একটা দিনের শুরু, একটা দিনের শেষ

ওরেগন শহরের একটি দৃশ্য। সংগৃহীত
ওরেগন শহরের একটি দৃশ্য। সংগৃহীত

প্রতিদিন সকাল আটটায় বড় ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ছোটটিকে আরেক বাসায় পৌঁছে দিয়ে সোজা অফিসের পথে রওনা হই। আমার স্ত্রী তারও অনেক আগে সকাল ছয়টার দিকে অফিসে চলে যায়। ছয়টার একটু পরে বেরোলেই আধঘণ্টার রাস্তা যেতে ওর এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যাবে। আমাদের এই পোর্টল্যান্ড শহরে এখন হঠাৎ করে যেন জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। অফিস টাইমে ডাউন টাউনের রাস্তায় তাই ট্র্যাফিক এখন অন্য অনেক মেট্রো শহরের মতো। অবশ্য ঘণ্টা দু-এক ড্রাইভ করে অফিসে যাওয়া আসা করা এ দেশে এমন আহামরি কিছু নয়।

অফিসে পৌঁছেই কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ফোন করে আমাদের খোঁজখবর নেবার তার অভ্যাস প্রতিদিনের। আমাদের বাকি তিনজনের ঘুম ভাঙে ওর ফোনের শব্দে। বড় ছেলের স্কুলব্যাগ, ছোটটার জন্য আলাদা ব্যাগে ওর দিনের কাপড়চোপড়, খাবারদাবার আর আমার দুপুরের খাবার যেদিন থাকে সেদিন বাক্সবন্দী করে সে সব গুছিয়েই রেখে যায়। ছেলেদেরকে রেডি করিয়ে সকালের নাশতা খাইয়ে সকাল আটটার মধ্যেই আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
বিকেলবেলা বাসায় ফিরে চারজন যখন মিলিত হই, তখন প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটায় তখন ছয়টা। এখন শীতের সময়, দিন এমনিতেই ছোট। ফলে আমরা যখন বাসা থেকে বের হই তখন প্রায় অন্ধকার, বাসায় যখন ফিরি তখনো অন্ধকার। সূর্যের আলোর মুখ বছরের এই সময়টাতে এমনিতেই এই পোর্টল্যান্ডে দেখা ভার।
বাসায় ফিরে দুই ছেলেকে গোসল দিয়ে নিজেরা ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার দাবার খেতে খেতে ঘড়ির কাঁটা আরেক ঘণ্টা সরে যায়। রাত আটটার মধ্যে ছেলেদের বেডে নিয়ে যেতে হয়। বেডরুমে একটু আধটু তখন গল্পগুজব, দুই ছেলে মিলে বিছানার ওপর লাফঝাঁপ করে। আমরা তখন টুকটাক কথা বলি, বড় ছেলে তার স্কুলের সারা দিনের গল্প শোনায়। ছোটটা এখনো কথা বলতে শেখেনি, তবে তার নিজস্ব ভাষা দিয়ে আমদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। আমরা একটু সময় হলে গল্পের বই পড়ি, ততক্ষণে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে।
বাচ্চারা ঘুমানোর পর ঘণ্টা দু-এক সময় পাই। তবে নিজের মতো করে সেই সময়টুকুও পার করবার মতো বিলাসিতা করতে পারি বলে মনে হয় না। কম্পিউটার নিয়ে বসি বটে, তবে অফিস থেকে ফেরার পর থেকে এই সময়ের মধ্যে যে কটি ইমেইল আসে, সেগুলোর ফলোআপ করতে করতেই চলে যায় এক ঘণ্টা। তারপর অফিসের অন্য আরও অনেক কাজ, পরের দিনের কাজের পরিকল্পনা করা, সব মিলে রাত এগারোটা। করপোরেটের চাকরি বলে কথা।

