লেবাননে বিজয় দিবস পালিত

বক্তব্য দিচ্ছেন আব্দুল মোতালেব সরকার
বক্তব্য দিচ্ছেন আব্দুল মোতালেব সরকার

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ১৬ ডিসেম্বরের সকালটা ছিল বেশ আলো ঝলমলে। সকালে সোনাঝরা রোদ উঠেছে বৈরুতের আকাশে। দেশটিতে শীতকাল শুরু হয়েছে এক মাস আগে থেকে। লেবাননের একটি শহরে শুরু হয়েছে তুষারপাত। এ জন্য রাজধানী বৈরুতে বেশ ঠান্ডা। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ অন্যরকম বাংলাদেশিদের কাছে। ১৬ ডিসেম্বর মানেই প্রতিটি বাংলাদেশিদের কাছে এক আনন্দের দিন। সকাল থেকেই লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের। কারণ একটু পর উত্তোলন করা হবে জাতীয় পতাকা। বিজয় দিবসের প্রথম কার্যক্রম এটি। 

বাণী পাঠ করছেন তানিয়া সুলতানা
বাণী পাঠ করছেন তানিয়া সুলতানা

সকাল হতেই দুর-দুরান্ত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা হাজির হয়েছেন দূতাবাসের ছাদে। এখানেই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হবে বিজয় দিবসের কার্যক্রম। শনিবার লেবাননে অর্ধবেলা ছুটি থাকার কারণে অনেকে সকালে কাজ ফেলে আসতে পারেন না। তারপরও প্রায় ৫০ জন প্রবাসী বাংলাদেশি ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে সকাল নয়টায় লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার জাতীয় সংগীতের সুরে সুরে পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন শেষ করে তিনি উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং বিকেলের আলোচনা অনুষ্ঠান যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান।
প্রবাসে বাংলাদেশকে কত ভালোবাসেন প্রবাসীরা তার প্রমাণ পাওয়া গেল একজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে। বাবুল মুনশি লেবাননে আছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। প্রতিটি জাতীয় দিবসে দূতাবাসের অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেন। একটি বিষয় অবাক লাগল বাবুল মুনশির সঙ্গে কথা বলে। ছুটির দিন বাদে যদি কোনো জাতীয় দিবস থাকে তবুও তিনি অনুষ্ঠানে আসেন। কর্মদিবসে অনুষ্ঠানে আসার জন্য তার ১৫-২০ ডলার বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। তবুও তিনি দূতাবাসের অনুষ্ঠানে বিশেষ করে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে আসেন। তিনি জানান এই জাতীয় এই দিবসগুলোতে না আসতে পারলে তার ভালো লাগে না। অস্থির লাগে। এ জন্য এই অনুষ্ঠানগুলোতে আসা। মনের শান্তির জন্য। ‘যত দিন বিদেশে থাকব জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান আমি মিস করব না’। গর্ব করে জানালেন প্রবাসী বাবুল মুনশি।

উপস্থিতি
উপস্থিতি

বিকেলে শুরু হওয়ার কথা ছিল জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের। ঠিক তার আগেই উপস্থিত হয়েছেন লেবাননের আরেক শহর ত্রিপোলি থেকে এসেছেন দুলা মিয়াসহ পাঁচজন। বৈরুত থেকে ৮০ কিলোমিটার দুরে ত্রিপোলি। জাতীয় দিবসগুলোতে এভাবেই দুর-দুরান্ত থেকে দূতাবাসে হাজির হন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রায় ৬০ কিলোমিটার দুর থেকে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এসেছেন আরও দুজন প্রবাসী আবদুর রহমান ও ইলিয়াস। বিজয় দিবস বলে কথা। প্রাণের টানেই এসেছেন জানান তারা।
আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিজয় দিবসের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে দোয়া পাঠ ও বাণী পাঠ করা হয়। কোরআন তিলাওয়াত করেন দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল হোসেন। এরপর স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭১ সালের সকল শহীদের জন্য দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করেন দূতালয় প্রধান সায়েম আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন দূতাবাস কর্মকর্তা আবুল হোসেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন কনস্যুলার কর্মকর্তা তানিয়া সুলতানা ও প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন কনস্যুলার সহকারী আরমান প্রধান।
বাণী পাঠ শেষে শুরু হয় আলোচনা সভা। লেবাননের বিভিন্ন কমিউনিটির সদস্যরা প্রথমে বক্তব্য প্রদান করেন। কমিউনিটির সদস্যরা দূতাবাসকে ধন্যবাদ ও দূতাবাসের বিভিন্ন কাজের প্রশংসা করেন। কমিউনিটির সদস্য তপন ভৌমিক জানান, বর্তমান দূতাবাস যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাতে আমরা কমিউনিটির সদস্য হিসেবে অনেক খুশি। কারণ আগে লেবাননবাসীরা আমাদের যেভাবে চিনত এখন তারা আমাদের অন্যভাবে দেখে। বর্তমান রাষ্ট্রদূত অনেক কাজ করছেন। এই জন্য আমরা কমিউনিটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিটি কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই।

উপস্থিতি
উপস্থিতি

বর্তমানে লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাস দালাল মুক্ত ও অসহায় প্রবাসীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ও পুনর্বাসন সোসাইটি লেবানন শাখা যুব কমান্ড রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারকে তার প্রবাসী বান্ধব কাজের জন্য তাকে ক্রেস্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তারা। অবৈধ প্রবাসীদের দেশে যাওয়ার জন্য যে কাজ করে যাচ্ছে দূতাবাস তা যেন অব্যাহত থাকে সে জন্য দূতাবাসকে সকল প্রকার সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন আলোচনা অনুষ্ঠানে আগত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
সবশেষে রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার তার বক্তব্যে বলেন, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল লাল-সবুজের পতাকাধারী একটি দেশ যার নাম বাংলাদেশ। তিনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অসীম ত্যাগ ও চৌকস নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। তিনি তাঁর পরিবারের সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আরও স্মরণ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গকে যাঁদের চরম আত্নত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।
তিনি আরও বলেন, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—বঙ্গবন্ধুর গৃহীত এ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নতিতে অবদান রাখার লক্ষ্যে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাস এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। দূতাবাসের এ প্রচেষ্টা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি দেশের উন্নয়নে সকলকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে আহ্বান জানান। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। লেবাননে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় এমন সকল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, গত দুই বছরের মধ্যে আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭০০ জন কাগজপত্রহীন অবৈধ বাংলাদেশিকে বিনা জরিমানায় দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। আরও কয়েকজনকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া প্রক্রিয়াধীন আছে। লেবানন সরকারের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করে আমরা এটা করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি লেবাননের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার। গৃহকর্মী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছাড়াও অন্য পেশার জনশক্তি যেন লেবাননে আসে, এ জন্য কাজ করে যাচ্ছে দূতাবাস।
আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দূতালয় প্রধান সায়েম আহমেদ।
অনুষ্ঠান শেষে সকলকে আপ্যায়ন করা হয়।

সংবাদ প্রেরক: জুবায়ের কবির, বৈরুত, লেবানন। ইমেইল: <[email protected]>

ছবি: বাবু সাহা ও মহম্মদ সাগর।