স্বপ্নে খুঁজি তারে

লেখিকা
লেখিকা

আমাকে দেশের অনেকে কিছু কমন প্রশ্ন করেন। যেমন; দেশের থেকে বিদেশে ভালো আছি কিনা! বিদেশের জীবনযাত্রা কেমন। বিদেশে উপার্জন বেশি করার স্কোপ আছে কিনা!

এই সব প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়াটা আমার জন্য একটু দুষ্কর বটে। আমি যা বুঝি তা হলো—জীবন মানেই যুদ্ধ। আগে দেশেও করেছি এখন বিদেশে করি। শুধু যুদ্ধের ধরনটা আলাদা। কৌশল শিখতে একেকজনের একেক রকম সময় লাগে। কিন্তু একবার যদি কেউ কৌশলটা শিখে যায় তাহলে বাঙালিদের হারায় এমন সাধ্য কার আছে?
আর জীবনযাত্রা কেমন তা বোঝার জন্য এখনো সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতন চারপাশ খেয়াল করার চেষ্টা করছি। তারপরেও বাংলাদেশে বড় হয়ে ওঠা এই আমি যখন দেখি এইখানে নারী-পুরুষ সবাই সব কাজে সমানভাবে কর্মব্যস্ত, তখন একটু অবাক হই বই কি। তার চেয়েও বেশি হোঁচট খাই যখন দেখি কিচেনে আমার পাশে আমার স্বামী এসে কাজ ভাগ করে নিচ্ছে। দেশে থাকতে আমি সারা দিন অফিস করে রাতে বাসায় এসে আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। মেয়ের হোমওয়ার্ক রেডি করে দিতাম। বুয়াকে নিয়ে কিচেনের কাজ করতাম। এমনকি পরের দিনের সবার লাঞ্চ বক্সও রেডি করতাম। কিন্তু কখনো ও বলেনি, আমার কষ্ট হচ্ছে। এখন প্রতিদিন বলে, ইস! তোমার তো অনেক কষ্ট হচ্ছে...চলো দেশে ফিরে যাই।
আমি মনে মনে হাসি আর ভাবি, এই যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ ভাগ করে নিতে নিতে গল্প করছ, আমার কষ্টটা উপলব্ধি করছ...এই সুখ থেকে তো নিজেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তখন দুটি লাইন মনে পড়ে যায়—‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, যদি থাকে গুণবান পতি তার সনে।’ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের অধিকাংশ স্বামীরা প্রথম লাইন মনে রাখলেও পরের লাইনটা মনে রাখতে চান না। কেবলমাত্র কাজের লোকদের পর্যাপ্ততা দুটি দেশের স্বামীদের মানসিকতায় বিরাট পার্থক্য টেনে দিয়েছে।
এখানে শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের জন্য ও বৃদ্ধদের রাস্তায় চলাফেরা করার জন্য বিশেষ ডিজাইনের হইল চেয়ার আছে। আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধরাও ফিটফাট হয়ে রাস্তায় চলাফেরা করেন। শপিংমলে ঘুরে ঘুরে নিজেরাই নিজেদের জিনিসপত্র কেনেন। গোটা কানাডাতেই অসংখ্য বাস স্টপেজ এবং সাবওয়ে দিয়ে ঘেরা। বাসগুলোতে অটোমেটেড স্লাইডার আছে। স্টপেজে পৌঁছামাত্র চালক সুইচ অন করে দেন। তখন স্লাইডারটা বের হয়ে আসে আর বাসটা নিচু হয়ে রাস্তার সমান্তরাল হয়ে যায়। যেন হুইলচেয়ার বাসের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। চালককে বাস থামানোর নির্দেশ দেবার জন্য প্রতিটা আসনের সঙ্গে স্টপ সুইচ লাগানো থাকে আর পরবর্তী স্টপেজ কোনটা তা সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে চালক জানিয়ে দেন। এগুলো দেখি আর মনে পড়ে যায় দেশে থাকা আমার বৃদ্ধ বাবার কথা। যিনি রাস্তায় বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বিছানাকেই নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছেন। আর শ্বশুরবাবা যিনি প্যারালাইসিস অবস্থায় সারা দিন বিছানায় শুয়ে শুয়েই পৃথিবী থেকে পরপারে চলে গেছেন।
খুব ইচ্ছা করে তাদের বলি—আমরা ছেলেমেয়েরা তোমাদের সময় দিতে পারি না, তোমাদের ঘরের বাইরে নিয়ে আকাশ দেখাতে পারি না, তোমাদের শপিংমলে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। আমরা কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিতে পারি কিন্তু বাবামাকে ডিজিটাল দেশের বেনিফিটগুলো দিতে পারি না। প্রিয় বাবা–মা, আমাদের এই অক্ষমতা পারলে ক্ষমা করে দিয়ো...!
আমি নিজে খুব একটা ধার্মিক না, কিন্তু অশালীনতাকে চিরকালই খুব ভয় পাই। ঢাকায় থাকতে মেয়েকে নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে যেতে সাহস করতাম না। চারপাশের যুবক–যুবতীর অশালীন অঙ্গভঙ্গি আর নৈতিকতা বিবর্জিত যেসব দৃশ্য চোখে পড়ত তাতে ভাবতাম দেশে এমন পরিস্থিতি তাহলে বিদেশে না জানি কী বেহাল অবস্থা! কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত এই ধরনের কোনো দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি। মেয়েরা শর্ট জামা পরে চলাফেরা করে কিন্তু তাকানোর সময় কারও নাই। সবাই গন্তব্যে যেতে ব্যস্ত। আমার পরিচিত এক দম্পতি কানাডায় নতুন আসার পর এক মেয়ের রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। সেই মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেছে, তোমাদের কি আমার কাছে কোনো রকম সাহায্য দরকার?
মাঝে মধ্যে ভাবি, মেয়েদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখা, অন্যের পেছনে সমালোচনা করা, নিজের ধন সম্পদ বেশি হলে গর্ব করা, অন্যের কাজকে ছোট করে দেখা, এগুলো তো আমাদের ধর্মে সরাসরি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অথচ দিনকে দিন আমরা যেন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। পাশ্চাত্য দেশের ভালো দিকগুলো এড়িয়ে খারাপ যা কিছু আছে তা রপ্ত করতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আমাদের ভালো মনোবৃত্তিগুলোকে কার্বনডাই অক্সাইডের মতন বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে চারপাশ দূষিত করছি। এখনো সময় আছে, আমরা যদি আমাদের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন না আনি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের সোনার বাংলার গল্প বলা একটু কষ্ট হবে বই কি!
পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই দেশের অবকাঠামোগত চিত্র ও মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্য দেখে হৃৎপিণ্ডের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশ আমরা অর্জন করেছি, ষোলো কোটি মানুষের সততা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে সেই দেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা কি আমাদের জন্য কেবল স্বপ্ন হয়েই থাকবে...!

ফারজানা আখতার পান্না: টরন্টো, কানাডা।