আবুধাবিতে ধ্রুপদি যন্ত্রসংগীত

ত্রৈলী দত্ত
ত্রৈলী দত্ত

ফেসবুকের মাধ্যমে আমি একটা অনুরোধ পাই। দাদা একটু সহযোগিতা করতে হবে! বললাম, অবশ্যই করব। কি সহযোগিতা? যন্ত্রসংগীতের একটা অনুষ্ঠান করতে চাই।

এই অনুরোধ করেন দেবারতি মুখার্জি। পেশায় প্রকৌশলী। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাসেবী। পরে বিস্তারিত জানালেন। অনুষ্ঠান হবে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। আবুধাবির ভারতীয় দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে। সন্ধ্যা সাতটায়।
তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমরা সঙ্গে আছি।

তবলায় সওয়াল সরোদে জবাব
তবলায় সওয়াল সরোদে জবাব

ডি-ফিউশনের উদ্যোগ। হ্যাঁ, এক মোহনায় মিলে গেল সেদিন তিন ধারার তাল-লয়-ছন্দ। ত্রৈলী দত্তকে ঘিরে এই আয়োজন। তার অনুশীলন সরোদ। সৌমেন হাজরা তবলায় সংগত করলেন। ঘটম বাজালেন আলুভা রাজেশ। ভৌগোলিক সীমানা, ব্যক্তির আদর্শ এবং মতভেদের ঊর্ধ্বে এসে যন্ত্রসংগীত একজনকে নিয়ে যায় তন্ত্রী (তার) থেকে অন্তরাত্মায়। এই-ই সেদিনের সন্ধ্যার প্রয়াস।
সন্ধ্যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। সঞ্চালনা করেন সুদেষ্ণা সেনগুপ্ত। তিনিই বলেন, চর্চার মধ্য দিয়ে অজ্ঞতা সরানো যায়। অন্ধকার দূরীভূত হয়। আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। উজ্জ্বলতায় চারপাশ নেয়ে ওঠে। এই বিশ্বাস ধারণ করে ধ্রুপদির কুশীলবেরা।

সরোদ বিশারদ লীজাবন্তি গুপ্তা ও অন্যান্য
সরোদ বিশারদ লীজাবন্তি গুপ্তা ও অন্যান্য

প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘোষিত হয়। এ সময় ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের সাংস্কৃতিক বিভাগের কর্মকর্তা দ্বিতীয় সচিব কপিল রাজ। লেখক, সমাজকর্মী সরোদ বিশারদ লীজাবন্তি গুপ্তা। তিনি ওস্তাদ আলী আকবর খানের কন্যা।
আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসানও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এখানে।
সূচনা সংগীতেই জমে ওঠে অডিটোরিয়াম। দুই শিশু কণ্ঠ যুক্ত হয় এ পর্বে। অ্যারিমান কর ও অরিত্রিকা। তারা সঞ্জয় দেবের কাছে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীত শেখে। শুরুটা ছিল বেশ বেগবান।
মোহনীয় তাল লয় আর ছন্দে শুরু হয় যন্ত্রসংগীতের যাত্রা। প্রথম নিবেদন ইমন রাগ। স্বর্গীয় বটে। কল্যাণ ঘাটের হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি রাগ। এই রাগ করা হয় গোধূলিতে।
ভক্তিতে হৃদয় ঢেলে দেওয়ার উপলব্ধি ইমন রাগে। এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন।
এটা বন্দিশ। চমৎকার উপস্থাপনা। শ্রোতারা একাত্ম হয়ে যান।

সংগঠক, সঞ্চালক ও বন্ধু শ্রোতা
সংগঠক, সঞ্চালক ও বন্ধু শ্রোতা

ত্রৈলী দত্তের অভূতপূর্ব উপস্থাপনা। আর হবেই না বা কেন? সরোদ তার ভালোবাসা। সরোদই তার সাধনা। পণ্ডিত কমল মল্লিকের কাছে তার হাতেখড়ি। এখন প্রজ্ঞাবান সেতার পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে যন্ত্রসংগীতের আধুনিক ধারাটির ওপর উচ্চতর শিক্ষা নিচ্ছেন।
দিল্লির হায়দ্রাবাদ ভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্মানে আয়োজিত কনসার্টে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ত্রৈলী রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্রসংগীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পান। তিনি এখন এর ওপর পিএইচডি করছেন। তরুণ সরোদবাদক হিসেবে ধ্রুপদি যন্ত্রসংগীতের জগতে তার নাম এখন জোরের সঙ্গে উচ্চারিত।
তিলক কামোদ রাগের ওপর ভিত্তি করে ঐকতান। মূলভাবে কিছুটা দুষ্টুমি, নিঃশব্দ হাসি আর বর্ণিল মনোভাবের সমন্বয়। রাতের দ্বিতীয়ার্ধ হচ্ছে এ রাগের সর্বোত্তম সময়।
সেদিনের বিশুদ্ধ রজনীতে ত্রৈলী দত্ত, সৌমেন হাজরা ও আলুভা রাজেশ উপস্থাপন করেন এই রাগ। মুখে তখন ত্রৈলীর হাসি।
যেন প্রশ্ন করেন সৌমেন তবলায়, সরোদে উত্তর দেন ত্রৈলী। একইভাবে ঘটমে সরোদে চলে বাহাস। যেন ঘোষণা—আমিই প্রথম। কিংবা আমরা সবাই সেরা।

মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান
মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান

ত্রৈলীর হাসিতে আছে নিবেদন। একটা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতের মুখ কাকলি সেন শর্মা আমাকে অকস্মাৎ ডেকে নেন সামনের একটি জায়গায়। দ্রুতবেগে হাঁটেন আর বলেন, দুই তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। তারা দুজনে করজোড়ে দাঁড়ানো। বললেন, আমরা একটা অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি আসুন! কী আন্তরিকতা! আমি বললাম, অবশ্যই আসব। এমন হাসি তখনো প্রত্যক্ষ করেছি। এদিনও ওদের সুন্দর মুখ জয় করে নেয় সারা শ্রোতা।
এর মধ্যে দ্বিতীয় জন সৌমেন হাজরা। মেধাবী তবলাবাদক। বেনারস ঘরানার পণ্ডিত সন্দ্বীপ দেবের শিষ্য। একবার ভারতীয় জাতীয় যুব উৎসবে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ফ্যাকাল্টির সেরা পুরস্কারটি ছিনিয়ে আনেন।
এদিন দারুণ সারা তোলেন তরুণেরা।
বাংলাদেশের ড. মেহরাজ জাহান বিস্মিত ত্রৈলীর সরোদ পরিবেশনায়। বলেন, অভূতপূর্ব তার উপস্থাপনা। ড. রায়হান জামিল বলেন, চমৎকার একটি আয়োজন।
লাকি হালদার উল্কা বলেন, বোঝা যায়, ত্রৈলী হারিয়ে যান সরোদের তন্ত্রীতে। চলে যান ঈশ্বরের কাছাকাছি।
ওপার বাংলার নাট্যজন সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে তরুণেরা তাদের সেরাটি উপহার দিতে পারে। আজকে তারা সফল, মন্তব্য তার।
দেবারতি করকে শুরুতে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাদের কিছু আছে কি? তারা মূলত বাংলা গানের মানুষ। বলেছিলেন বলা যাবে না। অনুষ্ঠান শেষে বললেন, এত ভালো লাগা প্রকাশ করাও কষ্ট।
দেখলাম পৃথ্বীনাথ মুখার্জি, গৌর ব্যানার্জি তৃপ্তির আলাপ করছেন। মৌসুমি মুখার্জি সামনে। তারই পেছনে সোনা ব্যানার্জি। তিনিও তার ভালো লাগা প্রকাশ করলেন। শাস্ত্রীয় নৃত্যের তনুশ্রী এসেছেন দূর থেকে। ভালো কিছুর টানে। উত্তম কিছু নিয়ে ফিরছেন। বললেন তার বান্ধবী লাকিকে।
প্রশান্তি আর নির্মলতার রাগ হেমান্ত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সৃষ্টি। মুখে মুখে উঠে আসে এর বোল। গভীর একটি তাৎপর্য এনে দেয়। সমসাময়িক গায়কদের কাছে এই রাগ খুব পছন্দের।
ভারতীয় সংস্কৃতি বহুজাত—বহু সম্প্রদায়ের। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপে এর প্রকাশ। জয়ব্রত কণ্ঠ দেন।
জয়ব্রত সেনগুপ্ত তরুণ মেধাবী গায়ক। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর বিখ্যাত স্কুল শ্রুতি নন্দন থেকে তার সংগীতের যাত্রা শুরু। অন্য সংগীতের সঙ্গে এদিন গেয়েছেন রাজস্থান, পাঞ্জাব, আসাম, মহারাষ্ট্র ও বাংলার লোকগাথার অংশ।
ধ্রুপদি যন্ত্র সংগীতের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে ডি-ফিউশনের উদ্দেশ্য।
তন্ত্রী (তার) থেকে হৃদয় ছোঁয়া ব্রত তাদের।

শ্রোতাদের একাংশ
শ্রোতাদের একাংশ

যন্ত্রসংগীতের শিল্পী ও যন্ত্র সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজটি তারা করে যাচ্ছেন।
যন্ত্রসংগীতের চিরন্তন ভাষাকে হৃদয়ের সঙ্গে গেঁথে দেওয়ার এই দায়িত্বটুকু কাউকে না কাউকে তো নিতেই হয়!
সেই সন্ধ্যায় ওই কাজটিই হলো। ভারতীয় ধ্রুপদি যন্ত্রসংগীত, সরোদের সমসাময়িক যন্ত্রসংগীত এবং ভারতীয় লোক সংগীতকে উপস্থাপন করল ডি-ফিউশন।
দেখলাম এই অনুষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক দেবারতি মুখার্জির মুখে হাসি। ভালো লাগল তাদের আনন্দে।
জয়তু ডি-ফিউশন।
জয়তু ধ্রুপদি যন্ত্রসংগীতের আয়োজন!

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।