বিজয়ের মাসের প্রতিজ্ঞা

ছবি: সোয়েল রানা
ছবি: সোয়েল রানা

ধারাবাহিক এই রচনা খুব শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে শুনে অনেক পাঠক আমাকে ইনবক্সে অনুরোধ করেছেন, লেখাটি চালিয়ে যেতে। নিঃসন্দেহে সুপ্রিয় পাঠকদের ভালোবাসা আমাকে উদ্বেলিত করেছে। আর পাঠকদের ভালোবাসাই একজন লেখকের অনুপ্রেরণা।

আমার ধারাবাহিকের গত পর্বের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার, নারীর মর্যাদা ও সর্বোপরি নারী নির্যাতন ইত্যাদি। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করেও অনেক সময় সেকেলে মনমানসিকতা থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে প্রায়ই অক্ষমতা দেখিয়ে থাকি। তা অনেক সময় মুখে না বললেও আমাদের কাজকর্মে প্রতিফলিত হয়।
একজন লেখকের কাজ হলো সমাজের সামনে বাস্তব তুলে ধরা এবং নিজের মতামত স্বাধীনভাবে উপস্থাপন করা। একজন নারী কারও স্ত্রী, কারও বোন হতে পারেন। কিন্তু আমাদের চোখে দেখা আর কর্মে প্রতিফলিত করার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নাই। আমাদের সমাজে নারীরা আজও নির্যাতিত ও নিপীড়িত। রুপাকে ধর্ষণ ও হত্যার পর আমি কলম নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে দাঁড়িয়েছি।
হ্যাঁ, কলম দিয়ে সোচ্চার কণ্ঠেও দাঁড়ানো যায়। আমার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার তুলনা করার চেষ্টা করেছি এবং নিজের অভিমত অনেকাংশে ফুটে উঠেছে। লেখক সত্য বলতে লুকোচুরি করতে পারেন না। আর আমি অন্য দশজন লেখক থেকে ব্যতিক্রম নই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত পর্বে বাংলাদেশের পাঠকেরা কীভাবে নিয়েছেন তা আমার ইনবক্সে মেসেজ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপরও আমি লিখেছি সংস্কৃতি স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্ন হয়। আমাদের সমাজে যা অপসংস্কৃতি, তা হয়তো অন্য দেশে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের অংশ।

