বন্ধুত্বের সীমানা

ভিনোদের সঙ্গে লেখক
ভিনোদের সঙ্গে লেখক

পৃথিবীর বুকে আমার কাছে একমাত্র সম্পূর্ণ সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্ব। অন্য সব সম্পর্কেই কিছু না কিছু আড়াল থাকে, কিন্তু বন্ধুত্বই একমাত্র সম্পর্ক যেখানে কোনো আড়াল থাকে না। বন্ধুত্বের আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এর গভীরতা বা ব্যাপকতা। একজন বন্ধু অন্য একজন বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করে না এমন কোনো বিষয়বস্তু এই ব্রহ্মাণ্ডে নেই। তবে আমার কাছে বন্ধুত্বের সবচেয়ে পছন্দনীয় দিক হচ্ছে, এটাকে কখনই বয়সের মাপ কাঠিতে বাঁধা বা মাপা যায় না। যেমন দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে নাতি-নাতনির, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের, চাচা-চাচি, ফুপা-ফুপু, মামা-মামির সঙ্গে ভাগনে-ভাগনির, শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীর, সহপাঠী-সহপাঠিনীর সঙ্গে অন্য সহপাঠী-সহপাঠিনীর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় ভাই-আপু। আবার একইভাবে উল্টোটা ছোটবেলার খেলার সাথির সঙ্গে বন্ধুত্ব। এমন আরও অনেক রকমের বন্ধুত্ব রয়েছে। আর এখন গুগল ফেসবুকের যুগে বন্ধুত্ব আরও সহজ হয়ে গেছে। আগে যেখানে কলম বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনেক বেগ পেতে হতো এখন একটা মাত্র ক্লিকেই যোগাযোগ করা যায়। তাই বন্ধুত্বের পরিধি এখন সারা পৃথিবীব্যাপী।

অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমার তেমনই দুজন বন্ধু জুটেছে। তাদের বন্ধু বলছি কারণ সপ্তাহে পাঁচ দিন তাদের সঙ্গে দেখা হয়। দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা সুবিধার বিষয় আমরা শেয়ার করি। একে অন্যকে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ উপদেশ পরামর্শ দিই। এদের প্রথমজনের নাম মাইকেল মিকেলপ। আমরা ডাকি মিক বলে। আর দ্বিতীয়জন হচ্ছেন ভিনোদ ওঝা। আমি ডাকি ভিনোদদা বলে।

