আতঙ্ক আর শঙ্কার শহরে বসবাস

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ডিউটিতে আসার পরই দেখি ইমার্জেন্সি কল অপেক্ষায় আছে। কমিউনিটি সাইকিইয়াট্রিক নার্স মেরি বলল, ডা. জাহান, আজ আমাদের ইমার্জেন্সি হোম ভিজিট আছে। দুপুরের আগেই সারতে হবে, কারণ বিকেলে আমার একটা মিটিং আছে। আর হ্যাঁ তুমি কি আজকে ড্রাইভ করতে পারবে? আমার গাড়ি আজ গ্যারেজে।

রাজি না হয়ে উপায় নেই! আমাকেই ড্রাইভ করতে হবে।
ক্লিনিকে এসে প্রথমে চা খাওয়ার ইচ্ছেটা আজ নষ্ট হয়ে গেল। নতুন রোগী সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে পুরোনো ফাইল, নতুন ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পুরো একটা ঘণ্টাই চলে গেল।
আমি যে কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ টিমে (সিএমএইচটি) কাজ করছিলাম তা দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সাগরের পাশে এক পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। গাছগাছালি ঘেরা সুন্দর এক এলাকা। সমস্যা একটি আর তা হচ্ছে ড্রাইভিং। পাহাড় আর উঁচু টিলার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করা আসলেই বিপজ্জনক। ড্রাইভিং স্পিড কম রাখতে হয়। ড্রাইভ করতে গিয়ে হুট করে রাস্তায় ঘোড়ার সাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে। হরিণ বা শেয়ালের দেখাও অহরহ হয়ে যায়। কাজেই ড্রাইভিংয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। আর আজ এ ড্রাইভিং করে কমিউনিটি ভিজিট আমাকেই করতে হবে।
মাইকের (আমার রোগী) এক প্রতিবেশী জিপিকে ফোন করে মাইকের ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়েছে এবং সে তথ্যের সূত্র ধরে জিপি মাইকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে গত দুই দিন থেকে। মাইক এই এলাকায় এসেছে যদিও বছর তিনেক হলো, কিন্তু ডাক্তারকে সে দেখিয়েছে মাত্র একবার। পুরোনো কিছু ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে জিপি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মাইক রাজি হয়েছে সাইকিইয়াট্রিস্টের সঙ্গে আজ দেখা করতে। তবে তা হতে হবে তার বাসায়। মাইকের সঙ্গে যোগাযোগের পর তিনি (জিপি) কমিউনিটি সাইকিয়াট্রি টিমে চিঠি ফ্যাক্স করেছেন। সে ফ্যাক্সের সূত্র ধরেই আজকের হোম ভিজিট।
মেরি ও আমি হাজির হলাম মাইকের বাসার ঠিকানায়। মূল রাস্তায় আসার পর গাড়ি থামালাম। এবার আমাকে ড্রাইভ করতে হবে খুবই ছোট একটা রাস্তা দিয়ে সমতল থেকে কমপক্ষে দুই শ গজ ওপরে উঁচু টিলার ওপর দিয়ে। মাইকের বাড়ি ওখানে। মেরিকে আমার ড্রাইভিং উৎকণ্ঠার কথা বললাম। গাড়ি রাস্তায় পার্ক করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওইটুকু পথ আমরা হেঁটেই যাব।
বিশাল আলিশান বাড়ি। উঠোনে দুটো কার অযত্নে পড়ে আছে। শেওলা জমে আছে কারের গায়ে। অনেক দিন ধরে হয়তো কেউ ড্রাইভ করেনি। কলিংবেল টিপলাম কয়েকবার। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পিনপতন নীরবতা ভেঙে হঠাৎ হঠাৎ সীগালের শব্দ। উঠানে জমা হওয়া কোমর সমান ঘাস দেখে আমার সাপের ভয় করছিল। মেরি অবশ্য অভয় দিচ্ছিল।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কিচেনের জানালায় উঁকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। মাইক চা বানাচ্ছিল। খুবই বিরক্ত হলো মনে হলো। আইডি কার্ড দেখালাম। দরজা খুলে দিল রাজ্যের সব বিরক্তি নিয়ে। বলল কলিংবেল কাজ করছে না কত দিন থেকে সে নিজেও জানেন না।
