মানুষই মানুষের ঈশ্বর

লেখিকা
লেখিকা

হিমাঙ্কের নিচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ডিসেম্বরের মাঝামাঝির এক সন্ধ্যা; অনুভূত তাপমাত্রা (শরীরে যেমন ফিল করা যায়) আরও তীব্র, হিমাঙ্কের নিচে ৪০! ব্যবহারোপযোগী ব্যাখ্যায় এখানকার তাপমাত্রা নির্দেশের দুটো ধরন। একটি প্রকৃত তাপমাত্রা, আরেকটি অনুভূত তাপমাত্রা। এটি নির্ভর করে উত্তর-পশ্চিমের মৌসুমি বায়ুর গতিবেগ-উচ্চতা-চাপ ও বাতাসের আর্দ্রতার ওপর। এই চতুর্মুখী কোরিলেশনের কারণে পুরো শীতকালই শীতের শেল তীব্রতা হানে শরীরে কানাডার মতো শীতপ্রধান দেশগুলোতে। বাংলাদেশে কখনো সখনো আমরা শৈত্য প্রবাহ নামে যার দেখা পাই খানিকটা তার মতোই। তবে মাত্রাটা অতিশয় তীক্ষ্ণ, অতিশয় বরফশীতল! মনে হয় ধারালো ছুড়ি দিয়ে ফ্রিজে রাখা পুডিং পরম যত্নে কেটে কেটে টুকরো করা হচ্ছে। সেই টুকরোগুলোকে সজ্জিত করতে এপাশ-ওপাশ করে আবার হিম শীতল বরফের ম্যাপেল সিরাপও ঢালা হচ্ছে প্রলেপ হিসেবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা হাঁটার সময়ে যা কিনা চারিদিক থেকে আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। এমতাবস্থায় মাত্র দশ মিনিট শরীরের কোনো অঙ্গ উন্মুক্ত থাকলেই মনে হবে তারা আর আপনার পরিচিত কেউ নয়। একটু জোরে টোকা দিলেই ছুটে যেতে পারে আপনার কানের ঊর্ধ্বাঙ্গ কিংবা নাকের ডগাটা! এই তুষার বর্ষণে মানুষের হাত-পায়ের আঙুল ফেটে যায় ঠিক আমাদের দেশের কৃষাণদের মতো। দিনভর কাদায় থাকার ফলে যেমন হাত-পায়ের আঙুল কাদায় খেয়ে নেয় তাদের, তেমনি অনাবৃত হাত-পায়ের আঙুলের ডগাও ফেটে যায় তুষারের হিম-শীতল আক্রমণে, ডাক্তারি ভাষায় যাকে ‘ফ্রস্ট বাইট’ বলা হয়। বাংলায় মানে করলে দাঁড়ায় বরফের কামড়, কামড়ই বটে!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কাজ থেকে বাড়ি ফিরছি, সন্ধ্যা না বলে বলা ভালো রাত; প্রায় নয়টা। আমাদের বাস সবে সাবওয়ে স্টেশন থেকে তিন স্টপ পেরিয়েছে। পথিমধ্যে দেখলাম হুইলচেয়ারে উপবিষ্ট একজন বৃদ্ধা অপেক্ষা করছেন বাসস্টপে। দিনভর যে কেবল শীতের মহড়াই চলছিল তা নয়, মেঘলা-মেদুর তীব্র তুষারপাতও ছিল সেদিন। তুষারপাতের সময় প্রধান প্রধান সড়কগুলো পরিষ্কারের কাজে ২৪ ঘণ্টাই লোক নিয়োজিত থাকে। সেদিনের অস্বাভাবিক মাত্রার তুষারপাতের ফলে রাস্তা পরিষ্কারের কাজও যথাযথভাবে করা সম্ভব ছিল না। তাই বাস চলাচলও ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা স্তিমিত। খানিকটা ঢিমেতালেই চলছিল সেদিনের জীবনযাত্রা। পথযাত্রীদের সবাইকেই সেদিন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল বাস পেতে। সেই বৃদ্ধাও অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। এমন বৈরী আবহাওয়ায়ও থেমে থাকে না জীবন এখানে! চলে তার আপন গতিতে, যথানিয়মে।
বাসটি পরের স্টপেজে দাঁড়াল, বৃদ্ধাও আশার আলো দেখলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাসের বর্ধিত সিঁড়িটি (হুইল চেয়ার/বেবি স্ট্রলার সহজে ওঠা নামার জন্য বাসের দরজাসংলগ্ন পাল্লার মতো একটি সমতল সিঁড়ি যা লুকোনোই থাকে, প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়) কোনোভাবেই প্রসারিত হয়ে ভদ্রমহিলাকে উঠতে সাহায্য করল না। ড্রাইভার অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হয়ে ভদ্রমহিলার কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং তৎক্ষণাৎই পরের গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করে জানালেন যাতে তিনি সেই ভদ্রমহিলাকে তুলে নেন। কারণ অতিরিক্ত ঠান্ডায় বয়স্ক