নীরব স্রোত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীপা অস্ট্রেলিয়ায় আছে আজ আট বছর। গতকাল সন্ধ্যায় দীপার ছোট দুই ভাই দিপন আর রিপন অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। প্রচণ্ড শীত। সূর্য উঠছে। দুই ভাই তখনো ঘুমে। দীপার অবশ্য খুব ইচ্ছে করছে দুই ভাইকে ডেকে তুলে এখনই গল্প শুরু করে। দেশের সব গল্প। ফেলে আসা দিনগুলোর গল্প।

আপন দুই ভাইকে কাছে পাওয়া। এ যেন মরু পরবাসে এক টুকরো শান্তির শৈশবকে ফিরে পাওয়া। পরবাসের এত বছরের সঞ্চিত বিতৃষ্ণা হঠাৎ করে তার কোথায় যেন উবে গেল। বাসার ব্যালকনি থেকে দেখা যায় অদূরের বিস্তীর্ণ পার্ক। আরও দূরে দেখা যায় লা পেরোজ বিচ, পোর্ট বোটানির ঘন সবুজ গাছে ছাওয়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে ওই নীল সমুদ্র। আজ এই পার্ক, সবুজ পাহাড়, সমুদ্র আর এই সকালের আবেদন দীপার কাছে অন্য রকম। অতি আপন। এই সুন্দর সময়টা তৈরি করতে তাকে কত ত্যাগ, কত সাধনা করতে হয়েছে।
মনে পড়ছে আজ থেকে নয় বছর আগের সেই দিনটা। সে কথা মনে হলে দীপার শরীরটা আজও শিউরে ওঠে।
দীপা তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। ক্লাস শেষে বের হওয়ার পথে কলেজ গেটে একটা ছেলে তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ছেলেটা বেশ বিনয়ী। চেহারায় পরিশ্রমী আর অনেক দায়িত্বের ভারে নত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট।
—কী বলতে চান? দীপা তাকে জিজ্ঞেস করে।
—চলুন কোথাও বসি। কোনো রেস্টুরেন্টে।
—আপনাকে তো চিনি না। আপনার সঙ্গে কোথাও কেন বসব?
—এ শহরেই হালদারপাড়ায় আমাদের বাড়ি। ইন্টার পাস করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাই। ছোট ভাইবোন তিনটাকে নিয়ে গেছি ওখানে। চলুন কোথাও বসে কথা বলি। বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসে ছেলেটি বলল।
দীপার মন সায় দিল। শুনেই দেখা যাক।
—না, রেস্টুরেন্টে নয়। চলুন পার্কে বসি।
কলেজের অদূরে অবকাশ পার্ক। সেখানে দিঘির পাড়ে একটা বেঞ্চে বসে ছেলেটি বলে, আপনার নাম দীপা তাই না?
—জি।
—আমি সোহেল।
—আচ্ছা।
—আমি আপনার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। আপনি চাইলে যত ইচ্ছা খোঁজখবর নিতে পারেন। হালদারপাড়ায় মাঠের পাশের বাড়িটাই আমাদের। বাবা রকিব উদ্দীন। অন্নদা হাইস্কুলের টিচার ছিলেন। বাবা এখন নেই। চার ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়।
দীপা কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। বলল, সবই ঠিক আছে। এখন আমি কি করতে পারি?
—আমার এমন কেউ নেই যে আপনার বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাবে। আর এসব করেই বা লাভ কি। আপনি চাইলে সবই সহজ। আপনি না চাইলে হাজার রকমের আয়োজনও বাদ।
—ঠিক আছে। আপনিই বলেন।
—আপনাকে জীবনসাথি হিসেবে পেতে চাই।
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দুজনই নীরব।
মিনিট দুই পর সোহেল বলল, আমার এ প্রস্তাবে রেগেমেগে আগুন হওয়ারও কিছু নেই। আবার আবেগে গলে যাওয়ারও কিছু নেই। যদি অন্যায় করে থাকি, ÿমাফ চেয়ে সরে পড়ব। অনেক মেয়েই দেখেছি। আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনি পারবেন। আপনি বুঝবেন। চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে।
—আমাকে দেখে এমন মনে হওয়ার কারণ কি?