কিছুটা বিরক্তি সহকারেই আমাদের তার বসার ঘরে নিয়ে গেল। ভদ্রতার খাতিরে চা অফার করল। ঘরের পরিবেশ দেখে আমার চা খাবার ইচ্ছেটা উবে গেল। মেরি অবশ্য চা না খেতে মানা করল না। মাইক চা বানানোর জন্য কিচেনে চলে গেল।
—তুমি কি জানো ওর ব্যাংকে কত টাকা আছে? মেরি বলল।
—না তো।
—দেখো ও কী ময়লা পরিবেশে আছে অথচ ওর ব্যাংকে কম করে হলেও এক মিলিয়ন পাউন্ডস (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১১ কোটি টাকা) জমা আছে। সোফার ওপরে ব্যাংক স্টেটমেন্ট পড়ে আছে।
মাইক তখন ফিরে এসেছে। গায়ে ময়লা ও ছেঁড়া জামা। গন্ধ বেরোচ্ছে। চশমার দিকে তাকালাম। অনেকগুলো ফাটা এবং তা স্কচ টেপ দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। একদম ভিক্ষুকের অবস্থা!
চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আমার বমি আসার অবস্থা। কষ্টে সামলে রাখি।
ড্রয়িং রুমের দিকে চোখ দিই। মাইকের দিকে ভালোভাবে তাকাই। লজ্জা আর বিস্ময়ে আমি বেশ বিব্রত বোধ করতে থাকি। বাইশ বছরের তরুণী নার্স মেরিও দেখি লজ্জায় লাল হয়ে আছে।
পুরো বসার ঘর জুড়ে top shelf magazines-এর ছড়াছড়ি। সোফা, চেয়ার, ফ্লোর, টি টেবিলে—সবখানেই top shelf magazines রাখা। মনে হলো top shelf magazines-এর এক লাইব্রেরিতে আমরা দুজন বসে আছি এক লাইব্রেরিয়ানের সামনে। কয়েক হাজার তো হবেই। দেয়ালে সাঁটিয়ে রাখা পিন-আপ মডেলদের সংখ্যাও কয়েক ডজন। আমি ঠিক বুঝতে পারি না ব্যাপারটা আসলে কী। ৫০ বছরের এই ভদ্রলোকের এ আবার কোন পাগলামি।
নীরবতা আমাকেই ভাঙতে হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম top shelf magazine নিয়ে কথা বলব না এখন। তবে আমাকে অবশ্যই মাইককে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং একটু পরে তা করার পরিকল্পনা করি।
—তো কেমন আছ তুমি মাইক? আর তোমার উঠানের এই অবস্থাই-বা কেন এ রকম? আমি তো সাপের ভয়ে অস্থির।
—সাপ? ওহ হো। তুমিতো আবার ইন্ডিয়ান ডাক্তার। শীতের দেশে সাপ বাইরে বেরোয় না। এটা ইন্ডিয়া নয়।
—সরি, আই অ্যাম নট ফ্রম ইন্ডিয়া, বাট ফ্রম বাংলাদেশ। ভুল শুধরে দিই তাকে।
—সরি ডাক্তার।
মেরি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। লজ্জার চোটে ওর আর চা খাওয়া হয় না।
মাইকের বাবা ছিলেন ব্যাংকার। মা-বাবার একমাত্র সন্তান মাইক। জন্ম ব্রিস্টলে। পড়াশোনা করে সে মূলত লন্ডনে। মাস্টার্স করেছে ইকোনমিকসে। কাজও করেছে লয়েডস ব্যাংকের বড় পদে।
মা মারা যান রোড অ্যাক্সিডেন্টে সে যখন ভার্সিটিতে পড়ে। লন্ডনে বাবার আলিশান বাড়িতে মাইক বাস করতে থাকে মূলত একাই। বাবার Dementia ধরা পড়ে ৬০ বছর বয়সে। স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে খুব দ্রুত। পাঠানো হয় থাকে Residential Home-এ। আর তখনই প্রকাশ পায় বাবার প্রায় মিলিয়ন পাউন্ডের মালিকানা এখন মাইকের।
—তো তুমি লন্ডন ছেড়ে এখানে, এই পাহাড়ি এলাকায় কেন? বিয়ে টিয়ে কিছু? মেরি প্রশ্ন করে।
—পারলাম কই।
মাইকের মুখের শিরাগুলো বড় হতে থাকে। ঘামতে থাকে হঠাৎ করে। মনে হলো মাইক যেন ভিন্ন জগতে চলে যাচ্ছে।
—আর ইউ ওকে? মাইক আর ইউ ফিলিং অলরাইট?
