নারী তুমি জাগ্রত হও!

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

ভাবছি বছরটা শুরু করব নিজের সমালোচনা দিয়ে। নিজের মানে নিজেদের। নিজেদের মানে নারী জাতিদের নিয়ে!

পাঁচজন নারী যদি এক ঘণ্টার বেশি একসঙ্গে গল্প করেন তবে তাদের গল্পের বিষয়বস্তু কীভাবে যেন শাড়ি-গয়না থেকে শুরু করে শ্বশুর বাড়ির মন্দ দিকগুলো কীভাবে আরও আলোকিতভাবে উপস্থাপন করা যায় সেদিকেই মোড় নেয়। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে সাতজন ঠিক এই আচরণের ভেতর দিয়ে যান এবং বাকি তিনজন গল্পের স্রোতের মধ্যে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন।
আমরা নারীরা নিজেরাও বুঝি না, এই সব গল্পের কারণে জীবন থেকে কতটা মূল্যবান সময় হেলায় নষ্ট করে ফেলি। আগের দিনে মা-খালারা দুপুরের অলস সময়ে শরৎ চন্দ্র পড়তেন অথবা কয়েক বাড়ির গিন্নিরা মিলে মেয়েলি আলোচনা করতে করতে উলের সোয়েটার বুনতেন না হয় নকশিকাঁথায় সুনিপুণ হাতে জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়াতেন! তারা আমাদের মতো তেমন শিক্ষিত ছিলের না। সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে, ছেলেমেয়ের দেখভাল করার পরও অবসর সময়টুকু তারা সবজি বাগান করা বা পিঠা তৈরি অথবা নিজ হাতে জামাকাপড় সেলাই করা—এই ধরনের কাজ নিয়েই মশগুল ছিলেন। তাদের ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল সংসারকে ঘিরে।
সেই সময়টা থেকে পরবর্তী সময়ে নারীরা যতটা শিক্ষা দীক্ষায় বা বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। উনিশ শতকের নারীরা পুরুষের পাশাপাশি নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের জন্য পরিবার ও সমাজের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে বিংশ শতকে ঘরে-বাইরে নিজেদের পদচারণা শক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে বিংশ শতকে উল্লেখযোগ্যভাবে মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরশীলতা আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে। সেই অর্থে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে নারীরাও সমান দাবিদার।
নারীরা যতটা আত্ম-উন্নয়ন ঘটিয়েছেন বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে, কেন জানি মনে হয় আমরা সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারব তো? আমরা পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা শ্বশুর বাড়ি থেকে চাকরি করার স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এমনকি আমরা সমাজে নিজেদের দক্ষ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।

