যত দূরে যাও
একেবারে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মরমি গানের সাধক ও বাঁশির জাদুকর বারী সিদ্দিকী।
বারী সিদ্দিকীর কাছে আমরা জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। ২০১৪ সালে ষষ্ঠ প্রবাস প্রজন্ম, জাপানের আমন্ত্রণে তিনি টোকিও এসেছিলেন। ৪ মে অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোরদের সঙ্গে সারা দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত সময় কাটান। নিজ হাতে তাদের পুরস্কৃত করেন এবং শেষে বাঁশি বাজিয়ে ও মরমি গান গেয়ে জাপান প্রবাসীদের মন ভরিয়ে দেন।
কেবলমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশুদের টানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি সিরিজ কনসার্টের মাঝখানে একটা কনসার্টের সময় পরিবর্তন করে দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের কষ্ট সহ্য করে নিউইয়র্ক থেকে মাত্র তিন দিনের জন্য জাপানে আসেন। এরপর আবার নিউইয়র্কেই ফিরে যান। এই সফরটি হয়েছিল একেবারে তার আগ্রহে এবং কোনোরকমে সম্মানী ছাড়াই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সময় বিজনেস ক্লাসে বিমান ভ্রমণ করলেও তিনি আয়োজকদের সাশ্রয়ের কথা ভেবে জাপানে ইকোনমি ক্লাসে আসেন। আকাবানের একটা সাধারণ হোটেলেই তিনি থাকেন।
বারী সিদ্দিকী আসছেন শুনে সুবীর নন্দীও জাপানে আসার আগ্রহ দেখান এবং চলে আসেন। দুজন একই দিনে একই সময় ভিন্ন বিমানবন্দরে আসার কারণে আমরা কেউ নারিতা, কেউ হানেদায় গিয়ে তাদের বরণ করি। মণি আর নান্নু ভাই হানেদা যান সুবীর নন্দীকে রিসিভ করতে। আজাদ ভাই আর আমি নারিতা গিয়ে বারী ভাই ও তার সহযাত্রী আত্মীয়কে রিসিভ করি।
বারী ভাইয়ের সঙ্গে সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর যে কয়দিন তিনি ও সুবীর নন্দী ছিলেন আমরা সর্বদা কেউ না কেউ সার্বক্ষণিক একসঙ্গেই ছিলাম। ভাব গম্ভীর বারী সিদ্দিকীর ভেতরটা যে কতটা সহজ ও দরদি গানের মতো সাবলীল, ভাব ও সাধনা মানুষকে যে কতটা মর্যাদাবান করে তা সামান্য তিন দিনের সান্নিধ্যেই বুঝে গেছি। সুবির নন্দীও বারী সিদ্দিকীকে কী পরিমাণ ভক্তি করেন তাও দেখেছি।
৪ মে সারা দিনব্যাপী ষষ্ঠ প্রবাস প্রজন্মের অনুষ্ঠান। বারী ভাই মঞ্চে বসে প্রতিটি শিশুর পারফরমেন্স দেখছেন। সবাইকে জড়িয় ধরে আদর করছেন। নিজ হাতে মেডেল পরিয়ে দিয়েছেন ও পুরস্কার দিয়েছেন। শেষে তার জাদুর বাঁশি বাজিয়ে আর মরমি গান গাইয়ে জাপান প্রবাসীদের হৃদয় ভরিয়ে দেন। ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ও ‘এক মুঠো মাটির মালিকানা’—আরও কত চোখ ভিজিয়ে দেওয়া গান! দীর্ঘ বাঁশি।
সব এখনো জাপান প্রবাসী দর্শকদের মনে জ্বলজ্বলে।
অনুষ্ঠানে বারী সিদ্দিকীকে তখন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন কর্তৃক ষষ্ঠ প্রবাস প্রজন্ম জাপান সম্মাননা প্রদান, পরদিন প্রবাসী কমিউনিটির সংবর্ধনা। সেটি উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রশ্নোত্তরে মঞ্চে উপবিষ্ট বাংলা গানের দুই কিংবদন্তি বারী সিদ্দিকী ও সুবীর নন্দীর কাছে থেকে কত অজানা কথা জানা হলো।
নারিতা বিমানবন্দরে বিদায়বেলা আমরা রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে বসি। অনেক কথা হয়। সে সময় প্রবাস প্রজন্মের মতো এত বড় কাজ করার জন্য মণিকে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন এবং এই শিশু কিশোরদের জন্য তিনিও কিছু করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রতিশ্রুতি দেন প্রবাস প্রজন্ম জাপানের থিম সংগীতটি তিনি করে দেবেন এবং আবার জাপান আসবেন।
না জাপানে তিনি আর আসেননি। এর পরপরই তিনি তার মারাত্মক ব্যাধির খবর জানতে পারেন। সেই চিকিৎসা করতে করতেই তো চলে যাওয়া। বারী ভাই যেখানেই থাকেন ভালো থাকেন। তার গানের লাইন ধরে বলি—‘ছোট্ট একটা মাটির ঘর, কেউ আসে না নিতে খবর।’
বারী ভাই, চলে গেলেন? ‘দুঃখ রইল মনে।’
(প্রয়াত বারী সিদ্দিকী স্মরণে)
কাজী ইনসানুল হক: টোকিও, জাপান।