—আই অ্যাম ফাইন ডক্টর।
অন্যমনস্ক লাগে মাইককে।
—তুমি কি আসলেই ডাক্তার?
আমাকে জিজ্ঞেস করে মাইক। কিছুটা ভড়কে গেলাম।
—তোমার কি মনে হয়?
—তোমার আইডি কার্ডটা আবার দেখিতো?
দেখালাম আমার আইডি কার্ড আবার। মেরির দিকে চোখ বোলাল আবার। কেমন একটা ভয় আমার শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে। মেরির মুখে ঘাম জমছে খুব দ্রুত।
—আমার জন্য কী একটা চা আনতে পারো? বলে মাইককে কিচেনে পাঠিয়ে দিই আমি।
কথা বলি মেরির সঙ্গে সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে। মাইক আসার আগেই মেরি মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলে।
চা নিয়ে ফিরে আসে মাইক। চা খাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু একটু সময় নিচ্ছিলাম ওকে সরিয়ে।
—তো যা জিজ্ঞেস করছিলাম, তুমি লন্ডনের মতো শহর ছেড়ে এই পাহাড়ি এলাকায় কেন?
ব্যাংকে চাকরি করার সময় ঘটনা ঘটে প্রথম। একদিন ব্যাংকের অফিসে সে বসে আছে এক দুপুরে। স্পষ্ট সে শুনতে পেল ওর মা তার সঙ্গে কথা বলছে। বেশ অবাক হয় মাইক। কারণ তার মা মারা যাওয়ার তখন প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে।
তারপর তা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। রাত নেই, দিন নেই হঠাৎ করেই যেকোনো সময় মায়ের গলা। এটা করো, ওঠা করো। এটা না, ওটা না। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও বেশ উপভোগ করতে থাকে মাইক। সেও কথা বলে ‘মায়ের সঙ্গে’। কাউকে এ বিষয়ে বলা থেকে বিরত থাকে ইচ্ছে করেই।
ব্যাংকের এক কলিগ অ্যালেনের সঙ্গে তখন তার সম্পর্ক বেশ গভীর। ব্যাপারটা অ্যালেন টের পেয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ভয় পেয়ে যায় সে। ডাক্তারের কাছে মাইককে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। অ্যালেনের কথা উড়িয়ে দেয় মাইক। এক সময় বাকি কলিগদের কাছে তা জানাজানি হয়ে যায়। নিরুদ্দেশ হয় মাইক। লন্ডন ছেড়ে চলে যায় লিভারপুল এবং শেষমেশ এই পাহাড় আর জঙ্গলের শহরে।
মায়ের সে কণ্ঠের সঙ্গে যোগ হয়েছে এখন আরও অনেকে। হলিউডের নামীদামি সব নায়িকারা তার সঙ্গে কথা বলছে দিনরাত অহরহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে কথা বলছে তাদের সঙ্গে।
তারা তাকে বলছে তুমি যদি এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাও, আমরা আর তোমার সঙ্গে নেই। আর হ্যাঁ, তোমার ভুলের কারণে লয়েডস ব্যাংক বিলিয়ন পাউন্ডস লস দিয়েছে, পুলিশ তাই তোমাকে খুঁজছে হন্যে হয়ে। ধরা পড়লেই তোমার যাবজ্জীবন জেল।
—তুমি কি শুধু ওদের কথা শোনো? নাকি দেখতেও পাও? মাইককে জিজ্ঞেস করি।
—ওরা তো নিয়মিত আমার সঙ্গে দেখা করে। প্রতি রাতেই কেউ না কেউ এসে আমার সঙ্গে রাত কাটিয়ে যায়।
মেরি এখন সত্যিই ঘামছে। আমিও কিছুটা বিব্রত হচ্ছি।
—তাই নাকি?
—বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি ডাক্তার না। তুমি নিশ্চয়ই পুলিশের লোক।
মনে হলো মাইক অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলছে।
—ঘর ভর্তি এত ম্যাগাজিন। দেয়ালে ছবি। কিছু আমাদের বলবে?
—ওরাওতো আমার সঙ্গে কথা বলে। রাত হলে ম্যাগাজিন আর পোস্টার থেকে ওরা বেরিয়ে এসে সময় কাটায় আমার সঙ্গে। গল্প করি। এক সঙ্গে শুই।
—তোমার ঘর আর উঠানের এই অবস্থা? কার দুটোর অবস্থাও দেখি খারাপ। চশমা ভাঙা। আসলে কি হচ্ছে?
—বাইরে যাই না একদম পুলিশের ভয়ে। আমাকে ওরা পাগলের মতো খুঁজছে। তুমি কি আসলেই ডাক্তার?
আবার আশ্বস্ত করি তাকে। আশ্বস্ত হলো বলে মনে হলো না।
—যে বাড়িতে আছ, সেটা কি তোমার?
—হ্যাঁ, নগদ টাকা দিয়ে কেনা। অন্ধকার হলেই মাঝে মধ্যে বাইরে গিয়ে কিছু ফাস্ট ফুড নিয়ে আসি। হেঁটেই যাই। কার ড্রাইভ করি না। চশমা বদলাতে গিয়ে কি পুলিশের হাতে ধরা পড়ব? অ্যাঞ্জেলিনা এটা চায় না।
—অ্যাঞ্জেলিনা আবার কে?

লেখক
লেখক

—অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, হলিউডের নায়িকা। সেইতো প্রায়ই রাতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে। এই যে দেয়াল থেকে আমাকে সে তোমার সঙ্গে আর কথা না বলতে বলছে।
দেয়ালে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির খোলামেলা বিশাল এক ছবি টানানো।
—রাত হলেই সে ছবি থেকে জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে নেমে আসে। দিনে অবশ্য সে ব্যস্ত থাকে তবে কথা বলে সে আমার সঙ্গে।
আমি যদি বলি, মাইক তুমি অসুস্থ, তোমার হাসপাতালে আসা দরকার?
হঠাৎ সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে, তেড়ে আসে আমাদের দিকে।
—আমি জানতাম তোমরা পুলিশের লোক। আজ…।
পুলিশ বাইরেই অপেক্ষা করছিল। মেরিকে মাঝখানের চা বিরতির সময় পুলিশ ডাকতে বলেছিলাম। এগিয়ে আসে তারা। আমাদের উদ্ধার করে মাইককে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যায়।
পুলিশ স্টেশনে মাইককে Mental Health Act Assessment করে section 2-এর অধীনে বাধ্যতামূলক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মাইক Schizophrenia রোগের Auditory and visual hallucination এবং paranoid delusion এ ভুগছে। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। আতঙ্ক আর শঙ্কার শহর থেকে তার মুক্তি সম্ভব ওষুধ দিয়ে।

*এ কাহিনি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। Patient confidentiality issues থাকায় স্থান, কাল ও পাত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ডা. আলী জাহান: ইংল্যান্ডে কর্মরত সাইকিয়াট্রিস্ট।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: