সীমান্ত এক্সপ্রেস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশের সুজলা সুফলা ছোট্ট একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম মালিগ্রাম। 

আক্কেলপুর উপজেলার জাফরপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক ক্রোশ পুবে গ্রামটির অবস্থান। ওই এলাকার প্রধান ফসল ধান। তাই আশ্বিনে গ্রামটির চার পাশজুড়ে নয়নাভিরাম রোপা আমন ধানের খেত চোখে পড়ে। আর অগ্রহায়ণে সেই ধানগাছ সুপুষ্ট ধানের শিষের ভারে নুইয়ে পড়ে মাটিতে। খেতের সোনালি ধান কাটা সারা হলে মালিগ্রামে শুরু হয় আনন্দমুখর নবান্নের উৎসব।
অগ্রহায়ণ-পৌষের শীতের সন্ধ্যারাতে তাই মালিগ্রামের বউ ঝিরা বসে যায় নতুন ধানের সুগন্ধি চাল দিয়ে ক্ষীর-ফিরনি-পায়েস রান্না করতে। আর শুরু করে চালের আটার গুঁড়ি দিয়ে হরেক রকমের পিঠা পুলি বানানোর মহা আয়োজন।
শেফালির মাও চিতয় পিঠা, দুধ কুশলী তৈরি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শেফালিরা তিন ভাইবোন। সেই সবার বড়। বাবা–মায়ের একমাত্র সুকন্যা। তাদের অনেক মাঠান জমি আছে।
বাবা রইছ উদ্দিন জমিতে চাষ করেন আর ঘর গৃহস্থালি দেখেন।
শীতকালের সঙ্গে গ্রামীণ জনপদের কী এক মধুর গা গন্ধ সম্পর্ক থাকে।
মালিগ্রাম বাসিন্দাদের মধ্যেও সেই সম্পর্কের কমতি নাই। শীতকালে তাই মাঠ থেকে ধান কেটে বাড়ির আঙিনায় ফেলে মাড়ায় করে গোলায় ওঠানো না পর্যন্ত স্বস্তি পান না তারা।
গ্রামে শীতকালে সন্ধ্যা নেমেই খুব তাড়াতাড়ি রাত আসে। সূর্যাস্ত হতে না হতেই সকল কোলাহল তাই থেমে যায়। নীরব হয়ে পড়ে চারদিকে। কুয়াশার চাদর মুড়ি দেয় গ্রামের গাছগাছালি আর পাকপাখালি। মানুষজন সন্ধ্যা হতে না হতেই রাতের খাবার সেরে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে বিছানায় যায়।
ঠিক এমনিভাবে সন্ধ্যার পর পরেই মালিগ্রামও হয়ে পড়ে নিশ্চুপ।
এমনি নিঝুম রাতের প্রথম প্রহরে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি হু হু করে জাফরপুর স্টেশন অতিক্রম করে চলে যায়।
জাফরপুর স্টেশনটি ছোট সি ক্যাটাগরির স্টেশন বলে সেখানে সীমান্ত এক্সপ্রেস থামে না।
তাই থ্রু পাস হয়ে যাওয়ার সময় ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের গুরুগম্ভীর ভোঁ ভোঁ হর্ন ও রেল পাটাতনে চলন্ত চাকার ঘর্ষণের এক গগনভেদি শব্দ শীতের রাতে মালিগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
পৌঁছায় ওই গ্রামের সাধারণ কৃষক রইছ উদ্দিনের কন্যা শেফালির কর্ণকুহরে।
শেফালি রেলগাড়ির শব্দ শুনেই বুঝতে পারে যে এখন রাত প্রায় এগারোটা মতো বাজে।
কারণ ওই সময়টায় ট্রেনটি ক্রস করে জাফরপুর স্টেশন।
দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের শব্দে সে প্রতিদিন উতলা হয়। বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টটা অনেক ভারী হয়।
মনে হয় ননস্টপ ট্রেনটি তাঁর শরীরের ভেতরে প্রবল বেগে হুংকার দিয়ে চলে যাচ্ছে। তাঁর পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে।
তাঁর যকৃৎ হৃদপিণ্ড দলিত মথিত করে গলনালি ছেদ করে হু হু করে ছুটে যাচ্ছে।
কিন্তু ট্রেনটা জাফরপুর স্টেশনে থামে না বলে তাঁর বুকের চাপা কান্নাকে যাত্রী হিসেবে বগিতেও তুলে নেয় না।
সঙ্গে নেয় না মনের অসহ্য ব্যথাগুলোকেও।
বরং প্রতি রাতে কষ্টকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে যায় এই সীমান্ত এক্সপ্রেস।