ভদ্রমহিলার পক্ষে আরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা অসম্ভব এবং তিনি অসুস্থও হয়ে যেতে পারেন। এ সংক্রান্ত ফোনালাপ চলছিল যাত্রী ওঠানামা শেষ করে, স্টপেজে দাঁড়িয়েই। যেহেতু এ দেশে চলন্ত গাড়িতে চালকের কথা বলা নিষেধ এবং চালকের সে আইন অমান্য করার সাহসও নেই, এ কারণে তাকে স্টার্ট বন্ধ করেই কথা বলতে হয়েছিল। অথচ এই জাতির কাছে সময়ের মূল্য আমাদের তুলনায় অনেক অনেকগুণ বেশি এবং আইনের প্রতিও অত্যধিক শ্রদ্ধাশীল তারা। তথাপিও এ কাজটি ড্রাইভার সানন্দেই করছিলেন এবং এই অতিরিক্ত কালক্ষেপণে ভেতরে অবস্থানরত যাত্রীরাও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হলেন না, বরং সকলেই নীরব দর্শক হয়ে দেখলেন ড্রাইভারের কর্মকাণ্ড।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এই দৃশ্যটি দেখতে দেখতে আমার মন ভোমড়াও উড়ে গিয়েছিল প্রিয় শহর ঢাকায়। ঠিক একইরকম পরিস্থিতিতে আমরা হলে কি করতাম? কি করতেন চালক-হেলপার আর যাত্রীসাধারণ? সে কথাই বারবার মনে পড়ছিল; মনে পড়ছিল অনেক না বলা বেদনার বাণী। এমন পরিস্থিতিতে আমরা বাসচালকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে এক চুলও দ্বিধা করতাম না। কারণ, আমাদের সময়ের মূল্য অনেক! আর এই ঝড়-ঝঞ্ঝার রাতে বুড়ি কেন বাড়ির বাইরে এল তার নাড়ি-নক্ষত্র উল্টে পাল্টে দেখাই তখন আমাদের পরম কর্তব্য হয়ে দাঁড়াত। যদিও আমাদের বাস চালকেরা এমন আচরণ কস্মিনকালেও করতেন বলে সন্দেহ হয়। অথচ, এই চালক কিন্তু বিশাল কোনো বিদ্বান ব্যক্তি নন, হয়তো শুধু হাই স্কুল পাস দিয়েছেন কিংবা দেননি। উপরন্তু, তাকে এই কাজটি করতে কেউই বাধ্য করেনি। বস্তুত এটাই সত্য, একইরকম ঘটনায় সকল ড্রাইভারদের কাছে এটাই প্রত্যাশিত, এটাই স্বাভাবিক এখানে। সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কী সেই জাদু যা আমাদের জানা নেই, অথচ এরা জানে?

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমরা জানি, সকলেরই হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, বোঝার-উপলব্ধির ক্ষমতাও সমান নয় সকলের, কিন্তু আমরা মানুষ তো! মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষার জন্য অনেক মোটা মোটা বই পড়তে হয় না। দরকার নেই বড় বড় ডিগ্রির। দরকার শুধু একটি বোধের—আমি কেমন আচরণ আশা করি অন্যের কাছ থেকে, অন্যের সঙ্গেও সেই আচরণটি করতে পারি যেন। কেবল অন্যের জুতোজোড়া নিজের পায়ে পরিয়ে দেখা, অন্যের আয়নায় নিজের মুখটি দেখতে শেখা! মানুষের পেশা, বয়স, সামাজিক মর্যাদা, ধর্ম, লিঙ্গ এবং রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রত্যেকেই মানুষ। আর মানুষ হিসেবেই সে মানুষের কাছে সমান মর্যাদার দাবিদার। এই শিক্ষা অর্জনে আর কত পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের?
বলাবাহুল্য, আমাদের সরকারও নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে নয়টি সংরক্ষিত আসনের আইন পাস করেছেন বেশ কিছু কাল আগেই। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হলো সেই আইন সরকারি-বেসরকারি সকল পরিবহনে যে যার নিজের খেয়াল-খুশি মতোই ব্যবহার-সদ্ব্যবহার-অপব্যবহার করছেন। যারা প্রতিদিন ঢাকা শহরের বাসে চড়েন সকলেই তা জানেন। আমাদের খুব কম পাবলিক পরিবহনে নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীরা নিরাপদ। এই সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য নারীদের সংগ্রামে নামতে হয়, যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় প্রতিদিন। আর সেখানে প্রতিবন্ধী?
