পাতাদের আনন্দ-হিল্লোল

কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত
কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত

খোলা মাঠের এক পাশের দোলনায় দুলছিলাম। যতবার দোলনা পেছনে যাচ্ছিল চোখ চলে যাচ্ছিল বড় বড় গাছগুলোর পাতার দিকে। মনে হলো পাতাগুলো আনন্দে নাচছে। গাঢ় নীল আকাশের খুব সামান্যই দেখা যায় ঘন পাতার ফাঁকে। ভালো করে দেখব বলে গাছের নিচে গিয়ে ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়ালাম।

এগুলো বৃক্ষ জাতীয় গাছ। বাংলাদেশের অশ্বত্থগাছের পাতার সঙ্গে এর পাতার বেশ মিল। কটন উড নামে পরিচিত। কারণ এর ফল পাকলে তুলা বের হয়। ছোট ছোট পানের মতো পাতাগুলো কালচে সবুজ। দীর্ঘজীবী গাছ। আলবার্টার নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই গাছ।
পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প রোদের ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে চিত হয়ে শুয়ে দৃশ্যটা দেখতে থাকি। ঝলমলে আনন্দের হুটোপুটি পাতাগুলোর মধ্যে। যেন চমৎকার কোনো গানের সঙ্গে নেচে যাচ্ছে তারা। একেবারেই ছন্দপতন নেই। মাঝে মাঝে বাতাসের বেগ বাড়লে চঞ্চলতা বেড়ে যায়। তা যেন তীব্র আনন্দ। আবার ধীরে ধীরে তা কমে আসে। থেমে যায় না কখনোই। যখন কিছুটা স্থির, মনে হয় কোনো বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে একে অন্যকে। যেখানে পাতার ঘনত্ব কম, সেখানে তাদের একটু যেন বিষণ্ন লাগে। কিন্তু আবার সবার সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। রিনিঝিনি সুমধুর শব্দ ভেসে আসে পাতার নাচন থেকে। চোখ সরাতে পারি না। ওদের আনন্দ-উচ্ছলতা সংক্রমিত হয় আমার মাঝে।
এখানে খেলার মাঠগুলো এত সুন্দর করে সজ্জিত! বিশাল জায়গা জুড়ে বাচ্চাদের খেলাধুলার নানা সরঞ্জাম। হাঁটার পথ, ফুটবল বা এ জাতীয় খেলার জন্য ছড়ানো মাঠ। কোথাও কোথাও টেনিস গ্রাউন্ড। সব মিলিয়ে বিশাল জায়গা। নিয়ম করে সাজানো ফুলের বাগান। মাঠকে ঘিরে বড় বড় গাছ। এত বিস্তীর্ণ জায়গা, তাও বেশ নীরব। মাঝে মাঝে কেউই থাকে না। ল্যান্ডস্কেপিং এমন চমৎকার করে করা হয় যেন পাশের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর আড়ালে থাকে। ব্যস্ত রাস্তার গাড়িগুলোর শব্দ না আসে।

কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত
কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত

গ্রীষ্মের এমনি এক স্নিগ্ধ নীরব দুপুর আজ। শুধুই পাতাদের কলকাকলি। পাতাগুলোর হুড়োহুড়ি লুটোপুটি দেখতে দেখতে শৈশবে হারিয়ে যাই আমি। একঝাঁক ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ে। হইচই, দৌড়াদৌড়ি মহা আনন্দে খেলাধুলা করা ছেলেমেয়ের দল। আপন আনন্দে আত্মহারা, একই সঙ্গে একে অন্যের পরিপূরক।
আবার মনে হয় বিশাল বৃক্ষের এই মাথাটাই যেন পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করছে। বিচিত্র সব মানুষের মিলনমেলা এই পৃথিবী যজ্ঞে। দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দ-ভালোবাসায় ছন্দময় জীবন বয়ে চলছে এ ধরায়। কোথায় যেন এই পাতাদের সঙ্গে দারুণ মিল। সবাই একসঙ্গে আছে আবার প্রত্যেকেই আলাদা।

কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত
কটন উড গাছের পাতা। সংগৃহীত

এই যে অজস্র পাতা এরা কী আসলেই একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে? বোঝে কী একে অন্যের ভাষা? কোন পাতা ঝরে পড়লে কষ্ট হয় অন্যদের? যে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন গাছেরও প্রাণ আছে, তিনি কি পাতাদের ভাষা বুঝতেন? বিরামহীনভাবে চলছে পাতাদের কথোপকথন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি, দেখতেই থাকি। এ কী তাদের আনন্দ-হিল্লোল নাকি কর্তব্যের ব্যস্ততা!
পাতাদের মধুর ঝংকার রবীন্দ্রনাথ কে মনে করিয়ে দেয়—

‘নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে।
বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কি কারণে?
চারদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারী,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে।’

আফরিন জাহান হাসি: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।