথায় গেল? ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে মারুফ জিজ্ঞেস করো।
—বললতো একটা গাড়ি আনতে যাচ্ছে। কারও যদি কোথাও যেতে হয়। মাহমুদ বলে।
—গাড়ি লাগবে না। চল হাঁটতে হাঁটতেই বিএল কলেজের মোড়ে যাই। মেহেদি বলামাত্রই সবাই উঠে পড়ে।
—যেখানেই যাও। তাড়াতাড়ি আসবা। আজকের দিনটাইতো মনে হয় সবাই একসঙ্গে আছি। কাল আমি বাবার বাড়ি যাব। ঝরনা বলে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তিন ভাই বাড়ি থেকে বের হয়। কয়েক মিনিট হাঁটতেই রাস্তার পাশের এক হোটেল থেকে এক বৃদ্ধ জোরে ডেকে ওঠেন, এই ডলার, দিনার, রিয়াল। এদিকে আসো।
ডাকটা শুনে তিন ভাইয়ের বুকেই কী যেন ছলাৎ করে ওঠে। বহু বহু দিন পরে এই নামে তাদের কেউ ডাকল। অথচ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই নামেই পরিচিত ছিল পিঠাপিঠি তিন ভাই। জুটমিলের ওভারসিয়ার আফসারুদ্দিনের মেধাবী তিন ছেলে।
—কেমন আছেন চাচা? হোটেলের ভেতর গিয়ে মেহেদি ওরফে রিয়াল জিজ্ঞেস করে।
—আমার আর থাকা। বুড়া বয়সে যতটুকু ভালো থাকা যায়। তোমার বাবা আমার বন্ধু মানুষ ছিল জানতো? তোমরা বসো। এই ভালো দেখে তিন কাপ চা দে। এই তিন ভাইকে চিনস? তোরা চিনবি কীভাবে? এই তিন ভাই এই এলাকার গর্ব। চিনা রাখ।
এমনভাবে বলেন বৃদ্ধ, তিন ভাইয়েরই খুব ভালো লাগে। তিন ভাই বৃদ্ধের সামনে বসে।
—তোমরা আসছ খবর পাইছি। ভাবছিলাম গতকাল যাব। কিন্তু বাতের ব্যথাটা বাইরে যাওয়াতে...। তোমার বাবা ছিলেন মাটির মানুষ। তোমার বাবার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না জান। বলত, সেলিম আমার সম্পদ হইল তিন ছেলে। দেখছ না নাম রাখছি ডলার, দিনার, রিয়াল। আরে আমি নিজেইতো ব্যাংক। আফসোস সে কিছুই দেইখা যাইতে পারল না। ডলার তুমি পাস করার সঙ্গে সাথেইতো তোমার বাবা মারা গেল তাই না?
—জি চাচা। মাহমুদ ওরফে ডলার উত্তর দেয়।
—ভাবিরে মাঝে মাঝে দেখতে যাইতাম। সেতো নিজেই এখানে থাকতে চায়। তারপরও তোমরা তিন ভাই টাকা পয়সা দিয়ে ভাবির কোনো অযত্ন হইতে দেও নাই। আজকাল দেশে যারা থাকে তারাও এত করতে পারে না। আমার প্রায় সব ছেলেইতো ঢাকায়। একজন আছে সেও বলতাছে ঢাকায় চলে যাবে। না গিয়ে করবেই বা কি?
এভাবেই আরও কিছুক্ষণ সেলিম চাচার সঙ্গে সময় কাটিয়ে হোটেল থেকে বের হয় তিন ভাই। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে মারুফ।
—হাসছিস কেন মেজ ভাই। মেহেদি জিজ্ঞেস করে।
—ওই ঈদের কথা মনে আছে দাদা। মারুফ উত্তর দেয়।
—কোন ঈদ? মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
—ওই যে আব্বা আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য একই শার্টের কাপড় কিনল। প্যান্টের কাপড়ও কিনল একই। আগের ঈদগুলোতেও একইভাবে কিনেছে। মনে হয় কাপড় বেশি কিনলে দাম একটু কম পাওয়া যেতো। দরজির দোকান থেকে জামা প্যান্ট নিয়ে আসলাম আমি। ঈদের দিন নতুন জামা প্যান্ট পরে বের হতেই সামনে পড়ল এই সেলিম চাচা। আমাদের দেখে সেলিম চাচা বলেছিল, আফসার ঈদের দিনও পোলাপানরে স্কুল ড্রেসের মতো প্যান্ট শার্ট বানাইয়া দিছে। যাও বাবারা লেফট রাইট করতে করতে যাও। দাদা তুই মনে হয় তখন ক্লাস টেনে। কথাটা আমাদের দুই ভাইয়ের তেমন না লাগলেও তোর খুব লেগেছিল। বিকেল পর্যন্ত বাসা থেকেই বের হস নাই। কীভাবে যেন আব্বাও জেনেছিল। এরপর থেকে আমরা তিন ভাই তিন রকমের শার্ট-প্যান্ট পেতাম ঈদে। মনে আছে?
