জাপানে এপিএফএসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ

অভিবাসীদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার মানবিক দায়িত্ব নিয়ে জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে টোকিওর ইতাবাশি ওয়ার্ডে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি (এপিএফএস)। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশি লিয়াকত হোসেনসহ কয়েকজন প্রবাসী মিলে নানান প্রতিকূলতার চড়াই উতরে এই সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্থানীয় শ্রম আইন বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও বাংলাদেশের পরম বন্ধু মানবতাবাদী জাপানি ইয়োশিনারি কাৎসুও। পরবর্তীতে প্রবাসী বাংলাদেশি মাসুদ করিম এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন।

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ

এপিএফএস জাপানের বৃহৎ মানবাধিকার সংগঠনের একটি।
বলা হয়ে থাকে পাবলিক বাথ (Sento) থেকে নাকি এই সংগঠনের জন্ম। তথ্যটি কৌতুক করে জানালেন ইয়োশিনারি। তিনি বর্তমানে সংগঠনের উপদেষ্টা।
টোকিওর ইতাবাশি ওয়ার্ডটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মিলিটারি সাপ্লাইের জন্য বিখ্যাত ছিল। ছোট ছোট অসংখ্য কারখানা ও স্টক হাউস ছিল। জাপানের অর্থনৈতিক উন্নতির পর সেখানে পুরোনো জীর্ণ ঘর ভেঙে নতুন নতুন আবাসন হলেও কিছু কিছু বাড়ি ঘর ও কারখানা থেকে যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশিরা ভাগ্যান্বেষণে জাপানে আসা শুরু করেন। তুলনামূলক কম ঘরভাড়া ও সাশ্রয়ী জীবন ব্যয়ের জন্য এই এলাকায় কিছু বাংলাদেশি আবাস গড়েন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে জাপানি কয়েকজনের সখ্যতা হয় পাবলিক বাথে একসঙ্গে গোসলের সময়। অতিথিবৎসল বাংলাদেশিরা তাদের মাঝে-মধ্যে ঘরে এনে বাংলা কারি খাইয়ে সম্পর্কটাকে মজবুত করেন।

স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছেন ইয়োশিনারি কাৎসুও
স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছেন ইয়োশিনারি কাৎসুও


ওই সময় সাইতামা জেলার শিকি নামক শহরে একজন প্রবাসী বাংলাদেশির পরিত্যক্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রবাসী বাংলাদেশিদের খুবই আহত করে। তারা ভাবেন কিছু একটা করা উচিত। এই ভাবনা থেকে জাপানিদের সঙ্গে নিয়ে কিছু করতে সংগঠন করার চিন্তাটা তাদের মাথায় আসে। তাদের এক জাপানি বন্ধুর বন্ধু ইয়োশিনারি তখন অনেক প্রবাসীকে সমস্যা সমাধানের নানা পরামর্শ দিতেন৷ তাই তাকেই নতুন ওই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। ১৯৮৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ইতাবাশি শহরের ওইয়ামা এলাকার সানবুন হলে (বর্তমানে গ্রিন হল) প্রবাসীদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সহায়তা দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু করে। সংগঠনের নামকরণ হয় জাপান-বাংলাদেশ সোসাইটি। কমিটির ২২ জনের মধ্যে ২১ জনই ছিলেন বাংলাদেশি।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

প্রতিষ্ঠার পরপরই বাংলাদেশি অভিবাসীরা সংগঠনের কার্যালয়ে এসে ইয়োশিনারির সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং তাদের প্রতি সদয় ছিলেন। তার মূল্যবান পরামর্শে বেশিরভাগ প্রবাসীর সমস্যার সমাথান হয়। এ খবর চাউর হলে পাকিস্তান, ফিলিপাইন, চীন ও ইরানের অভিবাসীরাও বিনা মূল্যে পরামর্শের জন্য তার কাছে আসতে থাকে। পরে সবার মতামত নিয়ে সংগঠনের নাম এশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি বা এপিএফএস নামকরণ করা হয়।
১৯৯০ সালে জাপান সরকার অভিবাসী ও রিফিউজি আইনের সংস্কার করলে এপিএফএসের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই অভিবাসীরা পরামর্শ নিতে সংগঠনের কার্যালয়ে আসতে থাকেন। মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারে জাপান সরকারও সংগঠনটিকে মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রতিবাদ, ইমিগ্রেশন আইন সংস্কারের দাবিতে পথসভা ও বার্গেনিং এজেন্ট হিসেবে সংগঠনের স্বীকৃতি মেলে।