রাজধানী শহর ঢাকাতে প্রতিদিন নারী-শিশু-বয়োবৃদ্ধদের বাসে চড়তে গিয়ে কী অস্বাভাবিক অবর্ণনীয় দুর্ব্যবহার সইতে হয়, কতটা নোংরা ভাষায় গালাগাল খেতে হয় রাস্তায় নামার অপরাধে তা রীতিমতো অভাবনীয়! প্রতিবন্ধীদের আমাদের সমাজ মানুষ বলেই ভাবতে রাজি নয়; হোক সে শিশু-নারী-পুরুষ, কিংবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা; তাদের অবস্থা ও অবস্থান ভয়াবহভাবে শোচনীয়, অমানবিক, অসম্মান আর নিষ্ঠুরতায় ঘেরা। আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধীদের সম্মান করার মতো সৌজন্য-সদাচার শেখেনি!
এখানেও বাসের আসন ব্যবস্থাপনায় প্রথম সারির ছয়টি আসনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক সংরক্ষিত আসন বলা হয়ে থাকে; যা নারী-শিশু-গর্ভবতী-বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্যই সংরক্ষিত। সাধারণত সেসব আসনে নিরুপায় না হলে কেউই বসেন না এবং চাহিবামাত্র এর গ্রাহককে উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য থাকেন। এটি আইন এবং এই আইন অমান্য করার মতো কোনো ঘটনা অদ্যাবধি ঘটেনি। এই আইন ভঙ্গ করার অধিকার না আছে যাত্রী সাধারণের, না আছে চালকের। সুতরাং আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়, আইনের বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণও রাষ্ট্রেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ‘কাজীর গরু’ কেবল কেতাবেই নয়, গোয়ালেও থাকা চাই!
সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে আইন মেনে চলার দায়িত্ব কার? কেনই বা মানুষ আইন ভঙ্গ করছে? জানি, এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চাওয়াও অবান্তর! আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা তথা আইন মেনে চলার দায়বদ্ধতা নেই। অপরপক্ষে, আইন বাস্তবায়ন যাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে, তারাও দায়িত্ব অবহেলায় শতভাগ সফল। সুতরাং, আমাদের রক্ষকেরাই ভক্ষক! আর সে যদি হয় সরকারি রক্ষাকর্তা, তবে তো আর রক্ষে নেই!
উল্লেখ্য, বর্ণিত গল্পের পরিবহন ব্যবস্থাটি সরকারি, যেখানে জনগণ সেবাগ্রহীতা আর সরকার সত্যিকারের সেবাদাতা! শুধু বাস নয়, শহরের রাস্তা-ঘাটে, টয়লেটে, শপিং মলে, রেস্তোরাঁয় সব জায়গাতেই বর্ধিত সিঁড়ি কিংবা বিকল্প প্রবেশ ব্যবস্থা আছে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ও শিশুদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের জন্য। যাতে তাদের চলাচল অবাধ-সহজ হয় অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্য ছাড়াই। কারণ, এই সমাজ উন্মুক্ত-উদার, মানুষের অপারগতা-বৈচিত্র্যতা গ্রহণের জন্য সদা প্রস্তুত। প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানো কারও অপরাধ নয় বরং সমাজেরই দায়, যদি সে সমাজ সকলের চাহিদা উপযোগী জোগান না দিতে পারে। যদি রাষ্ট্র সেরকম সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে না পারে। যে সমাজ প্রতিবন্ধীদের ধিক্কার দেয়, দেয় নিগ্রহ, উপেক্ষা আর অবহেলা; সেই সমাজ নিজেই আক্রান্ত প্রতিবন্ধিতায়, তার চিকিৎসা দরকার। দরকার নিজেরই নিয়ম-নীতির পুনঃসংস্কারের।
প্রতিদিনের এই প্রবাস জীবনেও প্রিয়তমা স্বদেশের ফেলে আসা স্মৃতির ভিড়ে খুঁজে ফিরি স্বস্তি! একটুখানি শান্তি আমার প্রিয়তম স্বজনদের জন্য। কারণ, অজানা এই সংস্কৃতি আমাকে দিয়েছে ভাবনার এক বিশাল জগৎ, দিয়েছে উন্মুক্ত আকাশ। তাই ভাবি, ‘আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ কবে আমাদের দেশ সেই দেশ হবে যেদিন প্রতিবন্ধীরা অবহেলা-অনাদরে খড়কুটোর মতো নয়, মানুষের মর্যাদায় মাথা উঁচু করে বাঁচবে? কবে আমরা বুঝতে শিখব ‘মানুষই মানুষের ঈশ্বর!’
প্রিয়তম স্বদেশ! স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের সন্তানেরাও পাবে মাথার ওপরে দিগন্ত বিস্তৃত নিজস্ব আকাশ! চাইলেই দিতে পারবে অনন্ত উজাড় উড়াল! সেই আশায় প্রহর গুনি আর বলি—‘দেখিস একদিন আমরাও...।’ ভালো থেকো প্রিয় স্বদেশ।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন: টরন্টো, কানাডা।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন