বৈষম্য ও বিড়ম্বনা

ভিসা নিয়ে বিড়ম্বনা প্রবাস যাত্রার প্রধান অন্তরায়। অন্তত বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট তা বলাবাহুল্য। পৃথিবী বড় বৈচিত্র্যময়। তেমনি বিচিত্র বৈষম্যের মাত্রা। প্রবাস জীবনের অনেক সমস্যার একটি হচ্ছে পরিচয় সংকট। বিশেষ করে দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে (চীন, জাপান ও কোরিয়া ইত্যাদি)। এ সব দেশে বিদেশিদের আলাদা করতে এক পলক নজরই যথেষ্ট। প্রথম যখন কোরিয়াতে পা রাখি, ভিন্নতার জন্য নিজেকে সব সময় কোরীয়দের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আবিষ্কার করতাম। আস্তে আস্তে সেটা সয়ে গেলেও, কখনই এ দেশিদের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলতে পারিনি। বাকি থাকল বাংলাদেশি আর অন্য দেশি বন্ধুরা।

আজকের গল্প ভিনদেশি বন্ধুদের নিয়ে। বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ কোরিয়া খুব জনপ্রিয় গন্তব্য। মূলত বিদেশিদের মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষকদের সংখ্যাই এ দেশে বেশি। ইপিআইকের (ইংলিশ প্রোগ্রাম ইন কোরিয়া) আওতায় সাতটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় কোরিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। চাকরি, ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক মিল থাকার কারণে এই শিক্ষকেরা নিজেদের একটা জগৎ গড়ে নিয়েছেন। তারা কোরিয়ার বিভিন্ন শহরে নানা সামাজিক ক্লাব, অনুষ্ঠানসহ রকমারি আয়োজন করে থাকেন।