বক্তব্য দিচ্ছেন এলনাজ জালালি
বক্তব্য দিচ্ছেন এলনাজ জালালি

অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি জাপানে অভিবাসীদের মর্যাদার সঙ্গে থাকবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারি সুবিধাগুলোর যথাযথ ব্যবহার, বেতন ও সুযোগ-সুবিধা আদায়, অসুস্থতা ও দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ আদায়, চিকিৎসা সুবিধা আদায়, বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা, বৈশ্বিক অভিবাসন, বহুজাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ভিসা সুবিধা বঞ্চিত অভিবাসীরা যারা জাপানের উন্নয়নে শ্রম দিয়েছে তাদের ভিসার ব্যবস্থার জন্য কাজ করে থাকে।
সংগঠনের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় গত ১০ ডিসেম্বর। অনুষ্ঠানে অভিবাসীদের ঢল নেমেছিল। তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক শ। এসেছিলেন মানবতাবাদী বেশ কয়েকজন জাপানি। বিভিন্ন পেশার প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ছিলেন।
অভিবাসীদের অনেকে জাপানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু একসময় তারা ভিসাহীন পলাতক জীবন কাটিয়েছেন। এপিএফএসের মাধ্যমেই তারা জাপানে স্থায়ী হয়েছেন কিংবা জাপানি পাসপোর্ট পেয়েছেন। অনেকের দেশে যাওয়ার পর আসার সুযোগ ছিল না। কেউ কেউ জেলে ছিলেন। অনেকের হাসপাতালে চিকিৎসার সামর্থ্য ছিল না। তাদের দুর্দিনে এই সংগঠন পাশে ছিল।

এলনাজ জালালির পরিবার ও রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে লেখক (সর্বডানে)
এলনাজ জালালির পরিবার ও রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে লেখক (সর্বডানে)


অনেক অভিবাসীর ছেলেমেয়েরা তখন জাপানে পড়াশোনা করছিল। এ কারণে তাদের জাপানে থাকতে হবে। এই সংগঠনের মাধ্যমে তাদের জন্য বিশেষ ভিসার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে তারা বেশির ভাগ স্থায়ী ভিসা পান। অনুষ্ঠানে তাদের কয়েকজন কৃতজ্ঞতা জানান। কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে অনেকে কেঁদে ফেলেন। এমন একজন ইরানি এলনাজ জালালি। তার যখন চার বছর বয়স, ভিসাহীন বাবা-মাসহ তাকে জাপান সরকার দেশে পাঠিয়ে দেবে। পুলিশ যেদিন এলনাজের পরিবারকে দেশে পাঠিয়ে দেবে, সেদিন ইয়োশিনারি কোলে নিয়েছেন এলনাজকে। পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করছে। ইয়োশিনারি পুলিশকে বলেন, না ওকে দেব না, ওকে ভিসা দাও নইলে আমাকে জেলে নাও। ৩৩ বছরের এলনাজ আজ জাপানের স্থায়ী বাসিন্দা। বাবা-মা, ভাইবোন সবাই জাপানে। কাঁদতে কাঁদতে এলনাজ অনুষ্ঠানে জানালেন এসব।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি হয়েছে ওইয়ামার বিশাল পদ্মা রেস্টুরেন্টে৷ সেই রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশি হাসানও এই সংস্থার সহযোগিতায় আজ প্রতিষ্ঠিত। খাওয়া দাওয়া আর আলাপচারিতা, শুভেচ্ছা বক্তৃতা, সব শেষে উত্তরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।
এশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটিকে অভিনন্দন, অভিবাসী কল্যাণে সংগঠনটি আরও সমৃদ্ধ হোক।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য