আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক যতীন সরকার

যতীন সরকার। সংগৃহীত
যতীন সরকার। সংগৃহীত

আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক যতীন সরকার স্যার সম্পর্কে কিছু লেখার সাহস আমার কখনো হয়নি। এমন একজন সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক, যাঁর পদচারণা রয়েছে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখায়, তাঁকে নিয়ে লেখা দুঃসাহসই বটে। তারপরও, অধিকারের জায়গা থেকে (একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি সেই অধিকারপ্রাপ্ত বলেই মনে করি) অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজ সত্যি সত্যিই লিখতে বসে গেলাম। আমার এ লেখা নিশ্চয়ই এমন কারও না কারও দৃষ্টিতে পড়বে যিনি যতীন স্যারকে আমার থেকে অনেক বেশি জানেন, চেনেনও। সে ক্ষেত্রে, আমার সীমাবদ্ধতাকে আমলে না নিয়ে আপনার মন্তব্য বা পরবর্তী কোনো লেখায় পরিপূর্ণ রূপ দেবেন এই আমার নিবেদন। আর স্যারের কাছে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার লেখার ভাষার কারণে।

যতীন স্যারের হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে আমাকে নির্দিষ্ট করে মনে রেখেছেন সেটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৯৯-২০০১ শিক্ষাবর্ষ, আমি তখন নাসিরাবাদ কলেজের ছাত্র, আর স্যারের অধ্যাপনা জীবনের প্রায় শেষ পর্ব চলছে। ২০০১-২০০২ সালের দিকে অবসরে যাবেন। গুরুগম্ভীর বাংলার অধ্যাপক, চেহারায় জ্ঞানের গভীরতার ছাপ স্পষ্টতই অনুভব করা যায়। বাংলা প্রবন্ধের ক্লাসে পড়ানোর সময় বিষয়ের গভীরে ঢুকে যে রসবোধের সৃষ্টি করেন তা না দেখলে কখনই বোঝা যেত না গুরুগম্ভীর অধ্যাপকের ভেতরটা কতটা সাহিত্যরসে ভরপুর। জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর একটু ক্লান্তি আর অবসাদ আসবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যতীন স্যারের বেলায় দেখেছি ঠিক তার উল্টো। স্যার যখন ক্লাসে ঢুকতেন আমরা দেখতে পেতাম কখনো একরঙা ধূসর বাদামি বা কখনো সাদা রঙের খাটো পাঞ্জাবির সঙ্গে শ্বেতশুভ্র ধুতি পরিহিত এক ষাটোর্ধ্ব যুবক দ্রুততার সঙ্গে ক্লাসে প্রবেশ করছেন। যাঁর কর্মে ক্লান্তি বা অবসাদের রেখাচিহ্ন বিন্দু পরিমাণও পরিলক্ষিত হতো না। অক্লান্তভাবে শিক্ষাদানই যেন তাঁর পরমব্রত।
ক্লাসে প্রবেশ করা মাত্রই চরম হট্টগোলের ক্লাসরুমে নিমেষেই নেমে আসত পিনপতন নীরবতা। না, স্যারের রক্তচক্ষু শাসনে নয়। স্যারের ব্যক্তিত্বের আলোকচ্ছটায় ক্লাস আলোকিত হতো আর জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটত যা আমরা তৃষ্ণার্ত ছাত্ররা পিনপতন নীরবতায় এর কিঞ্চিৎ পান করার চেষ্টা করতাম। ক্লাস রুমের ধারণক্ষমতার কখনো কখনো দ্বিগুণ ছাত্রছাত্রী স্যারের ক্লাসে উপস্থিত থাকত। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমাদের ক্লাসে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কি এতই যে প্রতি বেঞ্চে তিনজনের স্থলে পাঁচজন বসার পরেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না, অনেকেই পেছনে দাঁড়িয়ে ক্লাস করছে! হ্যাঁ, আমার মনে হয় সেদিনই ছাত্রছাত্রীর শতভাগ উপস্থিতি থাকত যেদিন যতীন স্যারের ক্লাস থাকত। স্যার আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ পড়াতেন। এমন কঠিন বিষয় এত সহজ আর সাবলীল ভাষায় স্যার পড়াতেন যে, আমরা সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও এর রস থেকে যেত পরবর্তী ক্লাস পর্যন্ত। আর পাস করে চলে এলেও এক যুগ পরেও আজও সেই স্বাদ লেগে আছে ঠিক নতুনের মতোই। এই স্বাদ ভোলার নয়। কিন্তু যে কথাটি আজ স্যারকে নিয়ে লিখতে বসে বারবার ঘুরেফিরে একটি জিজ্ঞাসাই নিজের ভেতরে চলে আসছে তা হলো, স্যারের অকৃপণ বিতরণকৃত জ্ঞানের কতটুকুইবা আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি?
স্যার ক্লাসে প্রবন্ধ পড়ানোর সময় নানা ধরনের উদাহরণ দিতেন যা প্রবন্ধের মতো কঠিন বিষয় আমাদের কাছে সহজবোধ্য মনে হতো। তার কারণ প্রত্যেকটি উদাহরণে থাকত বাস্তব কোনো ঘটনার বর্ণনা, অথবা প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ রচনাকালের কোনো ঘটনা, নয়তো প্রবন্ধ রচনার পেছনের গল্প। যা আমাদের বিমোহিত করত এবং আরও উৎসাহিত হতাম আর আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতো তারপর কী, তারপর কী তা জানার! এই যে পাঠদানের সময় ছাত্রের ভেতরে পরের ঘটনা জানার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা বা তৈরি করার কৌশল তা কেবল একজন আদর্শবাদী ভালো শিক্ষকেরই বৈশিষ্ট্য। ব্যাপারটি তখন এভাবে উপলব্ধি করতে না পারলেও আজ পরিণত বয়সে সেটি ভালোভাবেই বুঝতে পারি।