—খুব সুন্দর করে যারা কথা বলেন, হয়তো বা আমি ওই দলের কেউ নই। আমার মনে হয়েছে তাই। সেই ইন্টার পরীক্ষার আগে আগে গেলেন বাবা। বছরখানেক আগে গেলেন মা। ছোট ভাইবোনগুলোকে নিয়ে বাস্তবতার চাপে মনটাকে খেয়াল করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। গত মাসে তিন বেডরুমের ছোট একটা বাড়ি কিনেছি। টুকটাক রেনোভেট নিজেই করেছি। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি ঝাপসা অন্ধকার। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে হয় না। অনেকক্ষণ বসে ছিলাম অন্ধকারে। তারপর হঠাৎ মনটা এমন ব্যাকুল হয়ে উঠল, নাহ, আর পারছি না। এবার দেশে যাই।
—দেশের মানুষের পক্ষে বিদেশের বাস্তবতা বুঝে ওঠা কঠিন।
—জি, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু...মানে, এখন সবই আপনার ইচ্ছা। যদি আপনার-আমার মধ্যে আত্মীয়তা হয়, আপনার ছোট ভাইবোনগুলোকে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল করতে। তাদের উচ্চশিক্ষার্থে যা যা করার সবই করব। একটা পরিবারকে এক বস্তা সোনা না দিয়ে পরিবারের মানুষগুলোকে সোনার মানুষ করে গড়ে তোলা আমার কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এভাবেই চলছিল কথাবার্তা।
বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে দীপা বলল, ঠিক আছে। আপনি আগামীকাল বিকেল চারটায় আমাদের বাসায় আসুন। আমার বাবা আছেন। পক্ষাঘাতে পড়ে আছেন দুই বছর ধরে। এ পর্যন্ত বলেই দীপার গলা আটকে এল।
—না, আর বলতে হবে না। সবই জানি। আপনি সবার বড়। ছোট দুই ভাই পড়াশোনা করছে। ছোট বোনটা স্কুলে যেতে চায় না। আপনার আম্মু...মানে আমি সব খবরই নিয়েছি। ঠিক আছে, আগামীকাল চারটায় আপনার বাসায় আসব।
সেদিন বিকেলে দীপা ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো আনতে গেছে। অদূরে দেখা গেল রাস্তার পাশে দোকানটিতে শফি বসে আছে। কখন থেকে যে চেয়ে আছে দীপার দিকে সে খেয়াল করেনি। আনমনা দীপার সেদিকে চোখ যেতেই একটু এগিয়ে বলল, কীরে শফি। কি করছিস?
—কিছু না। তোর সঙ্গে একটু কথা বলব।
পুরো বিষয়টা আঁচ করতে পেরে হঠাৎ দীপার শরীরটা শিউরে ওঠে।
—আয়, ছাদে আয়।
ছাদে এসে শফি নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
—কীরে, কিছু বলছিস না যে!
—বলব আর কী। বিরাট ধনবান জ্ঞানবান অস্ট্রেলিয়ার এক বড় ভাইকে বিয়ে করছিস। ভাবসাবই তো আলাদা।
একটা হালকা নিশ্বাস ছাড়ে দীপা।
—শফি, আমার আর কি করার থাকতে পারে বল। সংসারের অবস্থাটা একবার চিন্তা কর। কী কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যে যাচ্ছি, কে আর বুঝবে। বুকের ভেতর কঠিন এক যুদ্ধ বেধে গেছে আমার। বাবার এই অবস্থা। ছোট ভাইবোন...। সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। তুই কি ভাবিস কষ্ট আমারও হচ্ছে না রে? দীপার গলা জড়িয়ে এল।
দৃষ্টি নত করে শফি বলল, না, ওসব বলছি না। আমার কীই বা আছে যে তোকে ধরে রাখব। তবে মনটাকে বোঝাতে পারছি না। কী এক স্বপ্নের ভেতর তিনটা বছর শুধুই হেঁয়ালি। এ জীবনে আর নিজেকে ফিরে পাব বলে মনে হয় না।
—এ বয়সে ছেলেদের ওসব ভালো দেখায় নারে শফি। মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভালো কিছু করবি। তারপর তো করবি সংসার করার চিন্তা।
—সে আর বলে কী হবে। তখন তো তুই থাকবি না।
—আমি নাই-বা থাকি। কত সুন্দরী পাবি। দেশে কি আর মেয়ের অভাব আছে?
—ঠিকই বলেছিস। দেশে সুন্দরী মেয়ে তো অনেক আছে। এভাবেই যদি ভাবতে পারতাম, তবে মনে আর কোনো কষ্ট থাকত না।
বলেই শফি চোখ নিচু করে চলে যায়। তারপর আর যোগাযোগ নেই। বিয়ের পর দীপা যত দিন দেশে ছিল, মাঝে মাঝে দেখা হলে দূর থেকে কেবল চেয়েই থাকত।
ভিসা হওয়ার পর দীপা একাই ফ্লাই করেছিল।
বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে সেদিন স্টেশনে দীপা যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল, হঠাৎ শফি এসে একেবারে সামনে। দীপাকে ঘিরে তখন নানান গল্পে মেতে ছিল তার কয়েকজন বান্ধবী।
শফি দু-একটি সৌজন্য কথাবার্তা শেষে দীপাকে লক্ষ্য করে বলল, চলে যাচ্ছিস বুঝি?
—হ্যাঁ যাচ্ছি। সোহেল তো আসতে পারল না। তাই একাই যেতে হচ্ছে।
—অসুবিধা হবে না। আশা করি ভালোভাবেই যেতে পারবি। উন্নত দেশে গিয়ে তো মানুষ বদলে যায়। তুই পারবি বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে দেশে আমাদের দেখতে আসিস।
কী এক অজানা কারণে দীপা আর বলতে পারল না কিছুই। শফিও হনহন করে বউবাজারের ওই রাস্তা ধরে নিমেষেই দৃশ্যান্তরে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল দিঘির ওই পাড়ে নিবিড় গাছগুলোর ওপর দিয়ে হলুদ কলেজ ভবন। বান্ধবীদের সামনে অনেক কষ্টে সেদিন অশ্রু গোপন করেছিল দীপা। জীবনের কত হাসি-কান্নার সাথি এই ছোট্ট শহরটির জন্য খুব মায়া হচ্ছিল তার।
অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরপরই যন্ত্রের মতো ব্যস্ত জীবন শুরু হয়। কোথায় সেই সুন্দর জীবনের হাতছানি। কোথায় সেই উন্নত দেশের মুগ্ধতা। কারও সঙ্গে দু-একটি কথা বলা দূরে থাক, কেউ কারও দিকে চোখ তুলে তাকায়ও না।
অতিমাত্রায় সংসার-সচেতন সোহেল। খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়। ফেরে সেই রাত দশটায়। সন্ধ্যা ছয়টায় দীপা বাসায় আসে। শুরু হয় রান্না আর ঘর গোছানো। ধোয়া-মোছার তোড়জোড়। রাত এগারোটায় ডিনার শেষে দুটো কথা বলারও ধৈর্য থাকে না। কেউ কারও আগেও নেই পিছেও নেই। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে বাসে বসে মাঝে মাঝে দেশে ফোন দেওয়ার সুযোগ হয়। দীপন আর রিপন ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ল্যান্ড করবে, এই আনন্দে গতকাল বিকেলে বান্ধবী নিপুর সঙ্গে ফোনে অনেক কথা হয়।
অনেক কথার ভিড়ে দীপা জিজ্ঞেস করেছিল, এই নিপু, আমাদের সঙ্গে যে পড়ত, শফি। সে এখন কি করে রে?
—হ, আস্ত পাগল একটা। আছে একরকম। একটা সরকারি স্কুলে জয়েন করেছে। মাসখানেক আগে ওর মা মারা গেছে। অসুস্থ অবস্থায় খালাম্মাকে দেখতে গিয়ে আর বলিস না। আমাদের সবাইকে অনুরোধ করে শফির জন্য মেয়ে দেখতে। মরার আগে ছেলের বউ দেখে যেতে চান। কী যে আকুতি।
—কি! শফি এখনো বিয়ে করেনি?
—আর বলিস না। এ নিয়ে কিছু বললেই সে রেগে যায়। গালাগালি শুরু করে।

ভাইদের আগমন উপলক্ষে দীপা তিন দিনের ছুটি নিয়েছে। আজ এই নীরব সকাল। শীত ভেজা ঘাস। হিম আঙিনায় মিশে আছে কিছু অপূর্ণ আশা। বুকের ভেতর কেঁদে ফেরে কতকগুলো নরম কষ্ট। দেশে ফেলে আসা মায়া মাখা স্মৃতির ভেতর দৌড়িয়ে ক্লান্ত মনটা হঠাৎ কী এক ব্যাকুলতায় হাহাকার করে ওঠে। ঘুমন্ত দুই ভাইয়ের চেহারার দিকে এখন আর তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। এক অজানা কষ্টে বুকটা ব্যথা করে ওঠে। পার্কের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অস্ফুট কান্নায় দীপার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।
দীপার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, শফি এখনো বিয়ে করে না কেন? মা নেই। এখন কে করে ওর দেখাশোনা...।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>