দেজন শহরের এমনি একটি সংগঠন হলো ‘দেজন ওয়ার্ডসস্মিথ’। এই সংগঠন গান, কবিতা, নাটকসহ যেকোনো স্বকীয় পারফরম্যান্স মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে মঞ্চস্থ করে। বর্তমানে সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হলেও, প্রথম দিকে জমজমাট ছিল। পানশালার খোলা মঞ্চে গান বা কবিতা, নিজেদের সংস্কৃতির আলোকে কোরিয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা ছাড়াও এক একটা আয়োজন ছিল নানা দেশি মানুষের এক অদ্ভুত মিলনমেলা।
সাহিত্যে বরাবরই কাঁচা হওয়ার কারণে এই সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল আমার আওতার বাইরে। কিন্তু হঠাৎই আমাকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। সংগঠনটির পরিচালকেরা তাদের সাহিত্যকর্মকে বই আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে তারা বিভিন্ন শোয়ের সঙ্গে একটি ছোট নাটিকা মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করলেন। নাটিকাটির জন্য তাদের একজন বিশোর্ধ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যুবক প্রয়োজন, যার নাম হবে আবদুল খান।
পূর্বপরিচিতির কারণে আমাকে তারা বেছে নিয়েছেন। একে তো আমি জীবনে কখনো অভিনয় করিনি। অন্যদিকে বিষয়বস্তু বেশ অস্বস্তিকর। অজানা দেশের একজন মুসলিম যুবকের ইউরোপের একটি কাল্পনিক দেশের ভিসা আবেদন এবং বিনা কারণে তার ভিসার আবেদন নাকচ হওয়ার এক অদ্ভুত কাহিনিই এই নাটকটির বিষয়বস্তু। নাটিকাটির শেষ মুহূর্তে একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর আগমন ঘটে এবং মুহূর্তেই তার ভিসাপ্রাপ্তি মোটা দাগে বৈষম্যকে তুলে ধরেছে।
আমি প্রথমেই এই নাটিকার লেখিকাকে পাকড়াও করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার উদ্দেশ্য কি? তিনি যা বললেন তা অত্যন্ত অদ্ভুত। লেখিকার দেশ আয়ারল্যান্ড কিন্তু তার ছেলেবন্ধু একজন পাকিস্তানি। তারা দুজনে মিলে যখনই ইউরোপ ভ্রমণের প্ল্যান করেন, ছেলেবন্ধুর জন্য ভিসা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তাই তিনি তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে এই নাটকে তুলে ধরেছেন। জাতীয়তা ও ধর্ম নিয়ে বৈষম্যের কাহিনি ভারতীয় উপমহাদেশের ছায়াছবির মূল বিষয়বস্তু হলেও, সুদূর প্রবাসে এসে আবার দেখতে হবে তা ভাবিনি। আমি বললাম তোমার বন্ধুকে অভিনয় করতে বলো। তার চেয়ে ভালো এই কাজ আর কে করতে পারবেন। জানা গেল, সেই ভদ্রলোকের মঞ্চ ভীতি আছে। তাই আমাকে ডাকা। সাত-পাঁচ ভেবে রাজি হয়ে গেলাম।
শুরু হলো প্রস্তুতি পর্ব। পশ্চিমাদের খুঁতখুঁতে ভাব আগে কেবল শুনেছি এবার চক্ষু ও কর্ণের বিবাদ মিটে গেল! একটা পারফরম্যান্সের জন্য তাদের যে চেষ্টা আর সাজসজ্জা দেখলাম, এক কথায় অভাবনীয়। তারা বাংলাদেশি পাসপোর্টের একটা নমুনা জোগাড় করলেন অজানা দেশের পাসপোর্ট হিসেবে এবং আমেরিকার পাসপোর্ট নেওয়া হলো শ্বেতাঙ্গ নারীর জন্য। এ ছাড়া ইউরোপের ভিসার ফরম (Schengen visa) ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা হলো। আমাকে বলা হলো সংলাপ মুখস্থে মন লাগাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম পোশাক-আশাকের কোনো নির্দেশনা আছে কিনা। উত্তর এল, তুমি যেরকম ঠিক সে রকমভাবেই মঞ্চে উপস্থিত হবে, বাড়তি কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না।
মুখস্থবিদ্যাতে একসময় আমি খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু এবার শুধু মুখস্থ ক্ষমতাই নয়, পরিবেশনাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট দিনে সংলাপ মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে উপস্থিত হলাম। প্রচুর দর্শকের আগমন হয়েছে। কেউ গল্পে মশগুল। কেউ বই কিনছেন। আর আমি এককোনায় সংলাপ মুখস্থ করছি। একজন কোরীয় নারী এসে বললেন, তোমার আজ পারফরম্যান্স নাকি? আমি কোনোমতে ভদ্রতার হাসি দিয়ে আবার সংলাপে মন দিলাম।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলো। সকল কাগজপত্র সমেত আমি ‘আবদুল খান’ ইউরোপ যাত্রার জন্য ভিসা অফিসারের কাছে আবেদনপত্র দাখিল করলাম। পানশালায় পিনপতন নীরবতা নেমে এল। শুরু হলো ভিসা অফিসার কর্তৃক আবদুল খানকে অহেতুক হয়রানি—ভিসা ফরম ইংরেজিতে কেন? লাতিন হতে হবে...আমন্ত্রণপত্র কেন রাজ পরিবারের থেকে নয়?...ব্যাংক স্টেটমেন্টের প্রতিটি খরচের হিসাব নেই কেন?...এমপ্লয়মেন্ট লেটার হতে হবে ভিডিও আকারে এবং ভিএইচএস টেপ (VHS tape) ফরম্যাট ছাড়া আর কোনো ফরম্যাট গ্রহণযোগ্য নয়...ছবি হতে হবে A4 সাইজ, পাসপোর্ট সাইজ ছবি চলবে না...১৩ তলা বিশিষ্ট ভবনে বসবাসকারী কাউকে ভিসা দেওয়া হয় না! শুধু তাই না, সবকিছু যদি অ্যামব্যাসির চাহিদা মাফিক হয়ও তাও ভিসা বছরের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া দেওয়া হয় না বলে ঘোষণা করা হলো! এইরকম পরিস্থিতিতে শ্বেতাঙ্গ নারীর মঞ্চে প্রবেশ। তার একহাতে রয়েছে বিলাসিতার প্রমাণস্বরূপ স্টারবাকস (StarBucks) কফির ঢাউস কাপ, অন্য হাতে মোবাইল ফোন। তিনি এসেই ভিসা দাবি চাইলেন এবং বিনা বাধায় তার পশ্চিমা পাসপোর্টে আবদুল খানের সামনেই ভিসা নিলেন। নাটিকাটি শেষ হয় শ্বেতাঙ্গ নারীর প্রতি আবদুল খানের অবাক দৃষ্টির মাধ্যমে।
শ্বেতাঙ্গ নারী চরিত্রটি মঞ্চে আসার আগ পর্যন্ত আমার সংলাপ ছিল সাবলীল। কিন্তু মঞ্চে প্রবেশ করেই আমার দিকে চোখ পড়তেই শ্বেতাঙ্গ নারী রূপদানকারিণী খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়, নাটিকার হাস্যরসাত্মক সংলাপ আর আমাকে ওই অবস্থায় দেখে তার বেদম হাসি পেয়ে যায়। শো শেষ হওয়ার তোয়াক্কা আর তিনি করেননি। বোধকরি বেশির ভাগ দর্শকই শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় শো শেষ হওয়ার পর খুব একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু লেখিকার উচ্চ প্রশংসা আমি পেয়েছিলাম। তার প্রশ্ন ছিল মঞ্চে এত স্বাভাবিক তুমি ছিলে কি করে? সেই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু ভিসা নিয়ে বিড়ম্বনা যে সারা জীবন থাকবে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তাওসীফ রহমান: দেজন, দক্ষিণ কোরিয়া।