লেখিকা
লেখিকা

যা হোক, যে কারণে নিজেদের সমালোচনা করব বলে শুরু করেছিলাম। কথায় বলে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে মনে হয় এত কষ্টের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা নারীরা অর্জন করেছেন তা ঠিক রক্ষা করা যাবে তো? আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো এক অজানা কারণে একজন নারী অন্য আরেকজন নারীকে যেকোনো ভালো কাজে উৎসাহ কম দেয়। আমরা নিজেরা শাশুড়ি কর্তৃক নির্যাতিত হই বলে আমরা নিজের ছেলের বউকেও নির্যাতন করতে চাই। আমরা নিজেরা হয়তো পড়ালেখা করে চাকরি করছি কিন্তু আরেকটা মেয়ে চাকরি করবে এই ব্যাপারে তাকে কোনো তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করি না। আমরা নারীরা বাচ্চা স্কুলে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুল এর মাঠে সমালোচনায় মত্ত থাকি। আমরা পাশের ডেস্কে বসা নারী সহকর্মীর পেশাগত উন্নয়নে হিংসা করি। আমরা অন্য এক সুশ্রী নারীকে দেখে ঈর্ষান্বিত হই। আমরা আরেকজন নারীর সংগ্রামময় জীবনে কোনো সহযোগিতার হাত বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করি না। কেন জানি আমরা নারীরা কোনো এক জায়গায় অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক। আমরা ভুলে যাই, নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি পাশের বাড়ির মেয়েটিরও যদি উন্নয়ন হয় তবেই কেবল সামগ্রিকভাবে নারীদের উন্নয়ন সম্ভব।
আজকের কিশোরী আগামী দিনের মা কিংবা নারী। নিজের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকলেও আজকাল পত্রিকা বা ফেসবুকের কল্যাণে দেখার সুযোগ হয় বাংলাদেশের তরুণীরা ফেস ভ্যালু বাড়ানোর জন্য কীভাবে কচুরি পানার মতো নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। দেশে এখন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব পালনের পাশাপাশি পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস পালনের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি উৎসব থার্টি ফার্স্ট নাইট, হ্যালোইন, থাঙ্কস গিভিং ডে—এই সবও জাঁকজমকভাবে পালন হচ্ছে।
সারা বছর জুড়ে কেবল উৎসব আর উৎসব! তার সঙ্গে একাত্মতার জন্য প্রতিটা দিবসের সঙ্গে ম্যাচিং করে মাথার ক্লিপ থেকে শুরু করে পায়ের আলতা, কোনোটাই বাদ যায় না। আমার ভাবনা হয়, এই সব জোগাড় করতে একজন ছাত্রী অর্থের জোগান কীভাবে করে? সবাই কি তবে টিউশন করে? কিংবা বাবা-মাকে কি টাকা পয়সা দেওয়ার জন্য প্রেশার দেয়? নাকি বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে যে প্রতিটা তরুণ তরুণী পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে? টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলো এই ধরনের সুবিধা দিচ্ছে আমি জানি। তাই বলে মোট ছাত্রছাত্রীর কত শতাংশ এই সুবিধা ভোগ করে?
ফেসবুক ওপেন করলে চোখে পড়ে, একের পর এক মেকআপ টিউটোরিয়াল! বিউটিশিয়ান/বিউটি এক্সপার্ট শব্দটা এখন আর প্রফেশনালি নেই। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা নিজেরাই সাজগোজের নিয়ম কানুন লাইভে দেখায়। তরুণীরা এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিবাহিত নারীরাও হিন্দি গানের সঙ্গে অশালীন অঙ্গভঙ্গিতে নাচ গান করে সেই ভিডিও আপলোড করেন। প্রেম-ভালোবাসার নামে অশালীন চ্যাট ও স্ক্রিনশটও গ্রুপে পোস্ট করতে দেখা যায়। আর ভারত বা পাকিস্তান থেকে আনা সালোয়ার কামিজের লাইভ ভিডিও তো চলছেই। হয়তোবা এই সব যুগের চাহিদা। কিন্তু আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ছাত্রী যদি সারাক্ষণ নিজেদের এইভাবে প্রদর্শনে উদ্‌গ্রীব থাকে তবে তাঁরা পড়াশোনা কখন করে? নাকি যে দেশে পরীক্ষার আগের রাতে অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় সেই দেশের তরুণীদের পড়ালেখার চেয়ে অনলাইনে নিজেদের তুলে ধরাই প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়! এইভাবে যদি জীবনের সুন্দর একটা সময় কেবল বাহ্যিক জৌলুশের দিকে ব্যয় হয় তবে আত্মিক উন্নয়ন হবে কবে?
কেন জানি মনে হয়, আমরা নারীরা অনেকটা অগ্রসর হয়ে আবার নিজেদের হারিয়ে ফেলছি না তো? আমরা কেমন নিজেদের অজান্তে নিজেকে পণ্য বানিয়ে ফেলি। শরীর প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। নারী স্বাধীনতা বলতে কেবল অর্থ উপার্জন বা পাশ্চাত্য পোশাকে নিজেকে আবৃত করাকে বোঝায় না। নারী স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের প্রতি সম্মান রাখার তাগিদ অনুভব করা। নিজের ভেতর শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে তোলার অধিকার আদায় করা। আরেকজনের দুঃসময়ে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। জীবনের প্রতিটা রস আস্বাদন করার জন্য নিজেকে তৈরি করা।
তাই ভাবি, এখনো সময় আছে, হে নারী, তুমি জাগ্রত হও! সব সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে চলো একে অপরের হাত ধরি। একজন আরেকজনের ভরসার বাহন হই। কেবল নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে বিকশিত করি। মেধায়-মননে, বচনে-চলনে, ধৈর্য-শৌর্যে, মমতায়-ক্ষমতায় সব ক্ষেত্রে ঝলকে ওঠার যে অসীম শক্তি সৃষ্টিকর্তা তোমায় দিয়েছে তার সবটুকু দিয়ে চলো আরেকবার দূরদর্শী, আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে নিজেদের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরি।

ফারজানা আক্তার পান্না: টরন্টো, কানাডা।