—খুব মনে আছে। কীসব দিন ছিল। ঈদের ড্রেসের কথা বাবা জেনেছিল। কিন্তু বছরের পর বছর একই সোয়েটার পরে স্কুলে গেছি। স্কুলে আমাকে কি নামে ডাকত জানিস? মাহমুদ বলে।
—জানি। ইয়েলো মাংকি। হলুদ সোয়েটারের জন্য। একই কারণে মেজভাইকে ব্লু মাংকি আর আমাকে অ্যাস মাংকি বলত। মেহেদি উত্তর দেয়। মাহমুদ একটু অবাক হয়।
—বাবার কিন্তু সত্যি কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। মাহমুদ কেমন দুরাগত স্বরে বলে।

আই হেট দিস। নাহিদ রাগতভাবেই বলে। রাত সোয়া সাতটা বাজে। বিদ্যুৎ নেই প্রায় দেড় ঘণ্টা। এতক্ষণ তবুও আইপিএস দিয়ে কিছু বাতি আর ফ্যান চলছিল। মিনিটখানেক আগে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। নাহিদ, লুনা আর ঐশী দোতলার এই রুমে বসে আছে। তিনজনের বয়সই কাছাকাছি—১৮, ১৬ ও ১৫। ঐশীর আইপ্যাডে একটা মুভি দেখছিল তিনজনে মিলে। আইপ্যাডের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে ছবি দেখাও বন্ধ। রঞ্জু আর শান পাশের রুমে আর একটা ল্যাপটপে গেম খেলছে।
—ইউ নো নাহিদ ভাই হোয়াট শকড মি মোস্ট হোয়েন আই ফার্স্ট কেম টু বাংলাদেশ?
ঐশী বলে চাচাতো ভাই নাহিদকে।
—হোয়াট? নাহিদ জিজ্ঞেস করে।
—আই ওয়াজ ওয়াকিং অন এ রোড। সাডেনলি আই স এ ম্যান ওয়েন্ট বিসাইড দ্য রোড অ্যান্ড পুল হিজ জিপার ডাউন অ্যান্ড স্টার্ট পিইং...আই ওয়াজ সো শকড। আই নেভার কুড হ্যাভ থট দ্যাট সামওয়ান ক্যান ডু দ্যাট।
—ইউ শুড কাম উইথ আস টু মাই মামিস হাউস। লুনা বলে ঐশীকে।
—হোয়াই?
—বিকজ দেন ইউ উইল সি এনোদার সারপ্রাইজ। ইউ নো মাই মামিস হাউস ইজ কাইন্ড অব এ ভিলেজ। ইন দ্য টয়লেট ইউ ক্যান সি অল দ্য সিট ইফ ইউ লুক ডাউন। অলদো মাম সেইড উই উইল নট সি দ্যাট দিস টাইম।
—হেই উই আর অনলি টকিং অ্যাবাউট সিটস। হাসতে হাসতে বলে নাহিদ।
—ইয়াহ। দ্যাটস ব্যাড। অ্যান্ড ইউ নো আই লাইক দিস কান্ট্রি। বিউটি ইজ সো পিউর, পিপল আর সো ক্যান্ডিড স্পেশালি ভিলেজ পিপল। ঐশীও হাসতে হাসতে বলে।
—ইউ নো হোয়াট ইরিটেট মি মোর? নাহিদ বলে।
—হোয়াট? ঐশী জিজ্ঞেস করে।
—মাই প্যারেন্টস। দে আর ফুল অব হিপোক্রেসি। দে টক সো মাচ অ্যাবাউট ফ্যামিলি, বাংলাদেশ। বাট একচুয়ালি দে ডোন্ট মিন হোয়াট দে সে। হোয়াই দাদি ডায়েড লাইক দিস। মাই ড্যাড, মাই আঙ্কেলস ক্যান টেক হার টু স্টেটস, কানাডা অর অস্ট্রেলিয়া।
—ভাইয়া ইউ শুড কন্ট্রোল ইউর এঙ্গার। দাদি ওয়ান্টস টু স্টে হেয়ার। লুনা নাহিদকে থামাবার চেষ্টা করে।
—দ্যাটস এ লেইম এক্সকিউজ লুনা। অ্যাকচুয়ালি দে ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্যাক্রিফাইস দেয়ার কমফোর্ট। ড্যাড হেট সাম বাংলাদেশি আঙ্কলস ইন আওয়ার সিটি। বাট হোয়েন দে মিট ইউ উডন্ট বিলিভ হাউ দে বিহেভ, ঐশী। দে বিহেভ লাইক ভেরি গুড ফ্রেন্ডস। আই আস্কড অ্যাবাউট ইট। অ্যান্ড হি সেইড ইট কার্টেসি। কার্টেসি মাই ফুট। ইটস হিপোক্রেসি।