শুধুমাত্র যে দিনটি এর চলাচল বন্ধ থাকে সপ্তাহের সেই দিনটি বাদে প্রতিদিন রাতে একইভাবে শেফালির বুক বিদীর্ণ করে চিলাহাটি হতে আসা সীমান্ত এক্সপ্রেসটি দক্ষিণে চলে যায় খুলনা মহানগরীতে।
এই ট্রেনের নামটি সীমান্ত সেটিই শেফালিকে কষ্ট দেয়। সীমান্ত শব্দটির ওপর শেফালির অনেক রাগ। সীমান্তর ওপর শেফালির মান অভিমান দুঃখ। শব্দটি নিয়ে অনেক বোঝাপড়া হয় তাঁর মনের সঙ্গে এবং সারা জীবনই হবে। কারণ এই শব্দটি তাঁর প্রাণের ভালোবাসাকে কেড়ে নিয়ে গেছে। উনিশ শ একাত্তরে।
একাত্তরের এপ্রিল। তখনো মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরিভাবে শুরু হয়নি। সর্বস্তরের মানুষজন এক হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধ করার প্রয়াস চালাচ্ছে মাত্র। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা সান্তাহার স্টেশনে পৌঁছে যায়। স্থানীয় অবাঙালি বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে নির্বিচারে রেল কর্মচারীদের গুলি করতে থাকে। তখন রেলওয়ের লোকোমাস্টার সুলতান আহমেদ পরিবারের সবাইকে নিয়ে মালিগ্রামে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য রাত্রে উপস্থিত হন।
আহমেদ সাহেবের বড় ছেলে টিপু সুলতান। ওই বছরেই নওগাঁ ডিগ্রি কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। টিপু তখন ১৭ বছরের টগবগে এক তরুণ। তারুণ্যে ভরা। সাংস্কৃতিকমনা। ভালো কবিতা আবৃতি করতে পারে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করার ইচ্ছা পোষণ করে মনে মনে।
গ্রামে এসে কিছুই ভালো লাগে না টিপুর। তাই মালিগ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাব জমায়। গল্প বলে। কবিতা শোনায়।
মাতিয়ে রাখে সবাইকে।
সেই সুবাদে পরিচয় হয় শেফালির সঙ্গে। শেফালি তখন ত্রয়োদশী। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।
টিপু ভাইয়ের কবিতা শুনে সে হা হয়ে থাকে। কিছুই বোঝে না। কিন্তু মুগ্ধ হয়।
অনেক ভালো লাগে টিপু ভাইকে। টিপুরও ভালো লাগে গ্রামের সহজ সরল কিশোরী শেফালিকে।
সেই ভালো লাগা থেকে ক্রমে অপ্রকাশিত এক ভালোবাসার জন্ম নেয়। অব্যক্ত প্রথম ভালোবাসা। এক কিশোরীর প্রথম প্রেম।
টিপুর সঙ্গে কথা বলতে শেফালির খুব ভালো লাগত।
বিকেল হলেই তাই ছুটে আসত টিপুর কাছে। গল্প শুনত। শুনত কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।
টিপু কবিতার ভাষায় বলতে থাকত—‘শেফালি, ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার; দূর থেকে দূরে।’
শেফালি না বুঝে শুধুই ভ্রু কুঁচকে টিপুর দিকে তাকিয়ে দেখত। আর ভাবত কী বলে এসব। কিছুই তো বুঝি না।
ওদিকে পাকিস্তানি সেনারা বিহারিদের সঙ্গে করে রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামে আসতে শুরু করল। ইয়ং ছেলেদের ধরতে শুরু করল। ছেলেদের না পেলে মেয়ে মানুষের দিকে নজর দিতে লাগল।
চারদিকে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার দেখে টিপু আর সইতে পারল না।
সিদ্ধান্ত নিল এই হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
বাবা–মাকে বলল সিদ্ধান্তের কথা। ভারতে যাবে সে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে।
যাওয়ার আগের দিনে শেফালির সঙ্গে শেষ কথা হলো।
শেফালিকে বলল, সীমান্ত পার হয়ে ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধ করবে। দেশকে স্বাধীন করবে।
শেফালি জিজ্ঞাসা করল সীমান্ত কোথায়? কবে ফিরে আসবে?