একদিন ‘হ’ আর ‘শ’–এর আঞ্চলিক উচ্চারণের কথা বলতে গিয়ে একটি মজার উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, নাছিরাবাদ কলেজের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের। ব্যাপারটি মাথায় রেখেই হয়তো স্যার প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছিলেন। বলছিলেন, নেত্রকোনার মানুষজন ‘শ’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করেন। একদা দুই ট্রেন যাত্রীর মধ্যে কথা হচ্ছিল। একজন বললেন, নেত্রকোনার মানুষ শ কে হ উচ্চারণ করে (স্যারের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায়)। অন্যজন উত্তর দিলেন, আপনি কই (কোথায়) হুনছেন? প্রতি উত্তরে প্রথম ব্যক্তি বললেন, এই যে আপনি বললেন! আপনিতো নেত্রকোনার মানুষ!
আবার স্যার অন্য এক প্রসঙ্গে বললেন, কোনো একজন অনেক বড় একটি চাকরি পেয়ে এলাকার মুরুব্বির কাছে গেল দোয়া চাইতে। কদমবুচি করে যখন মাথা তুলে দাঁড়ালেন, মুরুব্বি যুবকের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন, ‘হতায়ু হও’। ব্যাপারটি ছিল, শ এর স্থলে হ উচ্চারণ করলে কখনো কখনো বিপরীত অর্থ দাঁড়ায়, আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়। যেমন শতায়ু হলো শতবর্ষ বেঁচে থাকা। আর হতায়ু হলো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাও। এমন মজার মজার উদাহরণ শোনার পর ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়। এ রকম আরও মজার মজার প্রাণবন্ত উদাহরণের মাধ্যমে স্যার আমাদের প্রবন্ধ পড়াতেন। স্যারের পড়ানোর এই স্টাইলটি খুবই ইউনিক যা দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি পাইনি।
শুধু পড়ানোর স্টাইলই নয়, পোশাক-পরিচ্ছদ আর স্যারের জীবনধারারও একটি নিজস্ব স্টাইল আছে যা আমাদের বিস্মিত করত। আলাদা করে নিজস্ব বলার প্রয়োজন ছিল না। কারণ স্টাইল ব্যাপারটাই হলো নিজস্ব। তারপরও নিজস্ব শব্দটা ব্যবহার করলাম আরও জোর দিয়ে বোঝানোর জন্য। এই মুহূর্তে একটা ছোট কথোপকথনের কথা মনে পড়েছে। একবার আমার কোনো এক অনুজকে ইংরেজিতে mistake লিখতে বললাম। সে লিখল misttake। আমি বললাম, তুমি মাঝখানে দুটো ‘t’ দিয়েছ কেন? সে বলল যে একটাই দিতাম, একটু জোর দিয়ে লিখলাম যেন সত্যি সত্যি মিসটেক না হয়ে যায়!
যা হোক প্রাসঙ্গিকতায় ফিরে আসি। স্যারকে দেখতাম যে সব সময় সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরিধান করে কলেজের কেতা-দুরস্ত বাঙালি ছাত্রদের ক্লাস পরিচালনা করা, সভা-সমাবেশের প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকা, কিংবা সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা-সমিতি করতে। যুগের পর যুগ চলনে-বলেনে, জ্ঞান অন্বেষণ আর বিতরণ দুইয়েই নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখা, হাজারো সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মাঝে নিজেকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, এমনকি পোশাকে-আশাকে নিজস্ব স্টাইলের একটা ধারা তৈরি করা আর তা অব্যাহত রাখা কেবল যতীন স্যারের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। এমন স্টাইলিশ ব্যক্তিত্ব আজকাল সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না।
স্যার আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। কালচারড শব্দটার প্রায়োগিক অর্থ আজকের প্রেক্ষাপটে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। গান-বাজনা-সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্তদেরই কালচারড মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরীর মতে, এগুলো হলো কালচারের উপায়, কালচারের উদ্দেশ্য হলো নিজের ভেতর একটা আল্লাহ বা ঈশ্বর সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচারের অভিধা পাওয়ার যোগ্য। ধার্মিকেরা সেটা পারে না। যতীন স্যার এদিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। স্যারের মতো এমন আপাদ-মস্তক সংস্কৃতিমান মানুষ খুব একটা দেখা যায় না।