—উড ইউ স্টপ ভাইয়া। লুনা আবার নাহিদকে থামাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আর দরকার হয় না। বিদ্যুৎ চলে আসায় সবাই আবার মুভি দেখতে বসে যায়।

বড় ভাবি তুমি হিজাব পড়া শুরু করলে কবে থেকে।
রুমু জিজ্ঞেস করে ঝরনাকে। রাতের খাবার শেষে তিন বউ মিলে হাত পা ছড়িয়ে গল্প করতে বসেছে। তিন ভাই খাওয়ার পরে আবার কোথায় যেন গেছে। বলে গেছে একটু পরেই ফিরে আসবে।
—এইতো বছরখানেক। হিজাব পরার পরে ফেসবুকে কোনো ছবি দেই নাই। তাই জান না।
—কাজে অসুবিধা হয় না। শিলা জিজ্ঞেস করে।
—আমিতো সরকারি অফিসে কাজ করি। ওপরে ওপরে তেমন অসুবিধা হয় না। তবে জানইতো এখনকার দুনিয়া। কিছু হইলেই মুসলিমদের দোষ।
—আমি বাবা ছোট চাকরি করি। চাকরিও পারমানেন্ট না। তাই...রুমু বলে।
—তা ছাড়া আজকাল আমার খুব ভয় করে জান। ঝরনা আবার বলে।
—কীসের ভয় ভাবি? রুমু জিজ্ঞেস করে।
—ভিন দেশে ভিন পরিবেশে ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। কখন কী হয়? ঝরনা উত্তর দেয়।
—আমরা চেষ্টা করি বাসাতেই যতটা সম্ভব পরিবেশটা ঠিক রাখতে। ঐশী–রঞ্জু ইংরেজিতে কিছু বললে আমরা জবাব দেই না। ছেলেমেয়ে নিয়ে উইকএন্ডে ইউটিউবে বাংলা ছবি নাটক দেখি। শিলা বলে।
—হ্যাঁ ঐশী–রঞ্জুতো চমৎকার বাংলা বলে। তবে এসব করেও লাভ হয় কিনা কে জানে। শোনো আমাদের ওখানে কিছুদিন আগে এক ঘটনা ঘটছে। ঘটনাটা বলি। রুমু নিচতলায় একটু চায়ের কথা বলে আসো না।
রুমু নিচতলায় চায়ের কথা বলে অল্প সময় পরেই আবার আসে।
—বল ভাবি কি ঘটনা।
—আমাদের পরিচিত এক বাংলাদেশি ভাই। কাছের মানুষই বলতে পার। সারা দিন বাংলাদেশ বাংলাদেশ করত। কমিউনিটির সব কাজেই অসম্ভব আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করত। সোজা কথায় তাকে চেনে না এমন কেউ নাই বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। হঠাৎ শুনি তার ছেলে বিয়ে করেছে এক কালো মেয়েকে। ছেলেটা ফরসা আর কী হ্যান্ডসাম। মেয়ের আবার পাঁচ বছরের এক বাচ্চাও আছে আগের পার্টনারের সঙ্গে। কী অদ্ভুত জান, ভাইটা মেনেও নিল। বিরাট পার্টি দিল। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। মেয়ের মা সারা পার্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলে বেড়াচ্ছে-সো সুইট, সো সুইট। এক সময় আমার কাছে আসলে আমি একটু কায়দা করে জিজ্ঞেস করলাম মেয়ে ধর্ম বদল করেছে কিনা। উত্তরে বলল, নো ওয়ে উই লাভ জিসাস। বাট ইউ বাঙালি পিপল আর সো সুইট। মাই সান ইজ ইন এ আনহ্যাপি রিলেশন। আই উইস হি ক্যান ফাইন্ড এ সুইট বাঙালি গার্ল। শুনে গা জ্বলে গেল আমার।
—এসবতো সব জায়গাতেই কম বেশি হয় ভাবি। এসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ কি? তা ছাড়া ভালো উদাহরণও তো কম নাই। আর দেশেওতো শুনি আজকাল কত কিছু হয়। রুমু বলে।
—আমি এত কিছু বুঝি না ভাই। আমি মসজিদের ইমামের মেয়ে। আজকাল নাহিদের সঙ্গে ওর বাবার প্রায়ই খটমট হয়। মেয়েটা চুপচাপ তবে মনে মনে কি ভাবে কে জানে। সুখে থাকার জন্য বিদেশে থাকি। কি দামে সেই সুখ কিনতে হয় আল্লাহই জানে। তাই আল্লাহ আল্লাহ করি ভাই।