টিপু বলল আরে পাগলি সীমান্ত হচ্ছে হিলি বর্ডারের ওখানটায়। ওপারে যাওয়ার পথ।
কবে ফিরে আসব জানি না। দেশ স্বাধীন করে তবেই ফিরব।
এ কথাটি বলেই প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতা আওড়াতে শুরু করল।
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়। হয়তো মানুষ নয়।’
শেফালিদের পুকুর দেখিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠল—
‘হয়তোবা হাঁস হব-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়। সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধে ভরা জলে ভেসে ভেসে।’
বলল আমি হাঁস হয়ে আসব। তোমাদের পুকুরে ভেসে বেড়াব।
আরও যোগ করল পুকুরেও যদি আমাকে না পাও তাহলে সন্ধ্যার সময় পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকো।
‘রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’
কিশোরী শেফালি কিছুই এর মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে টিপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। গম্ভীর হয়ে গেল।
পরের দিন খুব প্রত্যুষে টিপু সীমান্ত পার হতে মালিগ্রাম ছাড়ল।
কিন্তু বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও তাঁর আর কোনো খবর জানা গেল না।
শেফালি একবার টিপুর বাবার মুখে শুনেছিল যে সীমান্ত পার হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে টিপু ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধের কলাকৌশল শিখে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ৬ নম্বর সেক্টরে লালমনিরহাটের বুড়িমারী-চেংরাবান্দা এলাকায় নভেম্বর মাসে বড় একটা অভিযানে অংশ নেয়। সেই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক পাঞ্জাবি সেনাকে হত্যা করে। সেই যুদ্ধে টিপুও ছিল।
শেফালি দেখছিল টিপুর বাবা কেমন যেন গর্ব বোধ করছিলেন ছেলের বীরত্বের জন্য। কিন্তু তারপর আর খবর পাননি তিনি।
এর মধ্যে ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হয়। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বিজয় অর্জিত হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক ছেলেরা রাইফেল ঘাড়ে করে দেশের শহরে ও গ্রামেগঞ্জে ফিরে এল।
কিন্তু টিপুর আর দেখা পাওয়া গেল না। সে আর ফিরে আসল না মালিগ্রামে।
টিপুর বাবা মা ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছেলের জন্য অপেক্ষা করে মালিগ্রাম থেকে সান্তাহারের রেল কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন এই ভেবে যে ছেলে এর মধ্যে হয়তো সেখানে এসে যাবে।
কিন্তু টিপু আর স্বাধীন বাংলার বুকে ফিরে এল না। সীমান্ত পার হয়ে দেশমাতৃকার টানে যেমনটি ওপারে গিয়েছিল ঠিক তেমনি সীমান্ত পার হয়ে এপার বাংলায় তাঁর স্বাধীন স্বদেশভূমি মা বাবা কিংবা শেফালি কারও কাছেই আর ফিরে আসল না।
অবুঝ কিশোরী শেফালি কিছুই না বুঝে তবুও অপেক্ষায় থাকল।
অলস দুপুরে শেফালিদের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে সে হাঁসের জলকেলি দেখত। আর ভাবত এই হাঁসের দলের মধ্যে কী টিপু আছে? সে যে বলেছিল হাঁস হয়ে আসবে।
হাঁসগুলোর লাল পায়ের দিকে খেয়াল করে চেয়ে থাকত। কোনো হাঁসের পায়ে ঘুঙুর আছে কী না তা দেখার জন্য। ভাবত তাহলে সেটাই বোধ হয় টিপু হতো।
শেফালি প্রতিদিন সূর্যাস্তর আগে পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে থাকত। ধানখেত পেরিয়ে দূর পাথার পর্যন্ত যত দূর চোখ যায়।
নির্লিপ্ত চোখে আকাশে রাঙা মেঘ খুঁজে খুঁজে ফিরত।
দেখতে পেত পাখিদের দল সারি বেঁধে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু কই তাদের মধ্যে তো টিপুকে দেখা যাচ্ছে না।
কিশোরী শেফালির মনের ভালো লাগা আর প্রথম ভালোবাসার পরিসমাপ্তি এভাবেই ঘটল।
এরপর দিন গেলে মাস এল মাস গিয়ে বছর।
তিন বছর পর উনিশ শ চুয়াত্তর সাল। শেফালি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী।
মেয়ে বিবাহ যোগ্য হওয়ায় বাবা রইছ উদ্দিন ছেলে দেখতে লাগলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই পাশের দেলুঞ্জ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত স্কুলশিক্ষকের ছেলের সঙ্গে শেফালির বিয়ে হলো।
ব্যবসার কাজে তাঁর স্বামী একদিন বগুড়া শহরে গেলে কাজ শেষ না হওয়ায় রাত্রে ফিরতে অনেক বিলম্ব হলো।
রাত্রের অবসরে একাকী শেফালি শ্বশুরের বইয়ের আলমারি থেকে বই পড়তে গিয়ে চোখে পড়ল জীবনানন্দ দাসের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি। হাতে নিল সেটি। পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে হঠাৎ আবার আসিব ফিরে কবিতাটি পাঠ করে অবাক হলো।
দুই চোখ তাঁর ঝাপসা হয়ে এল। বুকের ভেতরের সেই পুরোনো অব্যক্ত কষ্ট খিল ধরে রইল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সীমান্ত এক্সপ্রেসের গগনভেদি শব্দ দূর থেকে কানে ভেসে আসতে লাগল। থ্রু পাস হয়ে যাওয়া ট্রেনটির হুংকার।
মনে হলো তাঁর জীবনের সর্পিল সীমান্তরেখা বরাবর এঁকে বেঁকে সীমান্ত এক্সপ্রেসটি ছুটে গেল। তাঁর বুকের ভেতরে জমানো কষ্টের পিণ্ডগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সারা শরীরে নতুন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও দক্ষিণে হু হু করে চলে গেল।

রানা টাইগেরিনা: টরন্টো, কানাডা। ইমেইল: <[email protected]>