মিকের উচ্চতা ছয় ফুট নয় ইঞ্চি
মিকের উচ্চতা ছয় ফুট নয় ইঞ্চি

মিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডে। কর্মজীবনের একটা পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া চলে আসেন। সেটা প্রায় বছর দুয়েক আগের ঘটনা। তারপর থেকে তিনি আমার বর্তমান কর্মস্থলে একজন কন্টাক্ট অ্যাডমিন হিসেবে কর্মরত আছেন। সাদা চামড়ার মানুষেরা সাধারণত যেমন হন মিক মোটেও তেমন না। মিক অস্ট্রেলিয়ার বাইরে বিশ্বের কোথায় কখন কী ঘটছে সে বিষয়ে কড়া নজর রাখেন এবং সেটার একটা নিরপেক্ষ ব্যাখ্যাও দেন। শুধু তাই না, যদি কেউ অন্য রকমের ব্যাখ্যা দেন সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনে তিনি যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। আমার সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতে বাংলাদেশ সম্বন্ধে তেমন কিছু না জানলেও এখন অনেক কিছুই জানেন। এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াড় রুবেলের বান্ধবীর নাম যে হ্যাপি, সেটাও তিনি বের করে ফেলেছেন। আমাকে কথা দিয়ে রেখেছেন জীবনের কোনো একটা সময়ে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশে বেড়াতে যাবেন।
মিক অনেক বেশি সংবেদনশীল মনের মানুষ। বাংলাদেশে বন্যার সময় তার সঙ্গে সেটা নিয়ে আলাপ করতে গেলে মিক আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিল তাহলেতো আমরাও কিছু একটা করতে পারি এবং করেছিল। আবার কিছুদিন আগেই নিউরোব্লাস্টিক গবেষণার জন্য একটা চ্যারিটি পার্টির আয়োজন করেছে। গত মাসে মিক দেশে মানে আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল আমার বিমান যখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি নিচে দেখছিলাম। কিন্তু সময়টা রাত হওয়াতে কিছুই দেখতে পাইনি। রোজার সময়, ঈদের সময় আসলে মিক আগ্রহ নিয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে জিজ্ঞেস করত। আমি তাকে এগুলোর কারণ বলতাম যতটুকু আমি জানি। সেটা শুনে মিক বলত আসলে সকল ধর্মেই ভালো কাজকে উৎসাহিত করা হয়েছে আর খারাপ কাজকে মানা করা হয়েছে। ঈদের আগের দিন তাকে বললাম আমি কি তোমাদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে পারি। মিক বলল অবশ্যই, তুমি সবাইকে একটা মেইল করতে পার। তার বুদ্ধিতে সবাইকে মেইল করে ঈদের শুভেচ্ছা জানালাম এবং অভাবনীয় রকম সাড়া পেলাম সকলের কাছ থেকে। তখন ঈদে দেশে না থাকার কষ্টটা কিছুটা হলেও লাঘব হলো।
এবার আসল কারণ বলি যেগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যাবে মিক কীভাবে একজন সহকর্মী থেকে একজন বন্ধু হয়ে গেল। আমি মনেপ্রাণে চেষ্টা করে শৈশব কৈশোরের কিছু দুষ্টুমি এখনো চরিত্রের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জানি না কত দিন সেগুলো ধরে রাখতে পারব। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সেগুলো কাজেও লাগাই। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পরও এর গাছের লেবু চুরি, ওর গাছের আম চুরি, তার গাছের আঙুর চুরি এই অভ্যাসগুলোর নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি অফিসে যখন মিকের সঙ্গে এগুলো নিয়ে আলাপ করি তখন সে খুবই অবাক হতো শুরুর দিকে। পরে আমাদের শৈশব কৈশোরের গল্প শুনে শুনে মিক বুঝল এগুলো আসলে খুবই স্বাভাবিক কাজ এবং এগুলোতে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। তারপর থেকে এ ধরনের চুরিতে মিক আমার সহযোগী। এমনকি ইদানীং সে আমাকে এসে খবর দেয় কোন গাছের লেবু বড় হয়েছে, কোন গাছে আমের মুকুল এসেছে। একদিন মিক আমাকে নিয়ে গেল লেবু চুরি করতে। কিন্তু ভালো লেবুগুলো একেবারে মগডালে থাকাতে আমি বললাম, পারব কীভাবে, আমাদের কাছেতো কোনো লাঠি নেই। মিক বলল আমিতো আছি, বলে একলাফে লেবুটা পেড়ে ফেলল। এখানে উল্লেখ করে রাখি তার উচ্চতা ছয় ফুট  নয় ইঞ্চি। আমি মনে করতাম লম্বা মানুষদের বুদ্ধি কম হয়। কিন্তু মিক আমার সে ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন।
অফিসে চা কফি থাকার পরও আমি আর মিক পালাক্রমে বাইরের একটা দোকান থেকে কফি এনে খেতে শুরু করলাম। আমাদের দেখাদেখি এখন সবাই সেই দলে শামিল হয়েছেন। আমরা সকলে মিলে পালাক্রমে কফি কিনে নিয়ে আসি। তা ছাড়াও মাঝেমধ্যে আমরা নারিকেলের কেক নিয়ে আসি নাশতার জন্য। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর আমরা অফিসের কোনার চৌরাস্তার মোড়ে ফুটপাতের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিই। জায়গাটা এত চমৎকার যে প্রতিদিন ওখানে বসে মিকের সঙ্গে দু-এক মিনিট আড্ডা না দিলেই নয়। মিক আমাকে বলে রেখেছেন পরবর্তী ঈদে আমাদের বাসায় বেড়াতে যাবেন। তার আমাদের রান্না খুবই পছন্দ হয়েছে। আমি সেই অপেক্ষাতে আছি। সে আমার লেখালেখির বিশাল ভক্তও। নতুন কোনো লেখা প্রকাশিত হলেই বলেন তাকে লিংক পাঠিয়ে দিতে। গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন আর আমার কাছ থেকে শুনে নেয় সারমর্ম কি। আমার লেখা প্রকাশিত হলে মিক চিৎকার করে অফিসের সবাইকে জানান। এ যেন একেবারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্বের অকৃত্রিম রূপ। আমি খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি এমন একজন মানুষকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে।
ভিনোদদার সঙ্গে পরিচয় একেবারেই কাকতালীয়ভাবে। ট্রেনে করে অফিসের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে তিনি কোনো একটা স্টেশন থেকে উঠে আমার পাশে বসেছিলেন। তারপর মোবাইলে আমাকে বাংলা পত্রিকা পড়তে দেখে বুঝেছিলেন, আমি বাঙালি। পরে সাহস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বাংলাদেশের? তারপর তার সঙ্গে আলাপ শুরু হলো। এরপর আমাদের নামার স্টেশন আসার আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আলাপ জমে উঠল এবং কাকতালীয়ভাবে আমরা দুজন একই স্টেশনে নামি। কথায় কথায় জানলাম ভিনোদদা নেপালের ছেলে। তিনি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাবরক্ষণ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেখান থেকেই তিনি বাংলা বলা শিখে গেছেন এবং কিছুটা হলেও তিনি এখনো বাংলা পড়তে পারেন। বলাইবাহুল্য আমাদের সমস্ত কথাবার্তায় হচ্ছিল বাংলায়।