রাত প্রায় বারোটা। তিন ভাই বাইরে থেকে ফিরে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।
—শফিক কাজের আছে কিন্তু। কোথা থেকে এত ভালো কফি জোগাড় করল কে জানে। মেহেদি বলে।
—হুমম। জানিস খুব ভালো লাগছে আজ। কতকাল পর তিন ভাই সারা খুলনা ঘুরে বেড়ালাম। মাহমুদ কফির কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে বলে।
—দাদা একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? মারুফ বলে।
—কি?
—খুলনা এখনো প্রাণের শহর। কিন্তু খুলনার জায়গাগুলোর নাম দেখ, বয়রা, গোবরচাকা, লবণচোরা, ময়লাপোতা...এ রকম বিশ্রী জায়গার নাম অন্য কোনো শহরে আছে কিনা কে জানে। মারুফ এই কথা বলতেই মেহেদির একমাত্র ছেলে শান রুমে ঢোকে।
—ড্যাড, ক্যান আই হ্যাভ এ বার্গার টুমরো।
—না শান। বার্গার খাওয়া যাবে না। কাল আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দেব। মারুফ বলে।
—ড্যাড, হোয়াট ইজ আংকেল সেইং। শান আবার বাবাকেই জিজ্ঞেস করে।
—আংকেল উইল বাই ইউ আইসক্রিম টুমরো। গো টু বেড নাউ।
শান চলে যায়।
—শানকে বাংলাটা অন্তত বলতে বুঝতে শেখা ছোট। মারুফ বলে মেহেদিকে।
—মেজ ভাই তোর এই বাংলা বাংলা জিনিসটা আমার ভালো লাগে না। এসবের কোনো মানে নাই। তা ছাড়া মাতৃভাষার সংজ্ঞাও বদলানো উচিত আমার মতে। মেহেদি উত্তর দেয়।
—কিরকম? মাহমুদ কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে।
—মাতৃভাষা আসলে মায়ের ভাষা না। নাহিদ, লুনা, ঐশী সবার মায়ের ভাষাইতো বাংলা। কিন্তু এই ভাষাতে কেউইতো স্বচ্ছন্দ না। এমনকি ঐশী আর রঞ্জু নিজেরা যখন কথা বলে ইংরেজিতেই বলে। তাই মাতৃভাষা হওয়া উচিত যে ভাষায় সব চাইতে স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় সেটাই। মেজ ভাই তুই কি মনে করিস ঐশীর ছেলেমেয়ে বাংলায় কথা বলবে? তুই যা করছিস তা হলো নিয়তিকে একটু দুরে ঠেলে দিচ্ছিস। তাও কতটুকু পারবি কে জানে।
মেহেদির কথার রূঢ় সত্যতা তিন প্রবাসী ভাইকেই চুপ করিয়ে দেয়। পাশের রুম থেকে তিন বউয়ের হাসির শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু তা ছাপিয়ে হঠাৎ নিচ থেকে বিলাপের সুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। তিন ভাই, বউরা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
—মা চুপ কর। ওপরে দাদারা ঘুমাচ্ছে। শফিকের গলা পাওয়া যায়।
—কি করমু ঘুম আসে না। বুবু সারা রাত কথা কইতো। ও বুবুউউ তুমি কইইই গেলা...’ বিলাপের সুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। দুরে কোথাও একটা কুকুরও মনে হয় কেঁদে ওঠে। দূর সম্পর্কের এক চাচির কান্নায় নতুন করে আপনজন হারাবার কথা মনে হয় সালেহা মঞ্জিলের বারান্দায় দাঁড়ানো ছয়জন মানুষের।

মোস্তাফিজুর রহমান: ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।