লেখক
লেখক

ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে পাস করে চলে এসেছি তাও আজ থেকে পনেরো বছর আগে। এর মধ্যে স্যারের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু কলেজে থাকাকালে স্যারকে যতটুকু চিনতাম, কলেজ থেকে বের হয়ে এসে গত পনেরো বছরে তাঁকে চিনেছি আরও বেশি। বিশেষ করে গত দশ বছরে স্যারের সৃষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যত, স্যারকে চিনতে ও আবিষ্কার করতে পেরেছি তত। আমি আগে ছিলাম স্যারের শুধুই ছাত্র। আর তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে হয়ে গিয়েছি ভক্ত। গত ১৮ আগস্ট ছিল স্যারের ৭৯তম জন্মদিন। দেশের নানাবিধ সংকট আর টানাটানির মধ্যে স্যারের জন্মদিনটি নীরবে-নিভৃতে চলে গেল। যদিও বিলম্বিত, তবুও স্যারের অসংখ্য ছাত্র আর ভক্তের পক্ষ থেকে স্যারকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। স্যার বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন, সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের ভাষাকে। অন্তর থেকে চাই শতায়ু হোন। আমাদের চাওয়ার সীমাবদ্ধতা আছে কারণ আমরা অজ্ঞ। তাই ‘হে মনীষী, আপনি আমাদের এই চাওয়ার সীমাবদ্ধতাকে আমলে না নিয়ে আপনার সৃষ্টিশীল সাহিত্য দিয়ে এই ঘুণে ধরা সমাজকে জরামুক্ত করুন—কারণ আপনি বিজ্ঞ।’

তৌফিক আহমেদ: পিএইচডি গবেষক, অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, জাপান।
ইমেইল: <[email protected]>