চ্যারিটিসহ সব কাজেই মিকের সক্রিয় উপস্থিতি
চ্যারিটিসহ সব কাজেই মিকের সক্রিয় উপস্থিতি

ভিনোদদা খুবই হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মানুষ। সামান্য আলাপেই আমাদের একে অপরের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা হয়ে গেল। তিনি পড়াশোনা শেষ করে জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছেন পরিবার নিয়ে। অবশ্য পরিবার বলতে শুধু তিনি আর তার স্ত্রী। দুজনই কাজ করেন আর সপ্তাহান্তে ঘুরে বেড়ান। এটা শুনে বললাম, আপনাদের জন্য এক বুক হিংসা হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেন? আমি বললাম বিবাহিত জীবন তত দিন সুখের যত দিন সন্তান সন্ততি না থাকে। এরা আসার পরই শুরু হয় আসল ঝামেলা। তিনি আমার কথা শুনে হেসেই খুন। কথায় কথায় আমাদের নামার স্টেশন চলে আসাতে আমরা একসঙ্গে নেমে পড়লাম। তারপর স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় তাঁকে আমার ব্যাগে রাখা পেয়ারা দিলাম। তিনি পেয়ারা পেয়ে খুবই খুশি হলেন। বললেন আপনার বৌদিকে দেব বাসায় ফিরে। পরদিন দেখা হওয়ার পর বললেন, পেয়ারা খেলে কি পেটে সমস্যা হয়। আমি বললাম পেয়ারা হজমে সহায়ক তাই একটু বেশি খেলে সমস্যা হতে পারে। তিনি বুঝে ফেলেছেন এমন ভাব করে মাথা নাড়লেন। তার সবচেয়ে পছন্দের তরকারি হচ্ছে ইলিশ মাছ কিন্তু তিনি যেখানে থাকেন সেখানে ভালো ইলিশ পাওয়া যায় না। আর যেটা পাওয়া যায় দাম বেশি। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমরা যেখানে থাকি সেখানকার দোকানে ভালো ইলিশ পাওয়া যায় কিনা? আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আপনি বৌদিকে নিয়ে একদিন আসেন, আমি ইলিশ কিনে দেব আপনাদের। অবশ্য এখনো তিনি সময় করে আসতে পারেননি।
ভিনোদদা বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশাল ভক্ত। বাংলাদেশের যার সঙ্গেই খেলা থাকুক তিনি দেখবেন এবং অবশ্যম্ভাবী বাংলাদেশকে সাপোর্ট করবেন। আমি খেলা দেখলে বাংলাদেশ হেরে যায় বলে অনেক দিন হয়ে গেল বাংলাদেশের কোনো খেলাই দেখা হয় না। পরে ইউটিউবে হাইলাইটস দেখি। কিন্তু তিনি খেলার আদ্যোপান্ত দেখেন এবং নিয়মিত খেলার খবর রাখেন। তিনি আমার কাছ থেকে পূজার খবর নিলেন এবং জানালেন, পূজা দেখতে এলে আমাকে জানাবেন। ঈদের সময় তাকে দাওয়াত দিয়ছিলাম। অবশ্য তিনি আসতে পারেননি। এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমার দুটি সাইটের কাজ চলছে তার কাজের জায়গার কাছাকাছি। একদিন দুজন একসঙ্গে নেমে একই রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মাঝপথে তিনি থেমে বললেন এখানে একটা দোকানে ভালো কফি পাওয়া যায়। বলে একটা দোকানে নিয়ে গেলেন এবং কোনোভাবেই আমাকে কফির বিল দিতে দিলেন না। এখন প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে আমার দেখা এবং আড্ডা হয়। তার ওঠার নির্দিষ্ট স্টেশন এলে আমি তাকে খুঁজতে থাকি। খুঁজে না পেলে তাকে মেসেজ দিই, আপনি কোথায়? এমনকি তিনি কাজ শেষ করে আমাকে মেসেজ দেন, দাদা আপনি কোথায়? এইভাবে আমরা এক অপরের এখন অনেক ভালো বন্ধু।
শুরুতেই বলেছিলাম পৃথিবীর বুকে বন্ধুত্বই আমার কাছে একমাত্র পরিপূর্ণ সম্পর্ক। আর জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভালো বন্ধুর তুলনা হয় না। আমি সেই দিক দিয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশি এত মানুষ আমার বন্ধু যে, সেই তালিকা করে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আছেন। তার বাইরে ভিনদেশি এমন বন্ধু পেয়ে নিজেকে আরও বেশি সৌভাগ্যবান মনে হয়। তাই মনে মনে দোয়া করি আমার সকল বন্ধু ভালো থাকুক আর দিনে দিনে এই পৃথিবীটা হয়ে উঠুক বন্ধুত্বের সূতিকাগার।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।