সিটি হল, ওরেগন। সংগৃহীত
সিটি হল, ওরেগন। সংগৃহীত

আমরা চারজনের মুখোমুখি দেখা হয় বলতে গেলে দিনে মোটের ওপর দুই ঘণ্টা। খুবই সাদামাটা, খুবই একঘেয়ে, তবু এটাই আমাদের চিরাচরিত একটা দিনের চিত্র। রাত কেটে যায়, পরের দিনের ভোরের অপেক্ষায়। আরেকটি দিন আসে, তবে সেই দিনেরও সেই একই রকম শুরু, একই রকম শেষ। কোনো বিচিত্রতা নেই, তবু এটাই প্রতিদিনের গল্প।
তারপর একদিন সপ্তাহ ঘুরে শুক্রবার দিনটি চলে আসে। সেদিন সকালবেলা থেকেই যেন একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। উইকএন্ডের ছুটির আনন্দে মেতে উঠি সবাই। শনি আর রোববার তাই আমদের ফ্যামিলি ডে, সারা দিন ঘরে অথবা বাইরে, দুই ছেলেকে নিয়েই কাটে আমাদের পুরোটা দিন। একটুখানি ছুটির আমেজ থাকলেও, শনিবার আর রোববার যেন ঝড়ের গতিতে চলে যায়। ঘরের বাইরের কাজ, বাজারঘাট, রান্নাবান্না, আসন্ন সপ্তাহের জন্য সম্ভাব্য প্রস্তুতি নেওয়া, সব মিলিয়ে রবিবার বিকালবেলাটা যেন আসে আনন্দের সমাপ্তি নিয়ে দ্রুতগতিতে।
এটা শুধু আমাদের না, আমার ধারণা যে সংসারে বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী, সেই সব সংসারেরই চিত্র একই। বাসায় যদি পরিবারের তৃতীয় কোনো ব্যক্তি থাকেন যিনি সারা দিনমান বাসাতেই থাকবেন, তাহলে হয়তো এই চিত্রটা পাল্টে যেতে পারে। তবে এই প্রবাসে সেরকমটা হওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার বটে।
শখের বশে মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি। প্রবাসের দিনরাত্রি নামে এই ধারাবাহিকটির প্রায় চৌত্রিশটি পর্ব লিখেছি, প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে ধারাবাহিকভাবে। তবে সপ্তাহের যে চিত্রটা এখানে এঁকে দিলাম, তাতে লেখালেখি করাটা একটা বিলাসিতা বটে। লিখতে হলে তো সময় নিয়ে বসতে হবে। সেই সময়টুকু কই!
আমার অনেক বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী দেখা সাক্ষাৎ হলে মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করেন, কিছু লিখছি না কেন? এই ধারাবাহিকটা চালিয়ে যাচ্ছি না কেন? আমি শুধু মৃদু হাসি দিয়ে বলি, লিখব। লেখালেখিটা আমার রক্তে আছে মিশে, সময় পেলেই লিখতে বসে যাব। ছোট ছেলের বয়স এক বছরের বেশি হয়ে গেছে, ও এখন কিছুটা সময় হলেও নিজের মতো করে কাটায়, সেই সুযোগে এই যেমন আজকে অনেক দিন পরে এই গল্পটি লিখতে বসে গেলাম!
জীবনের এমনি নিয়ম। ছেলেমেয়েদের জন্ম দেওয়া, তাদের দেখভাল করা, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে বড় হতে শেখানো, তাদের একটা নিরাপদ এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ভবিষ্যতের জন্য বাবা মায়েদের জীবনের উৎসর্গের গল্প সব জায়গায় সব দেশেই একই। আমরাও সেই গল্পেরই একটি পরিচ্ছেদ মাত্র।
জানি ছেলেরা একদিন বড় হবে, চলে যাবে দূরে নিজেদের জীবনের গল্পের চরিত্রে উপস্থিতি দিতে। সেদিন আমরা দুজন আবার হব একা, হাতে তখন অফুরন্ত সময় হবে, তখন হয়তো লিখব তাদের জীবনের গল্প, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন আঙ্গিকে!

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: শিক্ষার আলোর দিশারি আমাদের সবার প্রিয় হেড স্যার

বাপ্পী খায়ের: ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র। লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।