লেখক
লেখক

অস্বীকার করার অবকাশ নেই, সব পাঠকের কাছে আমার লেখাগুলো যে ভালো লাগবে তা নয়। আমরা সাধারণত জানি ও বুঝতে পারি বাস্তবতা আসলে অপর্যাপ্ত, অগভীর ও প্রতারণামূলক। যা অবিচার, যা অসমাপ্ত, অসীম তা হয়তো আপেক্ষিক! সত্যের জন্য আমরা সাধারণত যা নিয়েছি তা অলীক মরীচিকা এবং সত্যিই দূরে হতে পারে। এই বিস্তৃত সময়, স্থান এবং বাস্তবতা, হিংস্রতা, সহনশীলতা, সংযমতা, দানশীলতা সবই হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণ। পর্যবেক্ষণে আমাদের স্বার্থপর হলে চলবে না।
যেমন পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। যারা বাংলাদেশকে সমর্থন করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা সব সময়ই নন্দিত। আবার যারা বিরোধিতা করেছেন তাদের রাজাকার হিসেবে আমরা আখ্যায়িত করে থাকি, তারা সব সময়ই নিন্দিত। কিন্তু ভারতবর্ষ ইংরেজরা বিভক্ত করে এল। মহাত্মা গান্ধী এটা সমর্থন করেননি। আমি মনে করি তিনি সঠিক ছিলেন। অনেকেই হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন না। ওই সময়ে আমার মতো কেউ মতামত প্রকাশ করলে হয়তো তা সময়ের দাবি হতো না।
এ রকমই আমরা যা মনে করি তা যে সঠিক, তা জোর দিয়ে বলা ঠিক হবে না। আমার কাছে যা সঠিক অন্যের চোখে অথবা স্থান, কাল, পাত্রভেদে তা হয়তো পরিবর্তন হতে পারে। তাই অনেকের চোখে আমার মতামত সঠিক মনে হবে, অনেকেই সমর্থন করবেন আবার অনেকেই সমর্থন করবেন না। প্রত্যেকেই তার মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করবেন। স্বাধীনভাবে কথা বলার স্বাধীনতার জন্যই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যুদ্ধ করেছেন আমার শ্রদ্ধেয় বাবা–চাচা। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সে ফল আমি কেন ভোগ করব না!
যা হোক, প্রবাসে আবাস ২৫ পর্বের পর বন্ধ হবে অনেকটা নিশ্চিত। ছয় মাস ছিল নির্ধারিত সময়। প্রতিটি কাজে একটি নির্ধারিত সময় থাকে। আর তিন পর্ব লিখলে একটানা একটি বিষয়ে ছয় মাস লেখা হয়ে যাবে। আর ছয় মাস অনেক সময়। প্রবাসে আবাসকে আমি অথবা আমরা কীভাবে দেখি তা তুলে ধরার চেষ্টা ছিল। প্রবাসকে প্রবাসীরা আবাস হিসেবে কেন নিচ্ছেন তা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন লেখায়। সেই সঙ্গে প্রবাসে আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কেন এসেছিলেন এবং কেনই বা প্রবাসেই আবাস গড়ে তুললেন সেদিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপের প্রয়াস পেয়েছিলাম।
পর্বগুলো লেখা হয়েছে সীমিত পরিসরে। তাই এগুলো ছিল সারাংশ মাত্র। বিশদভাবে বই আকারে হয়তো আসবে। যারা বাইরে পড়াশোনা করতে চান তাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপদেশ সহকারে একটি বই হতে পারে। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দেখেছি এবং তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি, সমস্ত জীবন একজন মানুষ প্রবাসী থাককে চান না, তা নিশ্চিত।
আমার পেশা প্রতিদিন মানুষের দুঃখ শোনা ও মানুষের সঙ্গে কথা বলা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি প্রবাস জীবনকে প্রবাসীরা চিরস্থায়ী করতে চান না​। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসতে চান। বাংলাদেশের মেধাশীল ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন আর ফিরে আসছেন না। এ দেশ কারা পরিচালনা করবে! মেধাহীনরাই দেশের ভবিষ্যৎ নেতা ও কর্মকর্তা হবেন এবং হয়ে যাচ্ছেন!
যারা বিদেশে এসেছেন তাদের দেশে ফিরে আসার অনুকূল পরিস্থিতি আর নেই। জন্মভূমির যে করুন অবস্থা, তা আমাকে ও আমার মতো আরও অনেক প্রবাসীদের ফিরে আসতে কোনো উৎসাহ দেয় না। রাস্তাঘাটের উন্নতির কথা কারও চিন্তা নেই, গণতন্ত্রকে গতিশীল করতে কারও আগ্রহ নেই। জবাবদিহিমূলক সরকার না থাকলে দেশে যেমন উন্নয়ন সম্ভব হয় না, তেমনি লুটপাট, খুন, গুম বেড়ে যায়। সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে যে কেউ খুন–গুমে লিপ্ত হবে তাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্র গতিশীল না হলে দেশে নৈরাজ্য বেড়ে যাবে।
আমাদের দেশে মানুষের জীবনের মূল্য নেই, তা ভাবতেই অবাক লাগে। আমার দেশে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই রাস্তায় মারা যায়। কারণ রাস্তায় যানজট, গাড়ি মোটেই নড়ে না। কোনোমতে হাসপাতাল পর্যন্ত যদি বা নেওয়া সম্ভব হয়, সেখানে কোনো বেড খালি থাকে না। আমাদের দেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আমার কাছে নিয়মিত মেইল আসে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লিখতে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব এবং কোথায় শেষ করব বুঝে উঠতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে যাবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
বিরোধী দলের হরতাল, জ্বালাও পোড়াও ছাড়া কীভাবে দলের ঘোষণাপত্র যুগোপযোগী করে তোলা যাবে সে দিকে কারও লক্ষ্য নেই। তাই জনগণের কাছে যেমন সরকার তেমনি বিরোধী দল। এক দলের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে অন্য দলের হাতে ক্ষমতা দিলে, সাধারণ জনগণের কি লাভ! সংসদে শক্ত বিরোধী দল না থাকলে জবাবদিহিতা কার কাছে করা হবে!
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। ইংল্যান্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্কুলে শুধু শেখানো হয় কিন্তু পরীক্ষার চাপ দেওয়া হয় না। এখানে স্কুলগুলোতে সবকিছু শিক্ষা দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট বয়সে তাদের যৌন বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। এই শিক্ষা নিয়ে যদিও অনেকের আপত্তি রয়েছে এবং যদি কোনো বাবা–মা না চান তবে তার সন্তানদের যৌন শিক্ষা যে ক্লাসে দেওয়া হয় তা থেকে বিরত রাখতে পারেন। আমাদের দেশে এখনো পলিথিনের ব্যাগের ভেতর জীবন্ত নবজাত শিশু পাওয়া যায়। অথচ ভালো শিক্ষা তথা সঠিকভাবে যৌন শিক্ষা এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি প্রতিহত করতে সক্ষম হতো। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নৈতিকতাসহ কীভাবে রান্না করতে হয় তাও শেখানো হয়। কিন্তু ক্লাস ওয়ান থেকে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয় না।
কয়েক দিন আগে দেখলাম একজন পুলিশ কর্মকর্তা আসামিদের লাঠি দিয়ে জোরে জোরে প্রহার করছেন। তারপর ওই ফুটেজগুলো ফেসবুকে আপলোড করছেন! আমি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কেন এই প্রহার কেন রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে! শুধুই প্রতিকূল পরিস্থিতি! তাই বিচ্ছেদেই জন্মভূমিকে অধিক ভালোবাসি। কারণ জন্মভূমির করুন চিত্র প্রতিদিন অবলোকন করা, জন্মভূমির করুন অবস্থায় প্রতিদিন ভোগার চেয়ে সম্ভবত বিচ্ছেদই শ্রেয়। জন্মভূমিতে বসবাস না করলেও, জন্মভূমির করুন দৃশ্য আমাকে আহত করে। আমি প্রত্যাশা করব আমরা সবাই বাংলাদেশকে কীভাবে বসবাসের উপযোগী করে তোলা যায় সে দিকে মনোনিবেশ করব। শুধু সরকারের কিংবা শাসনযন্ত্রের একারই দায়িত্ব নয়। আমরা প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে কিছু না কিছুতো আমরা আমাদের দেশের জন্য করতে পারব। বিজয়ের মাসে আমাদের হোক এই ব্রত। (চলবে)

লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত। ফেসবুক: শহীদ শতাব্দী

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/1377086