লেবাননে বাংলাদেশ সপ্তাহ পালন

র‍্যালির দৃশ্য
র‍্যালির দৃশ্য

মাথায় লাল সবুজ পতাকা খচিত ব্যান্ড, মেয়েদের পরনে শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে এসেছে ছেলেরা। হাতে হাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানের ছবি। কারও হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি। সবার হাতে ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের পতাকা। ধীরে ধীরে পুরো এলাকা বাংলাদেশিদের এক মিলনমেলায় পরিণত হলো। দৃশ্যটি গত ২৪ অক্টোবর লেবাননে বাংলাদেশ সপ্তাহ পালনের দিনের। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান রাওশি। সেদিন ছিল বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত প্রথম র‍্যালি। এমন সুন্দর উদ্যোগ যা কিনা প্রথম দেখছে লেবাননবাসী।

র‍্যালির দৃশ্য
র‍্যালির দৃশ্য

২৪ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত লেবাননে পালিত হয় বাংলাদেশ সপ্তাহ। এ কারণে পুরো লেবাননের বাংলাদেশিদের মধ্যে এক আনন্দঘন সময় কেটেছে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। লেবাননের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর বৈরুত, বালবেক ও ত্রিপোলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ সপ্তাহ। বাংলাদেশি শিল্পীরা নেচে গেয়ে মুগ্ধ করেছেন লেবাননবাসীকে। ঢাকা থেকে আগত শিল্পীদের মধ্যে কুষ্টিয়ার বংশীবাদক অমিতাভের বাঁশির মূর্ছনা আনন্দে উদ্বেল করেছে সবাইকে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের গভর্নর দূতাবাসের অনুরোধে তিন কিলোমিটারের বেশি রাস্তা নির্ধারণ করে দেন সুন্দর ভাবে র‍্যালি করার জন্য। র‍্যালির রাস্তাটি ছিল ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে। হাজার হাজার পর্যটক ছাড়াও রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি সব সময় গাড়িতে ছেয়ে থাকে। লেবাননের পুলিশ পুরো র‍্যালিটি তদারক করে নিয়ে যায়। সামনে পেছনে এক গাড়ি পুলিশ প্রহরা দেয় বাংলাদেশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানের এই র‍্যালিটি সুষ্ঠুভাবে হওয়ার জন্য। আরও ২০-২৫ জন পুলিশ মিশে যায় র‍্যালির শ পাঁচেক সদস্যের সঙ্গে। পথচারী ও রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী অসংখ্য মানুষ উপভোগ করেন এ র‍্যালি। তাদের অনেকে ছবি তোলেন র‍্যালির সঙ্গে। লেবাননের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল প্রচার করে এ র‍্যালির দৃশ্য।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী শুভ্রদেব যখন তাঁর একটি গান ধরলেন—‘এ মন আমার পাথর তো নয়...’ বাকি অংশ আর শুভ্রদেবের গাইতে হলো না। কারণ গানটি সবার মুখস্থ। পুরো হলভর্তি প্রবাসী বাংলাদেশিরা গানটি গাইলেন। এ দৃশ্য দেখার মতো ছিল। অনেক দিন পর এমন আয়োজন দেখে, মূলত বাংলা আয়োজন দেখে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে কি পরিমাণ আনন্দিত হয়েছেন তা দেখার মতো ছিল। অনেকে দাবি করেছেন এমন আয়োজন বারবার করা হোক।
লেবানিজ নাগরিকরাও সমভাবে উপভোগ করেছেন এ অনুষ্ঠান। প্রতিটি অনুষ্ঠানে ছিলেন লেবানিজ অতিথি। প্রথমবারের মতো তারা উপভোগ করলেন বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বাদ। অনুষ্ঠান শেষে তাদের চোখে মুখে ছিল পরিতৃপ্তির ছাপ। যারা বিভিন্ন কারণে আসতে পারেনি তারাও পরবর্তীতে ফোন ও ইমেইলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এমন একটি অনুষ্ঠান মিস করার জন্য। জানান দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

বাংলাদেশ সপ্তাহের আয়োজনকে বর্ণিলভাবে সাজিয়েছিলেন লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার। তাঁর পরিকল্পনায় লেবাননকে তিনটি ভাগে ভাগ করে রাজধানীসহ লেবাননের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো। যেন পুরো লেবাননবাসী বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারেন ও দেখতে পারেন এ আয়োজন।
উল্লেখ্য, বৈরুত লেবাননের প্রশাসনিক রাজধানী হলেও বালবেক হলো লেবাননের সাংস্কৃতিক রাজধানী আর ত্রিপোলি লেবাননের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত।
আব্দুল মোতালেব সরকার বাংলাদেশে সপ্তাহ সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশ ও লেবানন দুটি বন্ধু রাষ্ট্র হলেও লেবাননবাসীর বাংলাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। তা ছাড়া লেবাননে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করায় এ দেশে জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তাদের সেই নেতিবাচক ধারণাকে বদলে দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি ও আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লেবাননবাসীদের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যেই বাংলাদেশ সপ্তাহের আয়োজন।

র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

তাঁর এ পরিকল্পনা যে শতভাগ সফল হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বাংলাদেশ সপ্তাহ উদ্‌যাপন উপলক্ষে র‍্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এবং বাংলাদেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে একটি গোলটেবিল আলোচনার অনুষ্ঠান করা হয়।
এত সুন্দর আয়োজন ও বিপুলসংখ্যক লেবানিজ দেখে বাংলাদেশ থেকে আসা সাংস্কৃতিক দল খুবই খুশি। দলের অন্যতম সদস্য শুভ্রদেব বলেন, তিনি বিশ্বের বহু দেশে পারফর্ম করেছেন, কিন্তু কোথাও এত বেশিসংখ্যক স্থানীয়দের উপস্থিতি কখনো দেখেননি। এ জন্য তিনি রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, দূতাবাসের সঙ্গে লেবাননবাসীর সুসম্পর্কের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া তিনি লেবাননে প্রদত্ত লজিস্টিক ব্যবস্থাপনারও ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুযোগ পেলে শুভ্রদেবসহ দলের অন্যান্য সদস্যরা আবারও এ ধরনের আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্য লেবাননে আসার আগ্রহ ব্যক্ত করেন।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

বৈরুতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন লেবাননের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর উপদেষ্টা ঈশা জাইদান। বালবেকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বালবেক মিউনিসিপ্যালটির মেয়র হোসেইন লাকিস। ত্রিপোলিতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাফাদি কালচারালার সেন্টারের পরিচালক নাদিন আল আলী। এ ছাড়া বাংলাদেশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে লেবাননের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
ঈশা জাইদান বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মাধ্যমে লেবানন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জোরদার হবে।

শিল্পীদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য
শিল্পীদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য

দূতাবাসের এবারের আয়োজনে লেবাননবাসী এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে, তারা আগামী গ্রীষ্মে বালবেক আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসকে আগাম দাওয়াত করেছেন। তা ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়।

প্রবাসীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান

গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ দূতাবাসে সকাল ১০টা থেকে প্রায় ৩০০ জন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এ চিকিৎসাসেবাতে ডাক্তার ও ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করে লেবাননে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ আলী হায়দার ও নির্মূল। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ দূতাবাস গত দেড় বছরে এমন তিনটি ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করল।
রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার তাঁর স্বাগত বক্তব্যে দূতাবাসের এ প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

সংবাদদাতা: জুবায়ের কবির, বৈরুত, লেবানন।
ছবি: বাবু সাহা ও খালেদ সরদার।